স্থানীয় মুক্তিবাহিনী খলিল বাহিনী (মাদারীপুর সদর)
খলিল বাহিনী (মাদারীপুর সদর) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। মাদারীপুর থানা কমান্ডার খলিলুর রহমান খানের নামে এর নামকরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কমান্ডার খলিলুর রহমান খান শহীদ হয়েছেন বলে খবর পেয়ে তাঁর সহযোদ্ধারা মাদারীপুরের ১নং এরিয়া কমান্ডের এ নাম দেন। প্রকৃতপক্ষে সে-সময় খলিলুর রহুমান শহীদ না হলেও এ নামে এরিয়া কমান্ডের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা মাদারীপুর এলাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ হামলা, অপারেশন ও যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
২৭শে মার্চ থেকে মাদারীপুর শহরে নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রথমে নাজিমউদ্দিন কলেজের হেডক্লার্ক খলিলুর রহমান খান ও এ টি এম কামালুজ্জামান এবং পরে ছুটিতে থাকা বিমান বাহিনীর সৈনিক আলমগীর হোসাইন ও মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৩০শে মার্চ মাদারীপুর শহরে আসেন – আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী। এদিন মিলন সিনেমা হলে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের আলোচনা সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ক্যাপ্টেন এ শওকত আলীকে মাদারীপুর মহকুমার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। আগরতলা মামলার অন্য আসামি স্টুয়ার্ড মুজিব এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মাদারীপুরে আসেন। ক্যাপ্টেন শওকত আলী ও স্টুয়ার্ড মুজিব অস্ত্র আনা এবং ভারতে ছাত্র- যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে ভারতে যান। সেখানে তাঁদের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী – এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।
১৭ই এপ্রিল সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মাদারীপুর মহকুমার ৯টি থানা থেকে নির্বাচিত ১৬৫ জন ছাত্র-যুবক ভারতে যান। তাদের মধ্যে মাদারীপুর সদর থেকে ছিলেন ৭১ জন। তারা হলেন- খলিলুর রহমান খান, সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু ভূঁইয়া, কাজী মাহাবুব আহামেদ ওরফে মিলন কাজী, মো. আনোয়ার হোসেন কাঞ্চন, মো. বেলায়েত হোসেন মানিক, মো. হাবিবুল হক খোকন, সাজেদুল হক চুন্নু, আবদুল হাই মোড়ল, মো. নাসির উদ্দিন জমাদার, তসলিম আহমেদ হাওলাদার, আব্দুল হাই হাওলাদার, এফ এম জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ বজলুর রশিদ, মজিবর রহমান হাওলাদার, এস এম হারুন-উর-রশিদ, কাজী মফিজুল ইসলাম ওরফে কামাল কাজী, কাজী আলী হোসেন, শহীদুল ইসলাম তালুকদার রাজা, মো. মোনাচ্ছেফ শরীফ, আবুল বাশার চৌধুরী, মো. হারুন-অর-রশিদ (কেন্দুয়া), গৌরাঙ্গ চন্দ্র বিশ্বাস, নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মো. আতিয়ার রহমান খান, আব্দুস ছালাম হাওলাদার, আচমত আলী বয়াতি, আমির হোসেন চৌধুরী, আব্দুর রব বেপারী, আব্দুল গফুর খান, মো. সেকান্দার আলী চৌধুরী, টি এম শহীদুল্লাহ রাজা, ডা. কাঞ্চন, সেলিম, কাজী আতিয়ার রহমান, ওয়াজেদ আলী খান, মনির হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসাইন ফকির, মো. শাহজাহান, বদিউজ্জামান বাদল, আশরাফ হোসেন হাওলাদার, আব্দুল মান্নান হাওলাদার, আব্দুস সালাম, মো. লুৎফর রহমান, আব্দুর রহমান হাওলাদার, মুজাম্মেল হক মুজাম, লোকমান হোসেন শরীফ, মতিয়ার রহমান মাতুব্বর, আব্দুল জলিল বেপারী, আলমগীর হোসেন ওরফে তোতা জমাদার, আব্দুল করিম হাওলাদার, সাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া খোকন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল জলিল মাতুব্বর, চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, হারুন হাওলাদার, জিয়াইল আলম বাদল, মো. জহিরুল হক বিশু, মো. খন্দকার ওয়াহিদ, কাজী আব্দুল হক, মো. আবু বকর সিদ্দিক, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাবুল, আব্দুল হান্নান হাওলাদার, মো. শহিদুল আলম সোহরাব, সৈয়দ আফজাল হোসেন দবির, অনীল চন্দ্র দাস, শ্যামল কুমার কর্মকার, মো. সাইদুর রহমান মন্নু, মো. মনিরুজ্জামান মনি, মো. আক্তার হোসেন হাওলাদার, মো. জামাল ভূঁইয়া ও মো. শাহজাহান মনি। এ দলটি ২৩শে এপ্রিল ত্রিপুরা রাজ্যের বেলুনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। প্রথমে আগরতলার কাঁঠালিয়া ক্যাম্পে ৭ দিন প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আসামের অম্পিনগর ক্যাম্পে তাদের স্থানান্তর করা হয়। এখানে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে ২৮শে মে খলিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি সশস্ত্র দল সর্বপ্রথম মাদারীপুরে প্রবেশ করে। এ দলের দুজন মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান ও বদিউজ্জামান বাদলকে মাদারীপুর পৌর এলাকার কুলপদ্দী বাজার থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কুখ্যাত গোলাপ খাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন গ্রেনেড ও স্টেনগানসহ আটক করে মাদারীপুর থানায় সোপর্দ করে। এ দুজন সদস্য ধরা পড়ায় অন্য সদস্যরা পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে খলিলুর রহমান দ্বিতীয়বার ভারতে যান এবং তসলিম হাওলাদারের নেতৃত্বাধীন ২০ জনের একটি দল নিয়ে জুলাই মাসে মাদারীপুর ফিরে আসেন। কেন্দুয়া-বাজিতপুর বিলে স্থাপিত তাঁদের ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় একত্রিত হন। তাঁরা এবং জুন-জুলাই মাসে ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বিবেচনা ও রণকৌশলগত কারণে বারবার অবস্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকতে হয়। জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ও অস্ত্রবল বৃদ্ধি পেলে বিলাঞ্চলের ক্যাম্প গুটিয়ে মাদারীপুর সদর থানার কমলাপুর, কলাগাছিয়া, বাহাদুরপুর, শিরখাড়া, খোয়াজপুর ও দুধখালি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
মাদারীপুর সদর থানা কমান্ডার খলিলুর রহমান খান জুলাই মাসে উন্নত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তৃতীয়বার ভারতে যান। ভারত থেকে তাঁর ফিরতে বিলম্ব হলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে যে, খলিলুর রহমান ভারতে যাবার পথে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছেন। এ সংবাদ শুনে তাঁর সহযোদ্ধারা মর্মাহত হন এবং তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মাদারীপুরের ১নং এরিয়া কমান্ডের ‘খলিল বাহিনী’ নামকরণ করেন। অবশ্য এর কিছুদিন পর ১৫ই আগস্ট খলিলুর রহমান খান প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ভারত থেকে ফিরে আসেন। খলিলুর রহমান খান একজন সাহসী ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর সাহস ও বীরত্বের কারণে মানুষ তাঁকে ‘মেজর খলিল’ নামে ডাকত। তখন শত্রুসেনাদের কাছে এক ভীতিকর নাম ছিল ‘মেজর খলিল’। খলিল বাহিনীর অস্ত্র ও জনবল বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁরা ঘটকচর ব্রিজ, সিদ্দিকখোলা ব্রিজ, সমাদ্দার ব্রিজ, আমগ্রাম ব্রিজ-সহ বিভিন্ন ব্রিজে টহলরত রাজাকারদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে হতাহত করা, হাতিয়ার ছিনিয়ে নেয়া এবং পাকসেনাদের কনভয়ের ওপর বড় ধরনের গেরিলা হামলা পরিচালনা করেন। এক পর্যায়ে এ বাহিনীর পক্ষ থেকে মাদারীপুর শহরের এ আর হাওলাদার জুট মিলসে স্থাপিত পাকিস্তানি বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সের ওপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে এ বাহিনী যেসব যুদ্ধ ও অপারেশন পরিচালনা করে, তা হলো- মাদারীপুর শহরের ইটের পুলের বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস অভিযান ও শান্তি কমিটির সদস্য রহমত দর্জির ওপর আক্রমণ (১০ই জুন), মাদারীপুর- টেকেরহাট রাস্তায় উকিলবাড়ি ব্রিজ হামলা (১৪ই আগস্ট), চরমুগরিয়া পাটের গুদাম অপারেশন (১৭ই জুন ও ২০শে আগস্ট), এ আর হাওলাদার জুট মিলস পাকক্যাম্প অপারেশন (২০শে আগস্ট), চোকদার ব্রিজ অপারেশন (৩০শে সেপ্টেম্বর), ৯নং ব্রিজে মাইন বিস্ফোরণ (১০ই সেপ্টেম্বর), ঝিকরহাটি-তাঁতিবাড়িতে মাইন বিস্ফোরণ (এখানে ৬ই সেপ্টেম্বর খলিলুর রহমান খান আহত হন), ঘটকচর হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ (১লা নভেম্বর), কমলাপুর ও কলাগাছিয়া যুদ্ধ (২রা নভেম্বর), কলাবাড়ি ব্রিজ যুদ্ধ (২৬শে অক্টোবর), কলাবাড়ির ১ম যুদ্ধ (২৮শে নভেম্বর), কলাবাড়ির ২য় যুদ্ধ (৬ই ডিসেম্বর) ও সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধ (৮- ১০ ডিসেম্বর)। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড