গাজীপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (গাজীপুর সদর)
গাজীপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (গাজীপুর সদর) সংঘটিত হয় ১৯শে মার্চ। এদিন গাজীপুর (তৎকালীন জয়দেবপুর)-এর বীর জনতা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে এবং বীরদর্পে এক সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মার্চের সেই উত্তাল দিনে এ গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করেন। এ খবর শোনামাত্রই সারাদেশের মানুষ তীব্রভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এবং রাস্তায় নেমে আসে। দেশের সর্বত্রই স্লোগান ওঠে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, “তুমি কে আমি কে, বাঙালি-বাঙালি।’
মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক (আওয়ামী লীগ-এর এমপি এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী)-এর পরামর্শে জয়দেবপুরে (বর্তমান গাজীপুর) ২রা মার্চ রাতে থানা পশুপালন কর্মকর্তা আহম্মেদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসভবনে মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব উল্লাহ একটি সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেন। সভায় আ ক ম মোজাম্মেল হককে আহ্বায়ক এবং মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকনেতা নজরুল ইসলাম খানকে কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের সদস্যরা হলেন- ডা. সাঈদ বকস ভূঁইয়া (থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), হজরত আলী মাস্টার (চৌরাস্তা; (থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), অধ্যাপক আয়েশ উদ্দিন, মো. নুরুল ইসলাম (ভাওয়াল রত্ন), মো. আব্দুস ছাত্তার মিয়া (চৌরাস্তা), মো. শহীদ উল্লাহ বাচ্চু, হারুন-অর-রশিদ ভূঁইয়া, শহিদুল ইসলাম পাঠান জিন্নাহ এবং শেখ আবুল হোসেন (শ্রমিক লীগ)। পরিষদের উপদেষ্টারা হলেন- মো. হাবিব উল্লাহ, এম এ মুত্তালিব (শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা) এবং মণীন্দ্রনাথ গোস্বামী (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা)।
সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ৩রা মার্চ গাজীপুর স্টেডিয়ামের পশ্চিম পার্শ্বের বটতলায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ কাজটি করেন হারুন-অর- রশিদ ভূঁইয়া এবং মো. শহীদ উল্লাহ বাচ্চু।
৭ই মার্চ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জনসভায় আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে হাজার-হাজার বীর জনতা মাথায় লালফিতা বেঁধে গাজীপুর থেকে ট্রেন ও শতাধিক বাস-ট্রাকে করে এসে যোগ দেয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ উজ্জীবিত হয়ে তারা ১১ই মার্চ গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা (অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি) আক্রমণ করে। ফ্যাক্টরির গেটে তাদের বাধা দেয়া হলে আ ক ম মোজাম্মেল হক হাজার-হাজার মানুষের সামনে একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে মাইকে বক্তৃতা করেন। পাকিস্তানিরা যাতে বুঝতে পারে সেজন্য তিনি ইংরেজিতে বলেন— ‘I do hereby dismiss Brigadier Karimullah from the Directorship of Pakistan Ordnance Factory and do hereby appoint Administrative Officer Mr. Abdul Qader (ef) as the Director of the Ordnance Factory.’। এতে কাজ হয়। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বক্তৃতা চলাকালীন সময়েই পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে সালনা হয়ে ঢাকা চলে যান। ১৫ই এপ্রিলের পূর্বে তিনি আর গাজীপুরে ফিলে আসেননি। পাকিস্তান সমরাস্ত্র কারখানা ২৭শে মার্চ পর্যন্ত প্রতিরোধকারীদের দখলে ছিল। ১৩ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী হেলিকপ্টার নিয়ে রাজবাড়ি মাঠে অবতরণ করতে চাইলে শতশত বীর জনতা হেলিকপ্টারের প্রতি ইট-পাটকেল ও জুতো ছুড়তে থাকে। ফলে হেলিকপ্টারটি অবতরণ না করে ঢাকায় ফিরে যায়।
১৭ই মার্চ বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মদিন উপলক্ষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে লাখ-লাখ জনতার ঢল নামে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। এক পর্যায়ে গাজীপুরের এমএনএ সামসুল হক (স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য), হাবিব উল্লাহ এবং আ ক ম মোজাম্মেল হক পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গাজীপুরের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার ষড়যন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। তাঁরা বলেন- ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্রের মজুদ কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে রক্ষিত অস্ত্র নিয়ে যেতে চায়। এমতাবস্থায় তাঁদের কী করণীয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠে বলেন, ‘বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে দেয়া যাবে না – Resist at the cost of anything’| ১৯শে মার্চ শুক্রবার আকস্মিকভাবে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট গাজীপুরের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে আসে। একজন JCO (নায়েব সুবেদার) আ ক ম মোজাম্মেল হককে এ খবর জানান। মোজাম্মেল হক দ্রুত তাঁদের জয়দেবপুর হাইস্কুলের মুসলিম হোস্টেলে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হাবিবউল্লাহ ও শহীদুল্লাহ বাচ্চুকে এ খবর দেন। শহীদ উল্লাহ তখনই রিক্সায় চড়ে শিমুলতলীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্লান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জয়দেবপুর চলে আসার জন্য বলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে হাজার-হাজার শ্রমিক-জনতা চারদিক থেকে লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা, ছেন এবং দোনলা বন্দুকসহ জয়দেবপুর উপস্থিত হয়। তারা জয়দেবপুর রেলগেটে মালগাড়ির বগি, অকেজো রেললাইনের স্লিপার, গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরো ৫টি স্থানে ব্যারিকেড দেয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরত যেতে না পারে।
সে-সময় ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম। ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব রেলগেটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আদেশ দেয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটলে তার শিকার যাতে বাঙালিরা হয় সেজন্য বাঙালি সৈন্যদের সামনে এবং পাঞ্জাবি সৈন্যদের পেছনে দিয়ে মেজর সফিউল্লাহকে জনতার ওপর গুলি বর্ষণের আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা জনতার ওপর গুলি না করে শূন্যে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে সামনে এগোতে থাকেন। এমতাবস্থায় বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ আরো কয়েকজন বন্দুক ও ৪টি চাইনিজ রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হলে অনেক চেষ্টার পর ব্যারিকেড সরিয়ে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। এ-সময় খ্যাতিমান ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত পেছন থেকে একজন পাঞ্জাবি সৈন্যকে আক্রমণ করেন। এই সুযোগে আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ আরো কয়েকজন তার রাইফেল কেড়ে নেন। কিন্তু পেছন থেকে আরেকজন পাঞ্জাবি সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করলে তিনি সেখানেই শাহাদত বরণ করেন। ঐ স্থানে (বর্তমান চৌরাস্তার মোড়ে) জাগ্রত চৌরঙ্গী – নামে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য নির্মিত হয়।
১৯শে মার্চ জয়দেবপুরের এ সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি মাইলফলক এবং জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় ঘটনা। এ ঘটনার পর সারাদেশে স্লোগান ওঠে— ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর।’ [আ ক ম মোজাম্মেল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড