গরীবপুর যুদ্ধ (চৌগাছা, যশোর)
গরীবপুর যুদ্ধ (চৌগাছা, যশোর) সংঘটিত হয় ২১ ও ২২শে নভেম্বর। এটি ছিল মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের যুদ্ধ। মিত্রবাহিনী-র সঙ্গে পাকসেনাদের এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়। এখানে ৭৬ জন পাকসেনা নিহত এবং তাদের অনেক ট্যাংক ধ্বংস হয়। যুদ্ধে বিমান ও ট্যাংক ব্যবহৃত হয় এবং হাতাহাতি লড়াই হয়। জগন্নাথপুর আমবাগানের দক্ষিণে গরীবপুর ও বাড়ীয়ালী, পশ্চিমে গরীবপুর ও জামলতা, উত্তর-পশ্চিমে সিংহঝুলি, উত্তরে ছোট-সিংহঝুলি এবং পূর্বে ফুলসারা গ্রামের মাঠ সীমান্তের বিভিন্ন যুদ্ধে একে-একে পরাজিত হয়ে ১২ই নভেম্বর থেকে পাকসেনারা নিজেদের ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে নিতে শুরু করে। এ-সময় তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়। এ অঞ্চলে পাকবাহিনী প্রথমে চৌগাছা এবং পরে জগন্নাথপুর ও সিংহঝুলিতে অবস্থান দৃঢ় করে। ২১শে নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর উভচর ট্যাঙ্কগুলো বয়রা সীমান্তের কাছে কপোতাক্ষ নদ পার হয়ে চৌগাছায় প্রবেশ করে। সন্ধ্যার পর মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক থেকে পাকিস্তানিদের অবস্থানকে লক্ষ করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২২শে নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং-এর নেতৃত্বে নবম ইনফেন্ট্রি ডিভিশন গরীবপুর ও আশপাশের গ্রামগুলোতে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃেত্বে মুক্তিবাহিনী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। পাকসেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের তীব্র গোলাগুলির মধ্যে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ৪টি স্যাবরজেড জঙ্গি বিমান মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে আসামাত্র মিত্রবাহিনীর ৫টি ন্যাট আর জেট জঙ্গি বিমান এসে পাকিস্তানি বিমানগুলোকে ঘিরে ফেলে। এ-সময় ২টি পাকিস্তানি বিমান গুলি করে ভূপাতিত এবং একটিকে বন্দি করে ভারতের অভ্যন্তরে অবতরণে বাধ্য করা হয়। অন্য একটি পাকিস্তানি বিমান পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে দুজন পাকিস্তানি পাইলট বন্দি হয়। মিত্রবাহিনী পাকবাহিনীর ১৩টি শাফে ট্যাংক ধ্বংস করে। মিত্রবাহিনীর ৬টি ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক সময় এ-যুদ্ধ আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনগণ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিকামী গ্রামবাসী দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করে। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩টি শাফে ট্যাংক আটক ও ৭৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। বাকি সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ ও ট্যাংক ফেলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়।
গরীবপুর যুদ্ধের সামরিক, কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষতি হয় এবং পরাজয়ের ফলে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এ অবস্থা থেকে নিজের সৈন্যদের রক্ষার জন্য জেনারেল নিয়াজি ২২শে নভেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শন করে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা প্রচারের চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানোর জন্য তারা ভারতীয় বাহিনীর বিধ্বস্ত ট্যাংক দেখাতে বিদেশী সাংবাদিকদের গরীবপুরে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে তাদের এসব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসন নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা আহ্বানের দাবি জানায়। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানান। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ২১ ও ২২শে নভেম্বরের যুদ্ধকে পাক- ভারত যুদ্ধ শুরু বলে উল্লেখ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪শে নভেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে এ-যুদ্ধের বর্ণনা দেন। তখনো পাক-ভারত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষিত হয়নি। ফলে কূটনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় এ-যুদ্ধকে সীমান্ত সংঘর্ষ বলে উল্লেখ করা হয়। এ পটভূমিতে ২৩শে নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বিজয় অত্যাসন্ন বলে জাতির উদ্দেশে উদ্দীপনামূলক ভাষণ দেন। এ-যুদ্ধে অর্জিত বিজয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুলভাবে উদ্দীপ্ত করে এবং পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে তাঁরা ব্যাপক উৎসাহ ও সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। [মো. মোস্তানিছুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড