You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে গোপালপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে গোপালপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল)

গোপালপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল) ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তৎকালীন সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এতে সমগ্র বাংলাদেশের মতো গোপালপুর উপজেলায়ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ছাত্ররা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন করতে থাকে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জনসভা, মিছিল ইত্যাদি চলতে থাকে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এলাকার জনগণ স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ২১শে মার্চ বাইশকাইল গ্রামের কে এম আবদুস সালামকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং তাঁরই নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর অকেজো রাইফেল দিয়ে গোপালপুর থানা মাঠে ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে। নূরুল ইসলাম (মধুপুর; আনসার কমান্ডার), সাহাব উদ্দিন (বাইশকাইল) এবং ছমির উদ্দিন (চাতিলা) প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ঝাওয়াইল, হেমনগর, নলীন, ভেঙ্গুলা, শিমলা, রামনগর, মির্জাপুর, হাদিরা, শাজাহানপুর প্রভৃতি মাঠেও ছাত্র-জনতা বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়। স্থানীয় আনসার সদস্য এবং ছুটিতে আসা বা পালিয়ে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব স্থানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
গোপালপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার আসাদুজ্জামান (নারুচী; টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদের উপদেষ্টা, মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব), হাতেম আলী তালুকদার এমএনএ (আওয়ামী লীগ নেতা এবং ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং সেন্টারের সংগঠক), রাফিয়া আখতার ডলি এমএনএ (নারুচী), আল মুজাহেদি (নারুচী; টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদের সদস্য), ডক্টর নূরুন নবী (খামারপাড়া ; কাদেরিয়া বাহিনী-র ব্রেইন হিসেবে পরিচিত), এস এম হাবিবুর রহমান (বেড়াডাকুরী; বিলেতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন), গোলাম মাওলা (হেমনগর; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বন্ধু, লন্ডন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন), শহীদুল ইসলাম লালু, বীর প্রতীক- (সূতি), নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর (কোম্পানি কমান্ডার), কাজী আশরাফ হোসেন হুমায়ুন বাঙ্গাল (কড়িয়াটা, কোম্পানি কমান্ডার), কে এম আব্দুস সালাম (বাইশকাইল, কোম্পানি কমান্ডার), জহুরুল হক ডিপটি (ছয়ানীপাড়া, কোম্পানি কমান্ডার), নূরুল ইসলাম (কোনাবাড়ী, কোম্পানি কমান্ডার), আশরাফুল হক শোভা (গোপালপুর সদর, কমান্ডার), মতিয়ার রহমান খান (শাখারিয়া, কোম্পানি কমান্ডার), আসাদুজ্জামান আরজু (কোম্পানি কমান্ডার), তারা মিঞা (কোনাবাড়ি; কোম্পানি কমান্ডার) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ২রা মে গোপালপুর উপজেলায় প্রবেশ করে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এই ক্যাম্প থেকে তারা বিভিন্ন সময়ে গোপালপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। এদের সহায়তার জন্য আসগর আলী মিয়া (তামাকপট্টি), ডা. নবী (কোনাবাড়ি), আব্দুল হাই (গোপালপুর সদর), মজিবর রহমান (গোপালপুর সদর), আব্দুস সালাম রাজী (বগার চালা), মোহাম্মদ আলী তালুকদার (মামুদপুর), নেরু খান (বেলুয়া) প্রমুখের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এরা জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ- ও নেজামে ইসলামী-র সদস্য ছিল। এদের তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়েও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সদস্যরা স্থানীয় কতিপয় ছাত্র-যুবককে ধরে এনে রাজাকার-, -আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে এবং তাদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহ দখলে নেয়।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে মাওলানা আবুবকর জামালী (মাকুল্লা), শফিউদ্দিন মুন্সী ওরফে শফর মুন্সী (চাতুটিয়া), হোসেন খলিফা (নন্দনপুর), তোফাজ্জল হোসেন (বসুবাড়ি), গুলু মিয়া (পোড়াবাড়ি), চাঁন মিঞা (বাগুয়াটা), খালেক মেম্বার (হাজরাবাড়ি), আবসার খলিফা (কোনাবাড়ি), আবদুল হাকিম খলিফা (বসুবাড়ি), বাবর আলী মেম্বার (জামতৈল), আবদুল মাজেদ মেম্বার (আতরবাড়ি), আবদুল কাদের (হাটবৈরান), আলমগীর হোসেন (গোপালপুর সদর), কাজী আবদুল আউয়াল তরফদার (সূতি পালপাড়া), মফেজ আলী মেম্বার (আতরবাড়ি), আব্দুল মালেক (আভঙ্গি), সাহবাজ আলী শেখ (বড়শিলা), ছামান আলী সরকার (উড়িয়াবাড়ি), জাকের হোসেন (ভেঙ্গুলা), নান্নু মিঞা (নারুচী), আব্দুস ছামাদ (শিমলাপাড়া), সেকান্দার আলী (বাখুরিয়াবাড়ি), হাবিবুর রহমান (পাইশকা), ডা. আজাহার আলী (বড়শিলা), অধ্যাপক আব্দুল খালেক (আভঙ্গি), রিয়াজ উদ্দিন চেয়ারম্যান (সুন্দর), হোসেন আলী মেম্বার (নন্দনপুর) আবসার আলী মেম্বার (পোড়াবাড়ি), সেকান্দার আলী (বাখুরিয়াবাড়ি), হোসেন আলী মেম্বার (হাজারাবাড়ি), মেসের আলী মেম্বার (হাজারাবাড়ি), মানিক মৃধা (গোপালপুর সদর), খসরু (পলিশা), আবুল সরদার (পলিশা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী গোপালপুর উপজেলায় প্রবেশ করে বৈরাম নদের ওপর বেপারীপাড়া ব্রিজে বহু লোককে হত্যা করে। নিহতরা হলেন সমাজহিতৈষী মোহিনী মোহন পাল, কানাই লাল দে, ওসমান আলী (চন্দ্রবাড়ী), আব্দুল কদ্দুস (ভূটিয়া), নূরুল ইসলাম (ভূটিয়া), মুসলিম উদ্দিন মাস্টার (ঝাওয়াইল), কাজিম উদ্দিন মাস্টার (আলমনগর) প্রমুখ। এছাড়া থানার সামনে বৈরাম নদীতে খেয়া নৌকায় ভুলে অনেককে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। মামুদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলী তালুকদারের ভাইসহ তাঁর পরিবারের ১৯ জন সদস্য হানাদারদের হাতে শহীদ হন।
হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা গোপালপুরে হিন্দুদের ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বহু বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং লুট করে। ১০ই অক্টোবর বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার বড়ভিটার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং লুট করে। কোনাবাড়ির নূরুল ইসলাম কমান্ডারের বাড়িও তারা পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া তারা নারীনির্যাতন, চাঁদাবাজি, জমি ও বাড়ি দখলসহ নানা প্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে।
গোপালপুর থানা ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখত এবং নির্যাতন চালাত।
পাক হানাদার ও রাজাকাররা গোপালপুর উপজেলায় তিনটি স্থানে গণহত্যা চালায়। সেগুলো হলো বাইশকাইল গণহত্যা, মামুদপুর গণহত্যা ও পানকাতা গণহত্যা। বাইশকাইলে ১১ জন, মামুদপুরে ২৪ জন এবং পানকাতায় ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। এ উপজেলায় দুটি গণকবর রয়েছে – পানকাতা গণকবর ও মামুদপুর গণকবর।
গোপালপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একাধিক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – পানকাতার যুদ্ধ- সাইলাজানি ব্রিজ অপারেশন এবং গোপালপুর থানাযুদ্ধ। পানকাতার যুদ্ধ হয় ২৯শে আগস্ট কমান্ডার আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সাইলাজানি ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় ৮ই অক্টোবর রাতে। কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার ব্রিজটির পাহারায় ছিল। কমান্ডার চাঁদ মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। গোপালপুর থানাযুদ্ধ পরিচালিত হয় দু-দফায় প্রথমবার ৮ই অক্টোবর এবং দ্বিতীয়বার ৮, ৯ ও ১০ই ডিসেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে থানা দখল করতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ-সময় শহীদুল ইসলাম লালু নামের এক ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা চা-বিক্রেতার ছদ্মবেশে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৮ই ডিসেম্বর শুরু হওয়া দ্বিতীয়বারের অভিযান চলে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। এদিন ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা চালালে পাকসেনারা পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করেন। যুদ্ধে দুজন পাকসেনা নিহত এবং বহু সংখ্যক রাজাকার বন্দি হয়। এছাড়া ৪ঠা আগস্ট নবগ্রাম নামক স্থানে কোম্পানি কমান্ডার নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের একটি যুদ্ধ হয়। এতে ছয়জন পাকসেনা আহত হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর ভেঙ্গুলা গ্রামে ঝিনাই নদীর পাড়ে সংঘটিত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করেন। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা জামতৈল গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ খবর জানতে পেরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ-সময় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার তারা মিঞা। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। পরে তাঁরা আরো সংগঠিত হয়ে আক্রমণ করলে পাকবাহিনী পিছু হটে এবং গোপালপুর ক্যাম্পে চলে যায়। এ-যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ৬ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনী হেমনগর জমিদারবাড়ি থেকে হেমনগর সেতু পর্যন্ত এ্যামবুশ করে। টহলরত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গুলি বিনিময় চলে। এতে সুরুজ আলী নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে মুক্তিবাহিনী কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করে। নভেম্বর মাসেই প্লাটুন কমান্ডার শামছুল হক তালুকদার ছানুর নেতৃত্বে একই স্থনে আরেকটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে দুজন রাজাকার বন্দি হয় এবং অবশিষ্ট পাকসেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। ১০ই ডিসেম্বর গোপালপুর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুরুজ আলী (পিতা জয়েন উদ্দিন, গণিপুর), জালাল উদ্দিন (পিতা কছিম উদ্দিন, গোলপেঁচা), দেওয়ান আব্দুল বাছেদ (পিতা আব্দুল হাকিম, গোলপেঁচা), আব্দুল মজিদ (পিতা আজগর আলী, ভোলারপাড়া), আবু তালেব (পিতা আকবর আলী, মান্দিয়া), আমির হোসেন (পিতা ছাবেদ আলী, উড়িয়াবাড়ি), আব্দুস সালাম (পিতা আব্দুল হক, শয়া) এবং খন্দকার আব্দুল লতিফ (পিতা খন্দকার জালাল উদ্দিন, পাতিলাডুবি)।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক (গোপালপুর), স্বাধীনতা কমপ্লেক্স (নন্দনপুর), স্বাধীনতা কমপ্লেক্স সংলগ্ন স্মৃতিসৌধ (গোপালপুর), মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর (নারুচী), খন্দকার আসাদুজ্জামান ডিগ্রি কলেজ (হেমনগর), হাতেম আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (মির্জাপুর), হাদিরা হাতেম আলী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (গোপালপুর), মনতলা-বড়ভিটা মুক্তিযোদ্ধা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা মাদ্রাসা (ভেঙ্গুলা) এবং শাখারিয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আঙ্গুর তালুকদার সড়ক (উপজেলা কার্যালয় থেকে কাজীবাড়ি পর্যন্ত, গোপালপুর)। [মামুন তরফদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড