মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুন
ক্র্যাক প্লাটুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত দল। কিংবদন্তিতে পরিণত মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি করে। একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল হিসেবে ক্র্যাক প্লাটুন ২নং সেক্টরের অধীনে ছিল। এ দলটি গঠনে প্রধান দায়িত্ব পালন করেন ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম – এবং এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম। ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মেশিনগান, এসএমজি-সহ প্রায় সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে এ দলের সদস্যরা পারদর্শী ছিলেন। নিখুঁতভাবে গ্রেনেড নিক্ষেপের পর তাঁদের আত্মগোপনের কৌশল অসাধারণ পারদর্শিতার প্রমাণ দেয়। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল ‘হিট এন্ড রান’। পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ দলটিকে আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ারের জন্য নিখুঁতভাবে গড়ে তোলা হয়। তাঁদের কাজ ছিল ৫-৬ জনের একটি গ্রুপ তৈরি করে হঠাৎ আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে কোণঠাসা করে দেয়া এবং আক্রমণ শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করা।
প্রশিক্ষণ শেষে এ দলটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে ৯ই জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সফল অপারেশন পরিচালনা করে। এদিন সন্ধ্যায় সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বিবিসি-র এক সাক্ষাৎকারে এ হিটম্যানদের নাম দেন ‘ক্র্যাক পিপল’। এ থেকে ক্র্যাক পিপলের এ দলটির নাম হয় ক্র্যাক প্লাটুন। এ দলের সদস্যবৃন্দ হলেন- হাবিবুল আলম, শাফী ইমাম রুমী, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ইশতিয়াক আজিজ উলফত, আবুল আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, পপ সম্রাট আজম খান, আমিনুল ইসলাম মধু, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, কাজী কামাল উদ্দিন আহমেদ, কামরুল হক স্বপন, গোলাম দস্তগীর গাজী, মাসুম সাদেক, চুন্নু, জহিরউদ্দিন জালাল, জহিরুল ইসলাম, মনু, লিনু বিল্লাহ, লুলু, ফতেহ চৌধুরী, বদিউজ্জামান, বদিউল আলম বদি, মতিন-১, মতিন-২, মাগফর আহমেদ চৌধুরী আজাদ, বজলুল মাহমুদ, মাহবুব, মাযহার, মনসুরুল আলম দুলাল, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শহীদুল্লাহ খান বাদল, শাহাদত চৌধুরী, বদিউজ্জামান, আবদুস সামাদ, আলী আহমেদ জিয়া উদ্দিন, শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, আবুল বারক আলভী, আবদুস সামাদ, হিউবার্ট রোজারিও, হ্যারিস, মোহাম্মদ আবু বকর, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আবদুল্লাহ-হেল-বাকী, সেকেন্দার হায়াৎ, আবু সায়ীদ খান, তারেক এম আর চৌধুরী, কুলি সরদার কুলু রশীদ প্রমুখ।
৯ই জুন থেকে শুরু করে ৮২টি সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দেয় ক্র্যাক প্লাটুন। সেসবের মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন (৯ই জুন ও ১১ই আগস্ট), ফার্মগেট চেক পয়েন্ট অপারেশন (৭ই আগস্ট), যাত্রাবাড়ি পাওয়ার স্টেশন অপারশেন, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন, উলন পাওয়ার স্টেশন অপারেশন, ফ্লায়িং ফ্লাগস অপারেশন, অ্যাটাক অন দ্য মুভ অপারেশন, দাউদ পেট্রোল পাম্প অপারেশন, গ্যমিজ পেট্রোল পাম্প অপারেশন, এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন অপারেশন উল্লেখযোগ্য।
৯ই জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাকিস্তান সরকারের আহ্বানে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিন হাবিবুল আলমের নেতৃত্বে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, কামরুল হক স্বপন প্রমুখ দেয়াল টপকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রবেশ করে পরপর ৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন।
৯ই জুনের অপারেশনের পর পাকিস্তানি সরকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করে। এ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে গেরিলা যোদ্ধা আবদুস সামাদের নেতৃত্বে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গোলাম দস্তগীর গাজী, মোহাম্মদ আবু বকর ১১ই আগস্ট ২য় বার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এর ফলে ঢাকায় পাকবাহিনীসহ বিদেশী দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, সাংবাদিক কেউ যে নিরাপদ নয়, তা বহির্বিশ্বে গুরুত্ব সহকারে প্রচার পায়। ৭ই আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য বদিউল আলম বদি, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, স্বপন, পুলু ও আবদুস সামাদ ফার্মগেটে হানাদার বাহিনীর চেক পয়েন্টে অপারেশন চালান। এক মিনিটের এ অপারেশনে ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং ৬ জন রাজাকার- আহত হয়।
১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার আকাশে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা গ্যাস বেলুনের সাহায্যে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। হানাদার বাহিনীর সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পতাকা লক্ষ করে গুলি করা শুরু করে।
ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য হাবিবুল আলম, কাজী কামাল উদ্দিন, বদিউল আলম বদি, আবদুল হালিম জুয়েল ও শাফী ইমাম রুমী, কামরুল হক স্বপনকে নিয়ে গঠিত একটি টিম ২৫শে আগস্ট ধানমন্ডিতে অপারেশন চালায়। ধানমন্ডির ১৮নং রোডের এ অপারেশনে ৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এরপরই টিমের সদস্যরা নিউ মার্কেট এলাকায় হানাদার বাহিনীর চেক পয়েন্টে অপারেশন চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করেন। টিমের সদস্যদের গাড়িটি হানাদারদের একটি গাড়ি অনুসরণ করলে শাফী ইমাম রুমীর গুলিতে হানাদার বাহিনীর জিপের ড্রাইভারসহ কয়েকজন নিহত হয়।
১১ই আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ২য় বার হামলার পর দিশেহারা হানাদার বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যদের ধরতে চিরুনি অভিযান চালাতে থাকে। ২৯শে আগস্ট হানাদার বাহিনীর হাতে প্রথম ধরা পড়েন আবদুস সামাদ। এরপর তারা আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল এবং ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিনের বাসা থেকে বদিউল আলম বদিকে ধরে নিয়ে যায়। ৩০শে আগস্ট ধরা পড়েন সুরকার আলতাফ মাহমুদ, কনিষ্ঠ সদস্য আবু বকর, মাগফর আহমেদ চৌধুরী আজাদ, শাফী ইমাম রুমী ও বেহালাবাদক হাফিজ। হানাদার বাহিনী ধৃতদের নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের একটি কক্ষে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অত্যাচারে ৩১শে আগস্ট শহীদ হন বেহালাবাদক হাফিজ। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনের শিকার একমাত্র গেরিলাযোদ্ধা মনু পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন। ৩১শে আগস্টের পর বাকিরা সকলেই হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
অভিজ্ঞ সদস্যদের হারিয়ে আগস্টের শেষদিকে ক্র্যাক প্লাটুন দুর্বল হয়ে পড়লেও সেপ্টেম্বর মাসেই তাঁদের আরেকটি গ্রুপ ভারত থেকে চলে আসে। তাঁদের অতর্কিত আক্রমণে হানাদার বাহিনী ধরাশায়ী হয় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
১৯শে অক্টোবর ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী গেরিলারা ঢাকার মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকায় দিন-দুপুরে এক অপারেশন পরিচালনা করেন। তাঁদের বোমার বিস্ফোরণে ৫ জন মানুষ ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং কুণ্ডলি পাকিয়ে এলাকা ধোঁয়াছন্ন হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, কাজী কামাল উদ্দিন, কামরুল হক স্বপন ও বদিউল আলম বদিকে ‘বীর বিক্রম’ এবং আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, গোলাম দস্তগীর গাজী ও হাবিবুল আলমকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
ক্র্যাক প্লাটুনের বীরত্বগাথা নিয়ে অসংখ্য পুস্তক রচিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে নাটক ও চলচিত্র। বিশেষ করে গেরিলা যোদ্ধা বদিউল আলম বদিকে কেন্দ্র করে কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ ছায়াছবিটি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া গেরিলা যুদ্ধের সত্য কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ছায়াছবি ‘দীপ নেভার আগে’। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড