You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.15 | গোবিন্দপুর যুদ্ধ (খানসামা, দিনাজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

গোবিন্দপুর যুদ্ধ (খানসামা, দিনাজপুর)

গোবিন্দপুর যুদ্ধ (খানসামা, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় দুবার। প্রথম যুদ্ধ হয় ১৫ই এপ্রিল। এটি ছিল প্রতিরোধযুদ্ধ। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা শেষ পর্যন্ত টিকতে না পারায় বীরগঞ্জ পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ১৪ই ডিসেম্বর। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। এখানে ১১ জন পাকসেনা নিহত ও ১৭ জন মিত্রবাহিনী-র হাতে বন্দি হয়।
১৫ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী খানসামার দিক থেকে বীরগঞ্জ দখলের চেষ্টায় গোবিন্দপুরের পূর্বদিক থেকে আত্রাই নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্ত মুক্তিবাহিনী ও সর্বস্তরের জনতা আত্রাই নদীর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কয়েকটি বন্দুক ও রাইফেলের সাহায্যে এ চেষ্টা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে প্রতিরোধ দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ে এবং বীরগঞ্জ তাদের দখলে চলে যায়। ফলে সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ মানুষ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় ক্রমঅগ্রসরমাণ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বীরগঞ্জের দিক থেকে সম্মিলিতভাবে খানসামায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এখানে গোলন্দাজ বহর, আর্টিলারি সাপোর্ট, ট্যাংক, বিমান ও অনেক ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। গোবিন্দপুর থেকে ভাতগাঁ ব্রিজ পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ৬ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর একটি দলের অবস্থান ছিল বীরগঞ্জ-দশমাইল সড়কের ভাতগাঁ ব্রিজে। আরেকটি দল জেলা বোর্ডের রাস্তা ধরে খানসামার দিকে এগিয়ে গিয়ে গোবিন্দপুরে আত্রাই নদীর পশ্চিম প্রান্তে নদীর কাছাকাছি অবস্থান নেয়। নদীর অপর প্রান্তে ছিল খানসামা সদর, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বড় ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর খানসামা সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স। একটি বাঁশঝাড়ের নিচে ৩টি বাংকার ও ৬টি ট্রেঞ্চ নিয়ে মাহবুব আলমের নেতৃত্বে এফএফ কোম্পানির হেডকোয়ার্টার্স গড়ে ওঠে এখানে। একজন মেজরের নেতৃত্বে অবস্থান নেয় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। ৬ই ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী এখানে একাধিকবার নদীর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রবল গুলির মুখে পড়ে। ফলে তাঁদের থেমে যেতে হয়। এ অবস্থায় ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে একটা স্থিতি বিরাজমান ছিল। এ সময়ের মধ্যে মিত্রবাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করে এবং অপারেশনের প্রস্তুতি নেয়।
মিত্রবাহিনীর বিমান ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর খানসামায় কয়েকবার চক্কর দিয়ে ব্যাপক বোমা নিক্ষেপ করে। ১৪ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর চূড়ান্ত হামলা চালানো হয়। এদিন বিমান, আর্টিলারি, গোলন্দাজ, ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও হামলায় পাকিস্তানি সেনারা পর্যুদস্ত হয়। এদিন প্রথমে আর্টিলারি হামলা হয়। এরপর বিমান থেকে বোমা হামলা চালানো হয়। সঙ্গে-সঙ্গে ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনীর হামলা চলে পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর। আকাশে বিমানের কাভার, নদীর প্রান্ত ঘেঁষে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অব্যাহত গোলাবর্ষণ এবং আর্টিলারি সাপোর্টের মাঝে মিত্রবাহিনীর ইঞ্জিন কোরের সদস্যরা ভাসমান পন্টুন সেতু তৈরি করে দিলে সেতুর ওপর দিয়ে একের পর এক ট্যাংক পার করে নদীর পূর্ব প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্যাংকের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর পদাতিক দল এগিয়ে যায়। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুরো খানসামা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক বিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপে আত্রাই নদীর মধ্যখানে একটি ভারতীয় ট্যাংক অচল হয়। এ ট্যাংক বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এদিন ১১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১৭ জন মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড