You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.18 | গোপালপুর যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

গোপালপুর যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)

গোপালপুর যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ১৮ই আগস্ট লেফটেন্যান্ট মাফুজ বেগ ও কমান্ডার এস এম মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে। যুদ্ধের আগে লেফটেন্যান্ট বেগ এবং কৈখালী ইপিআর ও ফরেস্ট ক্যাম্প কমান্ডার ডি এম ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল শ্যামনগর থানা সদরে অবস্থান করছিল। ঘটনার দিন ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্যামনগরে আসেন। তাঁর নির্দেশে কমান্ডার মিজানুর রহমান ১৮ই আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ শ্যামনগরে এসে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। শ্যামনগর থানার ওসি কাশেম ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিত ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। তিনি তাঁদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন।
ক্যাপ্টেন হুদার পরিকল্পনা ছিল শ্যামনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিত সুদৃঢ় করা। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে তিনি ঐদিন হিঙ্গলগঞ্জ ক্যাম্পে চলে যান। লেফটেন্যান্ট মাফুজ বেগ কমান্ডারদের বিশ্রামের নির্দেশ দিয়ে নিজেও বিশ্রাম নিতে যান। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাহারায় রেখে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও বিশ্রামে যান। হঠাৎ মধ্যরাতে পাকবাহিনী গোপালপুরের দিক থেকে এসে অতর্কিতে তাঁদের আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা অল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে পাল্টা জবাব দেন। প্রথম দিকে তাঁরা কমান্ডার মিজানুর রহমানের নির্দেশমতো সমবেতভাবে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নিজেদের স্বল্প অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তাঁরা টিকতে পারছিলেন না। এরূপ অবস্থায় লেফটেন্যান্ট বেগের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি দলে ভাগ হয়ে তিন দিকে চলে যান। একটি দল বংশীপুর মোড়, একটি দল খানপুর এবং একটি দল গোপালপুরের দিকে অবস্থান নেয়। কমান্ডার মিজানুর রহমান, এম এ মজিদ ও এন্তাজ ক্রলিং করে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েন। সেখানে লেফটেন্যান্ট বেগের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। গোলাগুলিতে হতাহতের সম্ভাবনা থাকায় লে. বেগ মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবন্ধের নির্দেশ দেন। এ সুযোগে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা দ্রুত গোপালপুরে অবস্থান নেয় এবং অল্পক্ষণের মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু করে। ততক্ষণে ভোর হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা স্পষ্ট দেখতে পান -রাজাকার- মাহমুদ, নুরুল ইসলাম ও ইস্রাফিল মাস্টারসহ স্থানীয় কয়েকজন লোক পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পাকবাহিনী ব্যাপক তল্লাশি ও গুলিবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষার্থে হলুদ, কেয়া, ধানক্ষেত প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেন। সুবেদার ইলিয়াস, আবুল কালাম আজাদ ও এম এ মজিদ রাস্তার ঢালে অবস্থান নেন। হঠাৎ পাকবাহিনীর ছোড়া একটি গোলা ইলিয়াসের মাথা ও আবুল কালাম আজাদের বুকে এসে লাগে। তাঁরা নিকটে দাঁড়ানো এম এ মজিদের শরীরের ওপর পড়ে যান। পাকবাহিনী এসে তিনজনকেই মৃত মনে করে তাঁদের অস্ত্রগুলো নিয়ে যায়। ইলিয়াস ও আবুল কালাম ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এবং এম এ মজিদ কোনোরকমে ক্রলিং করে এগিয়ে গিয়ে কমান্ডার মিজানুর রহমান ও এন্তাজের সঙ্গে মিলিত হন। এখান থেকে তাঁরা নিকটস্থ অশীতিপর বৃদ্ধা দুর্গাদাসীর পর্ণকুটিরে আশ্রয় নেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা তাঁদের খোঁজে এখানে এলেও পর্ণকুটির দেখে ভেতরে প্রবেশ করেনি। তাই তাঁরা বেঁচে যান।
গোপালপুর যুদ্ধে আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের একজন আব্দুল কাদের, অন্যজন অজ্ঞাত। যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহতরা হলেন- কমান্ডার মিজানুর রহমান (ভুরুলিয়া), ডি এম ইব্রাহিম খলিল (নূরনগর), এম এ মজিদ (কেয়াতলা) এবং সুবল মণ্ডল (বাদঘাটা)। ইব্রাহিম খলিলের ডান পায়ে গোলার স্প্লিন্টার লাগে। এ অবস্থায় তিনি ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার অতিক্রম করে গৌরীপুরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা এসে তাঁকে খড়মি ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর এবং অন্য আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সহায়তা করেন পুস্তক ব্যবসায়ী মুনসুর সরদার।
যুদ্ধে কয়েকজন সাধারণ মানুষও শহীদ হন। নৌকায় থাকা অবস্থায় আব্বাস আলী গাজীকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ঋষি নেতাই দাশকে প্রাণ দিতে হয় হিন্দু হওয়ার কারণে। পাকবাহিনীর পাশ দিয়ে যাওয়ার কারণে অজ্ঞাতনামা দুজন কৃষককে প্রাণ হারাতে হয়। যুদ্ধে ফজলুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। গোপালপুরের এ-যুদ্ধে শ্যামনগর, কৈখালী ও শমশেরনগরসহ আরো কয়েকটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন।
যুদ্ধে শহীদ চারজন মুক্তিযোদ্ধার দাফন নিয়ে স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে এলাকাবাসীর প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডা হয়। পরে শ্যামনগর থানা জামে মসজিদের পেশ ইমাম মোসলেম উদ্দীন কয়েকজন গ্রামবাসীকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের পাশের ধানক্ষেতে তাঁদের দাফন করেন। এ ব্যাপারে ভুরুলিয়া গ্রামের মেহেরুল্লাহ গাইন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে কবরের স্থানে কমান্ডার মিজানুর রহমানের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। পরে এটি ভেঙ্গে সরকারি উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর এলাকাবসী বিভিন্ন জাতীয় দিবসে এখানে এসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। [মিজানুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড