You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে খোকসা উপজেলা (কুষ্টিয়া) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে খোকসা উপজেলা (কুষ্টিয়া)

খোকসা উপজেলা (কুষ্টিয়া) মুক্তিযুদ্ধের সময় খোকসা উপজেলার ভৌগোলিক সীমা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্তমান অবস্থা থেকে ভিন্ন ছিল। তখন এ উপজেলায় ৩টি ইউনিয়ন ছিল। বর্তমানে ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা আছে। বর্তমানের আমবাড়িয়া ইউনিয়নটি তখন কুমারখালী থানার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড ছিল। আমবাড়িয়া ইউনিয়ন যুক্ত হওয়ায় খোকসা উপজেলার ভৌগোলিক সীমা এখন পদ্মার পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। সে কারণে উপজেলার আয়তন ও লোকসংখ্যা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলার উত্তরে পোপগ্রাম, জয়ন্তী হাজরা, ফুলবাড়িয়া, নতুন আমবাড়িয়া ও ধোকড়াকোল। পূর্বে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা, দক্ষিণে গড়াই নদী এবং পশ্চিমে কুমারখালী উপজেলা। ঐ সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল রেলপথ ও নদীপথ নির্ভর। জেলা শহরের সঙ্গে ট্রেন ও নদী ছাড়া বিকল্প কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। অভ্যন্তরীণ সকল রাস্তাই ছিল কাঁচা। যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই নাজুক অবস্থা যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক সহায়ক হয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম দিকে এখানে মুসলিম লীগ-এর প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এর পর থেকে মুসলিম লীগের সমর্থনে ধস নামে। তদ্স্থলে দ্রুত আওয়ামী লীগ-এর উত্থান ঘটে। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, 5 ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- ইত্যাদি সারা দেশের ন্যায় খোকসাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এসব আন্দোলনে জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এখানে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ন্যাপ-এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এ দুটি দল শীঘ্র এক হয়ে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক হয়। তখন তাদের একটাই স্লোগান ছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ দেশের অন্য যে-কোনো অঞ্চলের ন্যায় খোকসা উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে খোকসায় পাকিস্তান সরকারের কোনো প্রশাসনিক কর্তৃত্ব কার্যকর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চ ভাষণ-এর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-সহ প্রগতিশীল দলসমূহের নেতা-কর্মীরা সম্মিলিতভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ দানে অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং স্থানীয় আনসার বাহিনীর সদস্যরা ভূমিকা রাখেন। ২৬শে মার্চ থেকে রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, মজুর, মেহনতি মানুষ সকলকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে সরাসরি আহ্বান জানালে তারা স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। মো. আলাউদ্দিন খান, মো. ফজলুল হক, মো. আলাউদ্দিন সেখ, মো. রোকন উদ্দিন বিশ্বাস, মো. হাবিবুর রহমান, মো. মনজিল আলী, মো. লুৎফর রহমান, সদর উদ্দিন খান, মো. আলতাপ হোসেন মাস্টার, গোলাম সরওয়ার পাতা, মো. নজরুল ইসলাম, মোদাচ্ছের আলী আনজু, রবিউল আলম মজনু, তরিকুল ইসলাম তরু, সাইদুর রহমান মন্টু, আব্দুল আলিম, মোস্তফা কামাল মিলু, রফিকুল ইসলাম তালম, গোলাম ছরোয়ার বুদু, নির্মল কান্তি বিশ্বাস, আব্দুল মালেক লিয়াকত আলী, আয়ুব আলী, ওমর আলী, মো. মুসতাক আহমেদ রুমি, আহমেদ আলী, জালাল উদ্দিন, আবু দাউদ, রোকন উদ্দিন বাচ্চু, নূরুল ইসলাম দুলাল প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দল গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং যুবসমাজের অনেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে আব্দুল মজিদ বিশ্বাস ওরফে মজিদ মাস্টার (কমলাপুর; খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ডা. রবিউল বারী (ফুলবাড়ীয়া, শ্যামপুর; খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), সুলতান আহম্মদ ওরফে সুলতান মাস্টার, মো. আব্দুল গফুর মোল্লা (রমানাথপুর), খন্দকার সিরাজুল ইসলাম ওরফে সুটকা সাহেব (শোমসপুর), মো. আমানত আলী বিশ্বাস (বনগ্রাম), মো. আবুল হোসেন জোয়াদ্দার (কমলাপুর), মুন্সী মহম্মদ আলী (গোপক), বদর উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে বদু ডাক্তার (হিজলাবট), মো. আলতাফ হোসেন মোল্লা (পাইকপাড়া মির্জাপুর), খন্দকার হবিবর রহমান (শোমসপুর), আব্দুস ছাত্তার ডাক্তার(বেতবাড়ীয়া) প্ৰমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রশিক্ষণ শেষে
মুক্তিযোদ্ধারা দুটি শাখায় ভাগ হয়ে এলাকায় আসেন – গেরিলা বাহিনী ও মুজিব বাহিনী। জনগণ তাঁদের খাবার ও আশ্রয়দানে এগিয়ে আসে।
গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে খোকসা এলাকায় প্রথম প্রবেশ করেন গণেশপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ওমর আলী। তাঁর সঙ্গে আসেন রমানাথপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মালেক। এর অল্প কিছুদিন পরেই খোকসা-কুমারখালী উপজেলার গেরিলা কমান্ডার হিসেবে প্রবেশ করেন ডাঁশার মো. লুৎফর রহমান। তাঁর সঙ্গে আসেন একতারপুরের মো. আকবার আলী, চাঁদোটের মো. আবু বকর, মো. আলাউদ্দিন শেখ, কমলাপুরের সৈয়দ মুস্তাক আহম্মেদ রুমী (আরজু) প্রমুখ। এ গেরিলা বাহিনী জুন মাসের শেষদিকে খোকসা উপজেলার বিভিন্ন যুদ্ধে সফলতা অর্জন করে। সারা এলাকায় মানুষের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়। অপরদিকে রাজাকার- বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এরপর থেকে রাজাকার বাহিনী যে-কোনো অঞ্চলে প্রবেশ করতে সাহস পায়নি। ফলে গড়াই ও হাওড় নদীর মাঝখানের গ্রামগুলো এবং শিমুলিয়া থেকে শুরু করে মানিকাট, বশোয়া, একতারপুর, ঈশ্বরদী, মাছুয়াঘাটা, দশকাহনিয়া, শেখপাড়া, বেতবাড়ীয়া, চাঁদোট, মুকশিদপুর, বনগ্রাম, ওসমানপুর, হিজলাবট প্রভৃতি গ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
জুন মাসে গেরিলা বাহিনীর আরেক কমান্ডার মো. রফিকুল আলম খোকসা উপজেলার উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে আসেন শোমসপুরের মুক্তিযোদ্ধা গোলাম ছরোয়ার বুদো, মো. ফজলুল হক, কে এম মোয়াজ্জেম হোসেন, খাইরুল বাশার, মোশারফ হোসেন টুকু ও মোড়াগাছার কেছমত আলী। পরে আসেন জাগলবারের মো. মনজিল আলী। এ গেরিলা বাহিনীর সাহসী তৎপরতায় খুব অল্পদিনেই শোমসপুর হাইস্কুল মিলিশিয়া ক্যাম্পের মিলিশিয়ারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং তাদের তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অপর শাখা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে খোকসা অঞ্চলে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগ নেতা মো. আলাউদ্দিন খান (মালিগ্রাম)। তাঁর সঙ্গে আসেন শোমসপুরের মো. সদর উদ্দিন খান, খন্দকার মোদাচ্ছের আলী আনজু, মো. রোকন উদ্দিন বিশ্বাস বাচ্চু, মো. নুরুল ইসলাম দুলাল ও মো. রবিউল আলম মজনু। পরে আসেন হিজলাবটের মো. সাইদুর রহমান মন্টু ও তারিকুল ইসলাম তরু। মুজিব বাহিনী খোকসার কেন্দ্রস্থলসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। শিমুলিয়া, মানিকাট, বশোয়া ও মুকশিদপুর গ্রামে এ বাহিনী নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা খোকসা এলাকা মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হন।
খোকসা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সংগঠকরা হলেন- মো. আলাউদ্দিন খান, আলহাজ্ব সাইদুর রহমান মন্টু (খোকসা মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা), লুৎফর রহমান (খোকসা উপজেলার এফএফ কমান্ডার), মো. ফজলুল হক (বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার), আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান (খোকসা উপজেলার বিএলএফ কমান্ডার এবং বর্তমানে খোকসা উপজেলার চেয়ারম্যান ও কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) প্রমুখ।
খোকসা উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন প্রথমে ওমর আলী। পরবর্তীতে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগ নেতা মো. লুৎফর রহমান (কুমারখালী) এবং আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান। এছাড়া মো. আলাউদ্দিন খান এবং ঐ সময়কার ছাত্রলীগ নেতা ও সাহসী যোদ্ধা কে এম মোদাচ্ছের আলী আনজু স্থানীয় অপারেশন কমান্ডার ছিলেন।
স্থানীয়ভাবে এ উপজেলায় গেরিলা বাহিনী, মুজিব বাহিনী, আকবর বাহিনী, আলম বাহিনী, মন্টু বাহিনী ইত্যাদি ছিল। এসব বাহিনী পাকহানাদার, রাজাকার, মিলিশিয়া ও বিহারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
খোকসা উপজেলার খোকসা জানিপুর পাইলট হাইস্কুলে রাজাকার, বিহারি ও মিলেশিয়া বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করবে এ সংবাদ জানতে পেরে স্থানীয় জনতা, মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশে বাধা প্রদান করেন।
মে মাসে পাকবাহিনীর সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনী খোকসা উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং শোমসপুর হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া খোকসা জানিপুর হাইস্কুল, মোড়াগাছা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গণেশপুর বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। এসব ক্যাম্প থেকে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনী খোকসা উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে অপরাধমূলক কার্যক্রম চালায়।
এপ্রিলের শেষদিকে খোকসা উপজেলার জানিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা আকামদ্দিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তার সঙ্গে যোগ দেয় কাঠু সিরাজ নামে এক জামায়াত নেতা (মোড়াগাছা)। এই কাঠু সিরাজ ছিল অত্যন্ত কট্টরপন্থী। সে জ্বালাও-পোড়াও কাজে নেতৃত্ব দিত। তার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকারদের বিভিন্ন গ্রামে পাঠানো হতো মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নেয়া এবং গ্রামের নিরীহ মানুষদের ধরে আনার জন্য। খোকসা উপজেলা ছিল হিন্দুপ্রধান। তাই হিন্দু পরিবারের মালামাল লুণ্ঠন করাই ছিল রাজাকারদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। জানিপুর, কমলাপুর ও ঈশ্বরদী অঞ্চলে তখন বেশকিছু হিন্দু আত্মগোপন করে ছিল। আকামদ্দিন চেয়ারম্যান মুসলিম লীগ নেতা সাদ আহম্মদের মাধ্যমে এ সংবাদ কুষ্টিয়ায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে। মে মাসে পাকসেনারা আকামদ্দিন চেয়ারম্যানকে খবর দিয়ে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল ফজলুল রহমান ফজলা নামে আরেক রাজাকার। সে ছিল আকামদ্দিন চেয়ারম্যানের দেহরক্ষী। খোকসা উপজেলায় গণহত্যার সময় পাকসেনাদের খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব ফজলা রাজাকার গ্রহণ করে। পাকসেনারা জ্বালাও- পোড়াও ও গণহত্যা চালাতে কুষ্টিয়া থেকে ঈশ্বরদী আসছে এ সংবাদ এখানকার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে অধিকাংশ হিন্দু গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিছু সংখ্যক হিন্দু গ্রামে থেকে যায়। পাকসেনারা তাদের ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে অনেকে হত্যার শিকার হয়। এটি ঈশ্বরদী গণহত্যা- নামে পরিচিত। সেদিন হানাদার বাহিনী খাগড়বাড়ী, ঈশ্বরদী, একতারপুর ও ওসমানপুরের হিন্দুদের বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়। নভেম্বর মাসে ওসমানপুর নদীর চরে পাকহানাদার বাহিনী, বিহারি ও রাজাকাররা ১০ জন নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা ওসমানপুর চর গণহত্যা- নামে পরিচিত। শহীদদের ঐ চরেই গণকবর দেয়া হয়। এটি ওসমানপুর চর গণকবর- হিসেবে পরিচিত।
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে পর্যন্ত ২ মাস এ উপজেলার ওপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেলে এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হিন্দু অধ্যুষিত ১০-১২টি গ্রাম বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। অন্যান্য গ্রামগুলোর অবস্থাও তদ্রূপ ছিল। এর মধ্যেও পাকবাহিনী, রাজাকার, বিহারি ও মিলিশিয়ারা উপজেলার বেশকিছু মানুষকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ১৮ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- ফটিক চন্দ্র রায় (ওসমানপুর), ইছাহক আলী প্রামাণিক (মালিগ্রাম), হাতেম আলী শেখ (মালিগ্রাম), শুটকা সেখ ওরফে গুয়ে সেখ (কোমরভোগ), সলোক সেখ (রায়পুর), আব্দুল গণি জোয়ার্দার (গণেশপুর), রাখাল চন্দ্র রায় (ওসমানপুর), নারায়ণ চন্দ (ওসমানপুর), মনছের আলী সেখ (শোমসপুর), বীরেন্দ্র নাথ চন্দ টুলা (হিলালপুর), মোজাহার আলী বিশ্বাস (রতনপুর), আনছার আলী খাঁ (মোড়াগাছা), মিন্টু বাড়ই (দশকাহনিয়া), গোবিন্দ মণ্ডল (মানিকাট), আমীর হোসেন (কুঠি মানিকাট), দানেজ মণ্ডল (জাগলবা), আজিমুদ্দিন সেখ (পূর্ব বেতবাড়ীয়া) ও রাজো জেলেনী (শেখপাড়া)। শোমসপুর হাইস্কুলে স্থাপিত মিলিশিয়া ক্যাম্পে বিভিন্ন সময়ে গ্রামবাসীদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। ওসমানপুরের রাখাল চন্দ্র রায় ও নারায়ণ চন্দ্র রায় এখানে নির্যাতনের শিকার হয়। এছাড়া রাজাকার ও বিহারিরা গ্রামের নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করত। শোমসপুর হাইস্কুল ক্যাম্প বন্দিশিবির হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এ ক্যাম্পে আটক রেখে অনেকের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হতো।
উপজেলার মোড়াগাছার হেলালপুর খাল বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অনেককে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে শোমসপুর হাইস্কুলে স্থাপিত মিলিশিয়াদের ক্যাম্পে নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতনের পর পাকসেনা, মিলিশিয়া ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা আটকৃতদের খোকসা স্টেশন সংলগ্ন সন্তোষপুর গ্রামের পদ্মবিল মৌজার আউট সিগন্যালের কাছে নিয়ে হত্যা করত। এরপর মৃতদেহগুলো পানিতে ভাসিয়ে দিত।
খোকসা উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক অপারেশন পরিচালিত ও যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো মোড়াগাছা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, চাঁদোট মসজিদ যুদ্ধ, বসিগ্রাম রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, সোমশপুর হাইস্কুল যুদ্ধ, ধোকড়াকোল যুদ্ধ ও খোকসা থানা অপারেশন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে মুজিব বাহিনীর একটি দল দুভাগে ভাগ হয়ে মোড়াগাছা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে একজন রাজাকার নিহত হয়। পরবর্তীতে রাজাকাররা এ ক্যাম্প প্রত্যাহার করে খোকসা উপজেলার মূল ক্যাম্পে চলে যায়। চাঁদোট মসজিদ যুদ্ধ হয় দুবার – ৬ই জুন ও ১৭ই জুলাই। প্রথমবার রাজাকার কমান্ডার গোলাম আলী ও তার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে একজন রাজাকার নিহত ও ৩ জন বন্দি হয়। বাকিরা গড়াই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়। নিহত রাজাকারের নাম সিরাজ (চাঁদোট)। বন্দি ৩ জন রাজাকার হলো- নাজিমদ্দিন (চাঁদোট), আব্দুস সোবহান (চাঁদোট) ও আ. রশিদ (মুকশিদপুর)। এ- যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ৪টি রাইফেল উদ্ধার করেন। ছাত্রলীগ নেতা ও গেরিলা কমান্ডার লুৎফরের নেতৃত্বে এ-যুদ্ধ পরিচালিত হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন আব্দুল জলিল, মনোয়ার হোসেন, আব্দুল মালেক, আলাউদ্দিন, মোস্তফা কামাল মিলু, আকামদ্দিন, মুজিব বাহিনীর সহ-অধিনায়ক আলাউদ্দিন খান, সদর উদ্দিন খান, মোদাচ্ছের হোসেন আনজু, রোকন উদ্দিন বাচ্চু, তরিকুল ইসলাম তরু, সাইদুর রহমান মন্টু প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন শৈলকুপা, কুমারখালী, খোকসা এবং কুষ্টিয়ার বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধও হয় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে। রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় কমান্ডার গোলাম আলী। এ-যুদ্ধেও রাজাকারদের পরাজয় ও প্রাণহানী ঘটে। বাকিরা পালিয়ে যায়।
২১শে জুলাই কমান্ডার মো. লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী খোকসা উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বরাবর কুমারখালী উপজেলার দক্ষিণ অঞ্চল পান্টি ইউনিয়নের। সিগ্রামে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে – মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য অর্জিত হয়। যুদ্ধ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, এ এলাকার রাজাকার বাহিনীর প্রধান একদল রাজাকারসহ ডাঁশা চাষি ক্লাবের পাশে ওয়াপদার একটি বাসায় লুকিয়ে আছে। তাকে ধরতে ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ঐ বাসায় প্রবেশ করলে এক পর্যায়ে রাজাকারের পুত্র শহিদুল ইসলাম ঝন্টু স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ইকবাল, লুৎফর, গোপাল, আনছার ও কুদ্দুস নামে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। গুরুতর আহত হন ৪ জন। আহতদের মধ্যে দুজন হলেন রমানাথপুরের মো. আব্দুল মালেক ও আজইলের মো. আব্দুস ছাত্তার।
শোমসপুর হাইস্কুল যুদ্ধ হয় সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী, গেরিলা বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে বিহারি ও রাজাকারদের। এ-যুদ্ধে একজন রাজাকার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। নিহত রাজাকারের নাম রিয়াজ উদ্দিন শেখ (বি-মির্জাপুর)।
ধোকড়াকোল যুদ্ধ হয় নভেম্বর মাসের শেষদিকে রাজাকার কমান্ডার তাইজাল মণ্ডল ও বিহারিদের সঙ্গে। এ-যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এক পর্যায়ে রাজাকার ও বিহারিরা পাকসেনাদের সাহায়তায় পালিয়ে যায়।
ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ সন্ধ্যায় খোকসা উপজেলার রাজাকার কমান্ডার মো. আব্দুল হাই ৭টি ৩০৩ রাইফেল ও ৬ জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে বেতবাড়িয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছাত্তার ডাক্তারের বাড়িতে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মো. আলাউদ্দিন খানের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনায় সারা উপজেলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ঐ রাতেই মুজিব বাহিনীর সব যোদ্ধাদের নিয়ে মানিকাট এলাকায় বৈঠক করে খোকসা থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম দুলালের নেতৃত্বে থানার টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে রাত ১০টার দিকে থানা আক্রমণ করা হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে খোকসা পশু হাসপাতালে বন্দি করে রাখা গণেশপুর রাজাকার ক্যাম্পের আত্মসমর্পণকৃত একদল রাজাকারকে মানব ঢাল হিসেবে সামনে রেখে মুক্তিযোদ্ধারা থানার নিকট অগ্রসর হন। এরপর দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কে এম মোদাচ্ছের আলী আনজু গ্রেনেড হাতে ওসির বাসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। উপায়ান্তর না দেখে ওসি আব্দুল গনি সদলবলে আত্মসমর্পণ করে। তার সঙ্গে থানার সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) নাজিরুল ইসলামও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। আত্মসমর্পণকৃত পুলিশ ও রাজাকারদের বন্দি করে মুক্তিযোদ্ধাদের মানিকাট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এ-যুদ্ধে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান কমান্ডার মো. আলাউদ্দিন খান ও মো. সাইদুর রহমান মন্টু।
আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান প্রাথমিক বিদ্যালয়। [মো. শামীম রেজা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড