গাবুরাচর লঞ্চ যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)
গাবুরাচর লঞ্চ যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) ৬ই মে সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বোঝাই দুটি লঞ্চ চুনার নদীতে নিমজ্জিত হয়।
শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চল গাবুরা। বরিশালের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে ৯ম সেক্টরের প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। অস্ত্র সংগ্রহ করে তাঁরা ৬ই মে এম এল আনোয়ারা এবং এম এল সোহাগপুর নামে দুটি লঞ্চে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হন। সংগৃহীত অস্ত্রের মধ্যে ছিল এলএমজি, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ প্রভৃতি। অস্ত্রের সঙ্গে ছিল খাদ্যসামগ্রী এবং জ্বালানি তেল। নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ, মহিউদ্দিন আহমেদ এমপিএ, এডভোকেট জালাল সরদার, মকছুদ আলী খান বাদল, ছাত্রনেতা আ স ম ফিরোজ, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, তসলিম, গোলাম মোর্তজা মানিক, মইনুল, নৌকমান্ডার বাশার, লেফটেন্যান্ট নাসির, আবদুস সাত্তার কালু, ওবায়দুর রহমান মোস্তফাসহ ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা সংগৃহীত অস্ত্রের একটি অংশ নিয়ে এম এল সোহাগপুর লঞ্চে আরোহণ করেন। অপরদিকে মেজর জলিল, হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান, আবদুল জব্বার, আবদুল হকসহ আরো দুজন সৈনিক বাকি অস্ত্র নিয়ে এম এল আনোয়ারা লঞ্চে ওঠেন। লঞ্চ দুটি ইছামতি নদী পথে ভুরুঙ্গামারী বিএসএফ ক্যাম্প হয়ে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করে
বিএসএফ-এর টহল জাহাজ ‘চিত্রাঙ্গদা’ লঞ্চ দুটিকে সুন্দরবনের শমশেরনগর সীমান্ত পর্যন্ত এসকর্ট করে এগিয়ে দেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাতক্ষীরা হেডকোয়ার্টার্স এ তথ্য জানতে পেরে ‘Birds are flying, caze them’ এ সাংকেতিক খবর পাঠায়। বেতার যন্ত্রের সাহায্যে সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গানবোট লঞ্চদুটিকে আক্রমণ করার জন্য গাবুরাচরের বিপরীতে জঙ্গলের মধ্যে অপেক্ষা করে। সন্ধ্যার পর গাবুরাচরে পৌঁছামাত্র পাকবাহিনীর গানবোট সার্চলাইট জ্বালিয়ে অস্ত্র বোঝাই লঞ্চদুটি থামানোর নির্দেশ দেয়। এক পর্যায়ে তারা গানবোট থেকে ভারী অস্ত্র দিয়ে লঞ্চ দুটির ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে হানাদারদের একটি গানবোটের বেশ ক্ষতি হয়। বৃষ্টিপাতসহ প্রচণ্ড বজ্রপাতের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চ থেকে নেমে চরের বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণে গ্রামের অনেকগুলো বাড়িঘর এবং অস্ত্রবহনকারী লঞ্চদুটিতে আগুন ধরে যায়। রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গ্রামের মধ্যে আশ্রয় নেন। নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ, ওবায়দুর রহমান মোস্তফা, কুতুবউদ্দিন, নেভাল বাশার, মর্তুজা মানিক ও তাঁদের দলের আরো কয়েকজন গাবুরাচরের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন।
সারাদিন বাড়ির ভেতর থাকার পর রাতে পায়ে হেঁটে সীমান্তের কাছাকাছি অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। পথিমধ্যে শান্তি কমিটির সদস্যরা তাদের টাকা- পয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরদিন রাতে তাঁরা নৌকায় ইছামতি নদী পাড় হয়ে বিএসএফ-এর একটি বিওপিতে উঠে সকালে লঞ্চযোগে নদীতীরবর্তী ভারতের হাসনাবাদে পৌঁছান। মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গাবুরার সোহরাব হাজীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। শান্তি কমিটির নেতা সোহরাব হাজীর সঙ্গে সখ্য করে তার বড় ছেলের সহযোগিতায় তাঁরা হিঙ্গলগঞ্জ পৌঁছে যান। অন্যদিকে গ্রামের মধ্যে আশ্রয় নিতে গিয়ে নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ-র দলের মহিউদ্দিন আহমেদ এমপিএ, লেফটেন্যান্ট নাসির, আ স ম ফিরোজ, এডভোকেট জালাল সরদার, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আবদুস সাত্তার কালু, মকছুদ আলী খান বাদলসহ ১৯ জনকে রাজাকার রা ধরে অকথ্য নির্যাতন করে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ১৬ই ডিসেম্বরের পর তাঁরা মুক্তি পান। আ স ম ফিরোজ এবং আমিনুল ইসলাম সুরুজকে বরিশালে নেয়ার পথে উভয়ে কৌশলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পাকবাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড