গালিমপুর গণহত্যা (বালাগঞ্জ, সিলেট)
গালিমপুর গণহত্যা (বালাগঞ্জ, সিলেট) সংঘটিত হয় ১৯শে মে। এ গণহত্যায় ৩৪ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ এবং অনেকে আহত হন।
বালাগঞ্জ থানার একটি নিভৃত পল্লি গালিমপুর। কুশিয়ারার উত্তর তীর ঘেঁষে অবস্থিত এ গ্রামের মানুষজন ছিল নিতান্তই সহজ-সরল। ১৮ই মে পার্শ্ববর্তী বল্লভপুর গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাদের একটি বিষয় নিয়ে বিরোধ হয়। এরপর দুপক্ষের মধ্যে বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকটি বসে গালিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সালিশের মাধ্যমে বিবাদের নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু তারা জানত না যে, পরদিনই তাদের এক কঠিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম ফাজিলপুরের জনৈক মদরিছ আলী ও তার সহযোগীরা পরদিন অর্থাৎ ১৯শে মে সকালবেলা এসে জানায় যে, গ্রামের বিবাদের কথা শেরপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন শুনেছে। তাকে টাকা-পয়সা না দিলে সে গ্রামে আসবে পুনরায় বিচার করতে। নিরীহ গ্রামবাসীরা কিছু টাকা তুলে পাঠায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর মাত্র এক ঘণ্টা পর হানাদার বাহিনী তিনটি নৌকায় করে ওরমপুর হয়ে বল্লভপুর এসে পৌঁছায়। এসেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুর রাজা চৌধুরীকে নির্দেশ দেয় গালিমপুর গ্রামটি পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে। মাহমুদুর রাজা সে নির্দেশ পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করলে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার হাত-পা বেঁধে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গালিমপুরে। হানাদাররা এ গ্রামে ঢুকেই ৬ জনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। নিহতরা হলেন- সুরেশ রঞ্জন দাশ, রাকেশ রঞ্জন দাশ-১, রণেন্দ্র বিজয় দাশ, দিগেন্দ্র বিজয় দাশ, দেব্রত দাশ ও রাকেশ রঞ্জন দাশ-২। হত্যার পর কুশিয়ারার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়।
এরপর পাকবাহিনী গোটা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং যেখানে যাকে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। লুট করে নেয় গ্রামবাসীদের স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র। হানাদার বাহিনীর গুলিতে এ- সময় আরো ২৮ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। তাদের মধ্যে ১৫ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- চরিত্র দাশ, হরকুমার দাশ, সাধন রঞ্জন দাশ, সখী দাশ, যোগীন্দ্র দাশ, গুণমনি দাশ, খোকা দাশ, নৃপেন্দ্র চক্রবর্তী, অশ্বিনী চক্রবর্তী, নদীয়া চরণ দাশ, যামিনী দাশ, অমূল্য দাশ, মহানন্দ নমশূদ্র, রমেন্দ্র নমশূদ্র ও শৈলেশ নমশূদ্র। এ-সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে যান নিত্যানন্দ দাশ ও নগেন্দ্র দাশ। গণহত্যায় শহীদদের এখানেই সমাহিত করা হয়।
পাকবাহিনীর বর্বর হামলায় দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত গ্রামটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মাত্র ৪টি বাড়ি অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা পায়। গ্রামের অন্য সকল বাড়ি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের দেয়া আগুনে মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দুজন গৃহবধূকে তারা তুলে নিয়ে যায়। দুদিন ধরে নির্মম নির্যাতনের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড