You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক খোরশেদ আলম তালুকদার - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক খোরশেদ আলম তালুকদার

খোরশেদ আলম তালুকদার, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯২৮) কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯২৮ সালে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার বীর ঘাটাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মনির হোসেন তালুকদার এবং মাতার নাম কুলসুম বেওয়া।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে খোরশেদ আলম তালুকদার ১৯শে এপ্রিল তাতে যোগ দেন। তিনি স্থানীয়ভাবে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর মার্চের গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নারীধর্ষণ ইত্যাদি তাঁকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এমতাবস্থায় তিনি নিজ খোরশেদ আলম তালুকদার উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শীঘ্রই তিনি কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম-এর বাহিনীতে যোগ দিয়ে এর অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার হন। টাঙ্গাইলই ছিল তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র। বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিকী এবং অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি অনেক অপারেশনে অংশ নেন। এর মধ্যে গর্জনা গ্রামের অপারেশন উল্লেখযোগ্য। কাদের সিদ্দিকী তাঁর কিছু সহযোদ্ধাকে নিয়ে গর্জনা গ্রামে আসেন। সেখানে এক বিডি মেম্বারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ঐ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। কাদের সিদ্দিকী ও সহযোদ্ধারা রাতে সতর্ক অবস্থায় থাকেন, কারণ আশ্রয়দাতার প্রতি তাঁদের সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। দুপুর বারটার পর দূরবিন দিয়ে কাদের সিদ্দিকী দেখেন কয়েকটি নৌকায় কিছু পাকসেনা গর্জনা গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। নৌকার সংখ্যা ছিল ১০টির মতো। এটি ১৪ই আগস্টের ঘটনা। ৪টি নৌকা খোরশেদ আলমের অবস্থানের দিকে এগুচ্ছিল। খোরশেদ আলমের সঙ্গে ছিলেন অপর এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বেনু। নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছতেই তাঁরা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হন। খোরশেদ আলম ও বেনু বাড়ির (যে বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন) দুদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দিতে থাকেন। তাঁরা দেখেন নৌকা থেকে নেমে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা পার্শ্ববর্তী এক বাড়িতে যাচ্ছে। খোরশেদ আলম ও ৩ জন সহযোদ্ধা স্টেনগান নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর পাকসেনারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের নৌকার ওপর বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষণ করতে থাকেন। ফলে একটি নৌকা ডুবে যায়। ঠিক সে-সময় খোরশেদ আলমের সামান্য দূরত্বে দুজন পাকসেনা হামাগুড়ি দিয়ে অবস্থান বদল করছিল। তাঁর অব্যর্থ ব্রাশফায়ারে দুজনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু পাশ থেকে অন্য পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া দুটি গুলি খোরশেদ আলমের বাহু ও পেটের ডান পাশ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কাদের সিদ্দিকী তাঁর চিকিৎসার জন্য মহানন্দপুর ক্যাম্পে পাঠান। এদিকে কাদের সিদ্দিকী তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে নদীর পাড়ে অবস্থান নেন। পাকসেনাদের চলন্ত নৌকার ওপর বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়। দু-তিন মিনিটের মধ্যে যুদ্ধশেষ। পাকিস্তানি সেনাদের দুটি নৌকা ডুবে যায়। ৪০০ গজ দূরে আরেকটি নৌকারও একই পরিণতি হয়। অধিকাংশ পাকসেনারই গুলিতে না হয় পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। চিকিৎসা শেষে খোরশেদ আলম পুনরায় কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম তালুকদারকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ১ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম আসমা আলম তালুকদার। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড