You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে গুইমারা উপজেলা (খাগড়াছড়ি) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে গুইমারা উপজেলা (খাগড়াছড়ি)

গুইমারা উপজেলা (খাগড়াছড়ি) পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখান থেকে পূর্ব- পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ চারদিকে সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এর পশ্চিমে রামগড় হয়ে ফেনী সড়ক, পূর্বে মহালছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি সড়ক, উত্তরে খাগড়াছড়ি এবং দক্ষিণে মানিকছড়ি হয়ে চট্টগ্রাম সড়ক। গুইমারা উপজেলা সদরে অবস্থিত গুইমারা বাজারটি খাগড়াছড়ি জেলার সর্ববৃহৎ বাজার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর গুইমারার স্বাধীনতাকামী জনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
মং রাজা মং প্রুসাইন চৌধুরী (মানিকছড়ি) মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুইমারা এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মং সাজাই মারমা ওরফে ওয়ার্কার বাবু (গুইমারা), মংহ্লাপ্রু চৌধুরী (গুইমারা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান) প্রমুখ। তাছাড়া মং রাজার বিশেষ সহকারী সুরপতি চৌধুরী (মানিকছড়ি), অং থোয়াই মগ ওরফে লগতি প্রমুখ ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। মং রাজা মং প্রুসাইন মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মেজর মীর শওকত আলীকে সরাসরি সহযোগিতা করেন। এরপর তিনি ভারতের ত্রিপুরা যান এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হোসেন আলী ড্রাইভারকে নিয়ে রাঙ্গামাটির ডিসি এইচ টি ইমাম তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে গুইমারা দিয়ে রামগড় হয়ে ত্রিপুরা যান। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি এমএ হান্নানও গুইমারা আসেন। এঁদের সবাইকে স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করে।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী গুইমারায় অনুপ্রবেশ করে এবং প্রথমেই গুইমারা বাজারটি পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা গুইমারা ডাকবাংলো (বর্তমান সেনাক্যাম্প), গুইমারা হাইস্কুল ও হাসপাতালে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
এ এলাকা থেকে যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য ত্রিপুরার হরিনা, ওমতিনগর, পালাটানা ও আসামের লায়লপুর (কাছাড় ডিস্ট্রিক) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন, তারা হলেন- লুব্রেমরম মৌজার মং সাথোয়াই চৌধুরী (সাবেক জেলা কমান্ডার), লাব্রে মগ, দার্জিলিং টিলার রাখাল মজুমদার, বরুণ কান্তি পালিত, সমীর দাশ, পজাটিলার নারায়ণ চন্দ্র দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, মাস্টার পাড়ার কংজঅং মগ, দেওয়ানপাড়ার ক্যরী মগ, নতুনপাড়ার মং পাই মগ, দুম্ফরি মগ, হাজাপাড়ার অংসাথোয়াই মগ, ডিপিপাড়ার ঘ্রাসাথোয়াই মগ (বর্তমান উপজেলা কমান্ডার), মংহ্লাপ্রু মগ, থোয়াইঅং মগ, আমতলীপাড়ার কংজচাই, উথোয়াই মগ, চাইহ্লাপ্রু মগ, বরইতলীর মংহ্লাপ্রু মগ (বুলি), সাইংগুলিপাড়ার পথোয়াই মগ, থোয়াইঅংরী মগ, ডাক্তার টিলার সুধীর কান্তি মজুমদার (নান্টু), দেবলছড়ির মং রুইবাই চৌধুরী, চহ্লাপ্রু ম চৌধুরী, নাইংগ্য মগ, ওয়াচু মৌজার ম সালামগ, বড়থলির কংচাই মগ, মেকানিজ মগ, মম, মগ, রিপ্রু মগ, মং মং মগ এবং কমান্ডার মমংশে মগ। প্রশিক্ষণ শেষে এঁরা কমান্ডার রণবিক্রম ত্রিপুরা, ইপিআর কমান্ডার ক্যাপ্টেন অশোক ঘোষ (বাবুল) ও কমান্ডার সুবোধ কুমার ত্রিপুরার নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রবেশ করেন।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গুইমারা এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরের অধীনে ছিল, যার প্রধান ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। মহালছড়িতে ক্যাপ্টেন কাদের শহীদ হওয়ার পর তাঁর লাশ গুইমারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
পাকবাহিনী গুইমারা অনুপ্রবেশের পরপরই পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার- বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকারদের মধ্যে আবুবকর (ফেনী), হাসু মিয়া (হাজাপাড়া), আব্বাইয়া মগ (দার্জিলিংটিলা), সুইউপ্রু মগ (দেওয়ানপাড়া), শামসুল হক (পটিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী স্থানীয় যুবক ও মধ্যবয়সী লোকজনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করত। দার্জিলিংটিলার এক ত্রিপুরা নারী ও এক মগ কিশোরীসহ অসংখ্য নারীকে হানাদাররা ডাকবাংলো ক্যাম্পে ধরে নিয়ে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পাকবাহিনী গুইমারা যৌথ খামার এলাকায় এক মারমা নারীরও সম্ভ্রমহানি করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে কংক্য মগের পিতা মং চু মগকে (জমাদারপাড়া) গুইমারা হাসপাতালে স্থাপিত ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে তার পা ঘরের চালার সঙ্গে বেঁধে মাথা নিচের দিকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
ত্রিপুরার হরিনা থেকে গুইমারা আসার পথে মং রাজার বিশেষ সহকারী সুরপতি চৌধুরীসহ ৬ জন বাঙালি মানিকছড়ির তিনটহরি নামক স্থানে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পাকবাহিনী সুরপতি চৌধুরীকে গুইমারার লুব্রে মৌজা ব্রিজের কাছে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যদেরকেও তারা রামগড়ের পাতাছড়ায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মানিকছড়ির তিনটহরিতে গণকবর দেয়া হয়।
১৫ই ডিসেম্বর গুইমারা হানাদারমুক্ত হয়। [মো. বাবলু হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড