বীর বিক্রম খন্দকার নাজমুল হুদা
খন্দকার নাজমুল হুদা, বীর বিক্রম (১৯৩৮-১৯৭৫) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৩৮ সালের ৬ই জুলাই তাঁর পিতার কর্মস্থল কিশোরগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতার নাম বদরুন নেছা খাতুন। নাজমুল হুদার স্কুল জীবন শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলা স্কুলে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে বি এম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে তিনি কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে কমিশন প্রাপ্ত হন।
১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি নাজমুল হুদা ক্যাপ্টেন পদে শিয়ালকোটের উগোকি সেনা ব্যারাকে কর্মরত ছিলেন। এ বছরই সেখান থেকে তাঁকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য যে, এ মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ছিলেন এক নম্বর আসামি এবং তিনি ছিলেন ২৭ নম্বর আসামি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর পর বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামির সঙ্গে তিনিও বেকসুর খালাস পান। তবে তাঁকে সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নাজমুল হুদা কুষ্টিয়ায় নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ২৫শে মার্চ রাতে -অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি এর প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে কয়েকদিন পর ঢাকার পথে রওনা হন। কিন্তু আরিচা পর্যন্ত এসে তিনি বাধার সম্মুখীন হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে তিনি মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীতে সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাব-সেক্টরে তিনি অসংখ্য যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। সে-সবের মধ্যে ২৭শে মে ঝিকরগাছার কাশীপুর, ১৭ই জুলাই রঘুনাথপুর ও গদাধরপুর, ১৯শে জুলাই ছুটিপুর, ২১শে জুলাই আটলিয়া ও ছুটিপুর, ২২শে জুলাই কাবিলপুর, ৫ই আগস্ট বরণী, ৯ই আগস্ট গোলাহাটি ও ছুটিপুর, ১৫ই আগস্ট ছুটিপুর, ১৭ই আগস্ট শারাতলা ও ছুটিপুর এবং ৫ই সেপ্টেম্বর মধুপুরের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
২৭শে মে ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য ঝিকরগাছার কাশীপুরের দিকে অগ্রসর হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী-র নির্দেশে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে পাঠান। মুক্তিযোদ্ধাদের দল কাশীপুরে পৌঁছামাত্র পাকসেনাদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের তীব্রতা অনুমান করে ক্যাপ্টেন হুদা ও শিকারপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম- শত্রুসেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালান। উল্লেখ্য, এ-যুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এর ফলে পাকবাহিনী সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়। সুবেদার মনিরুজ্জামান এ-যুদ্ধে শহীদ হন। কাশীপুর যুদ্ধ-এ ৬০ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে আরো একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন হলো বরণি পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ। ৫ই আগস্ট তিনি দু-কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এ ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ১৫ জন সৈন্যের লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। এ ঘাঁটি থেকে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার দল অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের আয়ত্তে নিতে যখন ব্যস্ত, ঠিক তখনই পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করে পেছন দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করে। দু-পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে নাজমুল হুদা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও তাঁর ৪ জন সহযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার খন্দকার নাজমুল হুদাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৭৬, খেতাবের সনদ নং ১)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে নাজমুল হুদাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৪ সালে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন। এ বছরই কুমিল্লা সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার থাকা অবস্থায় তিনি এখানে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম কমান্ড্যান্টের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। ব্যক্তিজীবনে নাজমুল হুদা এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নিলুফার দিল আফরোজ বানু। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড