মুক্তিযুদ্ধে কেরানীগঞ্জ উপজেলা (ঢাকা)
কেরানীগঞ্জ উপজেলা (ঢাকা) ঢাকা শহরের অতি নিকটে বুড়িগঙ্গার পাড়ে অবস্থিত। এর উত্তর ও পূর্বে বুড়িগঙ্গা এবং দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী। তিনদিক নদীবেষ্টিত এবং রাজধানী ঢাকা অতি নিকটে হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গোপন ঘাঁটি হিসেবে এ উপজেলাকে বেছে নেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে কালিকান্দি ইউনিয়নের নেকরোজবাগে তাঁদের আস্তানা গড়ে তোলেন। যেসব নেতা ঢাকা শহর থেকে এসে এখানে অবস্থান নেন, তাঁদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং এডভোকেট কামরুল ইসলামের নাম উল্লেখযোগ্য। এখানে বসে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিভিন্ন কর্মকৌশল নির্ধারণ করতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং শরণার্থীদের জন্য প্রাথমিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। কিছুদিনের মধ্যে এঁদের প্রায় সকলে ভারতে চলে যান। কেরানীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন মোস্তফা মহসিন মন্টু। তাঁর সহযোগী ছিলেন আব্দুর রহিম (কালিন্দি), একরাম হোসেন (জিঞ্জিরা), রাশেদ মাস্টার (রামের কান্দা), মীরজাহান, হাবিলদার রফিক, আনোয়ার হোসেন (জৈনপুর), আমানুল্লাহ খান (হযরতপুর) প্রমুখ। কেরানীগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আমানুল্লাহ খান। এঁদের নেতৃত্বে নেকরোজবাগের আস্তানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের বিভিন্ন কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
নেকরোজবাগের আস্তানায় ৩রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত হাবিলদার রফিকের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারপর আরো নয়টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সেগুলো হলো— তালেপুর (কলাতিয়া ইউনিয়ন), রুহিতপুর (আব্দুল চেয়ারম্যানের
বাড়ি), রামের কান্দা (রাশেদ মাস্টারের বাড়ি), মোহনপুর, নয়াগাঁও (নাসিরের বাড়ি), জৈনপুর (আনোয়ার হোসেনের বাড়ি), ভাওয়াল (আটি), চন্ডিপুর, আহাদিপুর (আমানুল্লাহ খানের বাড়ি) এবং অগ্রখোলা (লালমিয়ার বাড়ি)। কেরানীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন আব্দুর রহিম (কালিন্দি)। তাঁর সহযোগী কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন, রাশেদ মাস্টার (রুহিতপুর), একরাম হোসেন (জিঞ্জিরা), নাসির উদ্দিন আহম্মেদ (নয়াগাঁও, কলাতিয়া) আব্দুল হাই, আব্দুল চেয়ারম্যান, মীরজাহান, শাহজাহান মিয়া, আব্দুল জব্বার (শুভাঢ্যা), নুরু মিয়া (শুভাঢ্যা), হীরালাল (বাস্তা), মোজাহার উদ্দিন, ওসমান গণি (হযরতপুর) প্রমুখ। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর-পরই মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কেরানীগঞ্জ থানা আক্রমণ এবং থানা দখল করে পুলিশফাঁড়ির সকল অস্ত্র হস্তগত করেন। ঐ রাতেই তাঁরা থানা থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরুর পর ঢাকা ছেড়ে অনেকেই নদী পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নেকরোজবাগ আস্তানার খবর এবং অসংখ্য বাঙালির কেরানীগঞ্জে আশ্রয়ের খবর পেয়ে ২রা এপ্রিল এখানে আক্রমণ করে এবং কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর সঙ্গে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করলে পাকবাহিনী কেরানীগঞ্জ দখল করে নেয়। এরপর তারা নির্বিচার গণহত্যা চালায়, যাতে বহুসংখ্যক মানুষ শহীদ হয়। এটি জিঞ্জিরা গণহত্যা নামে পরিচিত। হানাদার বাহিনী পি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (জিঞ্জিরা), পারগেন্ডারিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় (কালিগঞ্জ), কালিগঞ্জ হাইস্কুল এবং মোমিন মোটর গ্যারেজ (মরিচা)-এ ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কেরানীগঞ্জের স্থানীয় কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে রাজাকার- কিংবা আলবদর- বাহিনী কিংবা শান্তি কমিটি-তে সম্পৃক্ত ছিল না। তবে মুসলিম লীগ-এর কিছু নেতা-কর্মী কেরানীগঞ্জের বাইরে থেকে এসে রাজাকার- আলবদর বাহিনীতে সক্রিয় ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তারা নিহত হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধারা এখানে কতিপয় ব্যক্তিকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাজিয়ে রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তারা শান্তি কমিটির পক্ষের ছিলেন না। তাদের কাজ ছিল পাকবাহিনীর গোপন তথ্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট সরবরাহ করা। এমনকি পাকসেনাদের নিকট থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ লুট করার ক্ষেত্রে তারা নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এদের নিয়োজিত করার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে কেরানীগঞ্জসহ ঢাকা জেলার (বর্তমান গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ বৃহত্তর ঢাকা) অন্যতম নেতৃত্বদানকারী মোস্তফা মহসিন মন্টু (স্বাধীনতা- পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য)।
২৫শে নভেম্বর পাকবাহিনী তারানগর ইউনিয়নের মনহরিয়া গ্রামে গুলি ও অগ্নিসংযোগ করে একই পরিবারের ১১ জন হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের ১৯ জন সদস্যকে হত্যা করে। একইদিন তারা এ ইউনিয়নের ঘাটারচর, কাঠালতলী, সিয়াইল ও বাংলানগরে ৫২ জন এবং চণ্ডিপুরে ৯ জনকে হত্যা করে। এসব হত্যাকাণ্ড তারানগর গণহত্যা- নামে পরিচিত। পি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিঞ্জিরা ইউনিয়নের মনুমিয়ার ঢালে একটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু লোককে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। স্থানটি মনুমিয়ার ঢাল বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত। এছাড়া তারানগর ইউনিয়নের ঘাটারচরে গণকবর রয়েছে।
২৬শে নভেম্বর রোহিতপুরের সোনাকান্দায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়, যা সোনাকান্দা যুদ্ধ- নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ওমর আলী (নবাবগঞ্জ থানা) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এ-যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় পাকবাহিনী ঘাটারচর (তারানগর), কাঠালতলী, সিয়াইল, বাংলানগর, চন্ডিপুর, ম্যাকাইল (সাক্তা), রুহিতপুর, বাগৈর আলিয়াপাড়া (তেঘরিয়া ইউনিয়ন), পূর্বদী, ভাওয়াল, মনহরিয়া প্রভৃতি এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। ১৬শে ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর পি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প আক্রমণ করে দখল করে নেন। এদিন ৩২ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। এর মধ্য দিয়েই কেরানীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কেরানীগঞ্জ উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন— আব্দুস সালাম (পিতা হাসান মোল্যা, ফতেনগর), শাহজাহান (পিতা আব্দুল আউয়াল, আলীনগর), কাজী নাজিম উদ্দিন (পিতা কাজী রমিজ উদ্দিন, কাজীকান্দি), নাছির উদ্দিন (পিতা আব্দুল লতিফ, আলীনগর), আব্দুল কাদের (পিতা বাদশা মিয়া, ঢালিকান্দি), নজরুল ইসলাম (পিতা আব্দুর রফিক, আলীনগর), হারুন অর রশীদ মিন্টু (পিতা হোসেন মিয়া, সৈয়দপুর), শাহাদাৎ হোসেন (পিতা কানু মিয়া, রাধাকান্তপুর), আবুল হোসেন (পিতা হাসেম আলী, রাধাকান্তপুর), আহসান (পিতা গোলাম আলী, মানিকনগর), রমজান আলী (পিতা মৌলভি গাফ্ফার, হিজলা), এ এফ এম সাহাব উদ্দিন (পিতা শাহজাহান, নাজিরপুর), মহিবুল রহমান (পিতা দলিল বক্স, চুনকুটিয়া), আ. কাদের (পিতা সিরাজ উদ্দিন, নতুন বাক্তারচর), নাজমুল হাসান (পিতা ছাদেক আলী, জিঞ্জিরা, হাজীবাড়ী), নাজমুল হোসেন (পিতা মালেক নূর, জিঞ্জিরা, হুক্কাপট্টি), ইকবাল হোসেন (পিতা হাসমত আলী, জিঞ্জিরা, হুক্কাপট্টি), ফুয়াদ হাসান (পিতা ছাদেক আলী, জিঞ্জিরা, হুক্কাপট্টি), ইউসুফ আলী (পিতা আর্শেদ আলী, ধর্মশুর, রুহিতপুর), কাজী আউলাদ হোসেন (পিতা মোজাফ্ফর কাজী, সৈয়দপুর, কলাতিয়া), মন্টু সাহা (পিতা দুর্গা সাহা, হাটখোলা, তেঘরিয়া) এবং দিগেন্দ্র মণ্ডল (পিতা যোগদ্ৰ মণ্ডল, হাটখোলা, তেঘরিয়া)।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপর ১৭ জন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে এনে হত্যা করে নাজিরপুর লেকের দক্ষিণ পাড়ে মাটি চাপা দেয়। স্থানটি তখন থেকে রাজাকার ভিটা নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত।
জিঞ্জিরা ইউনিয়নের মনুমিয়ার ঢাল বধ্যভূমি ও গণকবরে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া তারানগর গণহত্যায় যারা শিকার তাদের মধ্যে ৫২ জন শহীদদের নামসহ ঘাটারচরে একটি, ভাওয়াল মনোহরিয়ায় ১৯ জন শহীদদের নামসহ একটি এবং কলাতিয়া স্কুল মাঠে ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে অপর একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। [মো. শাহেদ আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড