You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কেন্দুয়া উপজেলা (নেত্রকোনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কেন্দুয়া উপজেলা (নেত্রকোনা)

কেন্দুয়া উপজেলা (নেত্রকোনা) ১৯৭০ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া-মদন-খালিয়াজুড়ি-আটপাড়া থানার অর্ধেকাংশ নিয়ে গঠিত আসন থেকে আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী এডভোকেট এম জুবেদ আলী এমএনএ এবং হাদিস উদ্দিন চৌধুরী এমপিএ নির্বাচিত হন। সারাদেশে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে নির্বাচিত হলেও শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাতে ক্ষমতা হস্থান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে থাকে। এসবের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের মতো কেন্দুয়ার মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়। তখন কেন্দুয়া থানার প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিবাদ-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। থানার সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সে-সময় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কেন্দুয়ায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাদিস উদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার সৈয়দ আব্দুল খালেক সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এম জাবেদ আলী এমএনএ, হাদিছ উদ্দিন চৌধুরী এমপিএ, ডা. সৈয়দ আব্দুল খালেক, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস ছাত্তার চৌধুরী (রেনু চৌধুরী), কেন্দুয়া থানা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি তমজিদ উদ্দিন ভূঞা (রামচন্দ্রপুর) ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম ভূঞা (ওয়ারেশপুর) কেন্দুয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
মার্চ মাসে কেন্দুয়া থানা আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জয়হরি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। এ সভায় আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা সৈয়দ আব্দুস সুলতান প্রধান অতিথি ছিলেন। সভায় থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম থেকে হাজার-হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি ও অন্যান্য দেশী অস্ত্র। জনসভা চলাকালে পুরো এলাকা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সভা শেষে বিশাল মিছিল সমগ্র কেন্দুয়া থানা সদর প্রদক্ষিণ করে।
কেন্দুয়া থানা সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ ও সহযোগিতায় স্থানীয় যুবক ও ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে জয়হরি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ নেতা গগডা গ্রামের আব্দুস ছাত্তার চৌধুরী, ছিলিমপুর গ্রামের সেনাবাহিনীর সদস্য জালাল উদ্দিন প্রতিদিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই প্রশিক্ষণে তমজিদ ভূঞা, আবুল হাসেম ভূঞা, সন্তোষ সরকার, হাফিজুর রহমান, আলতাবুর রহমান খন্দকার, আব্দুল কদ্দুছ খন্দকার (লালচান), শামছুদ্দিন আহম্মদ-সহ ছাত্রলীগের বহু কর্মী ও নেতা অংশগ্রহণ করেন।
এপ্রিল থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য এম জুবেদ আলী এমএনএ, হাদিছ উদ্দিন চৌধুরী এমপিএ ও সৈয়দ আব্দুল খালেক নিজ-নিজ এলাকা থেকে যুবকদের ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলা ও বাঘমারায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠাতে শুরু করেন। ভারতের মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ মহকুমার আওয়ামী লীগ, ন্যাপ- ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁদের কর্মীদের দলীয়ভাবে রিক্রুটিং শুরু করেন। তাছাড়া, মুজিব বাহিনীর নামে পৃথকভাবে রিক্রুটিং শুরু হয়। কোম্পানি কমান্ডার ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে বলাইশিমুল ইউনিয়নের বাউশারী গ্রামের আব্দুল বারেকের বাড়িতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। এখানে কোম্পানি টুআইসি আব্দুল কাদিরকে প্রশিক্ষণ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
আব্দুল বারেকের বাড়ির নিকটবর্তী শিবপুরের জংলাকে নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ও প্রশিক্ষণ চলে। কেন্দুয়া উপজেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধা বিশরপাশা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এটি ছিল বাংলাদেশের ভেতরে একটি মুক্তাঞ্চল। কেন্দুয়ায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কেন্দুয়া থানা ছাত্রলীগের সভাপতি তমজিদ উদ্দিন ভূঞা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেম ভূঞার নেতৃত্বে সন্তোষ সরকার, হাফিজুর রহমান, আবু হারেছ সরকার, আলতাবুর রহমান খন্দকার, আব্দুল কদ্দুছ খন্দকার (লালচান), শামছুদ্দিন আহম্মদ, আব্দুস ছাত্তার, গোপাল চন্দ্র পোদ্দার, আশরাফুল ইসলাম মুকুল-সহ আরো অনেক স্থানীয় যুবক তিন ধাপে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথম ধাপে কেন্দুয়া আঠারবাড়ি সড়কের সান্দিকোনা ইউনিয়নের ভঙ্গানীয়ার কাঠের ব্রিজের পাটাতন তুলে ফেলা ও ব্রিজের পূর্বদিকে রাস্তায় একটি বড় গর্ত করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে কেন্দুয়া-আঠারবাড়ী সড়কের মাস্কা ইউনিয়নের রায়পুর ব্রিজের কাঠের পাটাতন তোলা ও রাস্তায় বিশাল এক গর্ত করা হয়। তৃতীয় দফায় কেন্দুয়া-নেত্রকোনা সড়কের টেঙ্গুরী ব্রিজ ও কেন্দুয়া-মদন সড়কের খাদ্য গুদামের পেছনে আঠারবাড়ী ব্রিজের কাঠের পাটাতন তুলে গর্ত করা হয়। এসব প্রতিরোধ ব্যবস্থার ফলে পাকবাহিনীর কেন্দুয়া দখল বিলম্বিত হয়।
কিন্তু এসব প্রতিরোধ ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
পাকবাহিনী ২১শে আগস্ট কেন্দুয়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। থানার ডাকবাংলো দখল করে পাকবাহিনী তাতে অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা করে। কেন্দুয়ায় তখন স্বাধীনতাবিরোধী মসুলিম লীগ-এর কার্যক্রম ছিল। এ দলের নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মানুষের ওপর নানারকম নির্যাতন চালায়। নান্দাইল থানার মেরেঙ্গার নিবাসী ও কেন্দুয়া বাজারের ব্যবসায়ী আতাউর রহমান খান ও কেন্দুয়া থানার বিদ্যাবল্লভের আনসার কমান্ডার হাফিজুর রহমানের সহায়তায় কেন্দুয়ায় রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। তাদের সহায়তা করে কেন্দুয়া থানার ওসি নূরুল ইসলাম। আঞ্জ মিয়া, সাদেক মিয়া, কালা মিয়া, নুরু মাস্টার, বাদল মিয়া, জয়নাল মিয়া, আবদুল ওয়াদুদ, জং বাহাদুর দফাদার প্রমুখ কেন্দুয়া উপজেলার উল্লেখযোগ্য রাজাকার ছিল। কেন্দুয়া থানায় পাকবাহিনীর নির্দেশে প্রতিটি ইউনিয়নে তাদের সকল কাজে সহযোগিতা করে শান্তি কমিটি। শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিল মো. হাফিজুর রহমান তালুকদার।
পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পূর্বেই কেন্দুয়ায় স্বাধীনতবিরোধী কতিপয় নেতার উদ্যোগে প্রতিটি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। এসব কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তৎকালীন সিও (উন্নয়ন) বরাবর জমাদানের নির্দেশ দেয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা সভা করে শান্তি কমিটি গঠন করে এবং প্রতিটি ইউনিয়নের তালিকা সিও (উন্নয়ন) অফিস ও কেন্দুয়া থানায় জমা দেয়। বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটির আহ্বায়করা হলো- গড়াডোবা ইউনিয়নে মো. হাফিজুর রহমান তালুকদার, গন্ডা ইউনিয়নে মো. বাবর আলী আহম্মদ, সান্দিকোনা ইউনিয়নে মো. নূরুল হোসেন মাস্টার, মাস্কা ইউনিয়নে মো. আব্দুছ ছাত্তার ভূঞা, কান্দিউড়া ইউনিয়নে মো. আব্দুছ ছোবাহান ভূঞা, চিরাং ইউনিয়নে মো. আব্দুল জলিল কাজী, রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নে মো. জসীম উদ্দিন আহম্মদ, পাইকুড়া ইউনিয়নে মো. আব্দুর রহমান ভূঞা এবং মোজাফরপুর ইউনিয়নে মো. চমক আলী মাস্টার।
পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় রাজাকার ও দালালরা কেন্দুয়ার বিভিন্ন গ্রামে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাত। কেন্দুয়া থানা সদরের নিকটবর্তী কমলপুর গ্রামের মুজিব বাহিনীর সদস্য আবদুল জব্বার সরকার, আবু হানিছ সরকার ও আবু হারেছ সরকারের বাড়িতে রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে। ২৮শে এপ্রিল পাকসেনা ও রাজাকাররা গোপালাশ্রম ও চিথোলিয়া গ্রামে মোট ১৪ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা গোপালাশ্ৰম-চিথোলিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত রাজাকার কমান্ডার মেরাঙ্গা খাঁ ও স্থানীয় দালালদের সহায়তায় পাকবাহিনী মাস্কা ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের অনেক হিন্দুবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পার্শ্ববর্তী নান্দাইল থানায় অবস্থানরত পাকবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে ১২ই নভেম্বর বাড়লা গ্রামে হামলা চালায়। আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা বাড়লা থেকে সরে গেলে পাকবাহিনী গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাতে থাকে। এ সময় পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। বাড়লা গণহত্যা-য় পাকবাহিনীর গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন মালধর (পিতা আ. কাদির), আবুল হাসেম (পিতা মিঠু মিয়া), আব্দুল খালেক (পিতা শমসের আলী) ও জুলহাস মিয়া (পিতা আনফর আলী)।
কেন্দুয়ার চিরাং ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত গোপালাশ্রম গ্রামে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারের বসতি ছিল। এ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ডাক্তার ধীরেন্দ্র সরকার। পাকহানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় ধীরেন্দ্র সরকারের বাড়িসহ অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাতে থাকলে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণে কালীদাসের মা গুলিবিদ্ধ হন এবং দীনেশচন্দ্র দে নিহত হন। চরকান্দি গ্রামের কয়েকটি মুসলিম পরিবারের লোকজন নৌকা নিয়ে জালিয়ার হাওরের দিকে পালানোর সময় পাকসেনারা তাদের লক্ষ করে গুলি করলে আবদুর রশিদ নামে একজন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। রাশিদা খাতুন ও রূপবানু নামে দুই নারী গুলিবিদ্ধ হন। রাজাকাররা বৌলজান নামে এক গৃহবধূ এবং মেশিদ আলী নামের এক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে চিথোলিয়া গ্রামের পালবাড়ীর আশুতোষ পাল চৌধুরীকে হত্যা করে। তারা সাজিউড়া গ্রামে ৩১শে আগস্ট হামলা চালায়। এ গ্রাম থেকে ডাক্তার শংকর সরকার, ডাক্তার খগেন্দ্র বিশ্বাস, নীহার দে, হরিদাস, আশুতোষ সরকার, সতীশ ঘোষ, যতীন্দ্র নমোদাস, ধনেশ নমোদাস (দুখু)-কে ধরে নিয়ে সাজিউড়া-কেন্দুয়া সড়কের পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এতে ৪ জন নিহত হন, বাকিরা প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনা সাজিউড়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। এ গণহত্যার দিন হরিপদ (দুখু) পাকসেনাদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন।
৫ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে ঘোড়াইল গ্রামের বণিক বাড়ি থেকে রমেশ বণিক, হরেন্দ্র বণিক, অনিল বণিক, ধীরেন্দ্র চক্রবর্তী, বিনোদ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে উপেন্দ্র পোদ্দারকে এবং আদমপুর গ্রামের নন্দ কিশোর দে, রুহিণী বণিক, তার পুত্র জীবন বণিককে ধরে এনে বিনোদ চক্রবর্তীর বাড়ির সামনের এক ডোবার পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এতে ৩ জন নিহত হন।
ঘোড়াইল গণহত্যা-র পর পাকসেনা ও রাজাকাররা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘরের মূল্যবান জিনিসপত্রাদি লুণ্ঠন করে। ভোরে ডোবার পাড়ে মাটি খনন করে নিহতদের গণকবর দেয়া হয়।
২০শে সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী এবং রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত দনাচাপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে দেবেন্দ্র দত্ত, নিখিল দত্ত এবং যোগেন্দ্র পাটুকী সাধুকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর কুখ্যাত রাজাকার নুরু মাস্টারের নৃশংসতা সমগ্র কেন্দুয়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
পাকবাহিনী নেত্রকোনা থেকে কেন্দুয়া হয়ে মদন থানা সদরে যেত। তাদের গোলাবারুদ ও খাদ্য পরিবহণ করার জন্য কেন্দুয়া-মদন সড়ক ছিল একমাত্র রাস্তা। পায়ে হেঁটেও পাকবাহিনী কেন্দুয়া-মদনের পথে যাতায়াত করত। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা তাদের খাদ্য, রসদ, গোলবারুদ পার্শ্ববর্তী গ্রামের ও রাস্তায় চলাচলকারী নিরীহ মানুষদের মাথায় বইয়ে কেন্দুয়া থেকে মদনে নিয়ে যেতে বাধ্য করত। যারা বইতে পারত না, তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাত। কেন্দুয়া থানা হাজতখানা পাকাবাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
কেন্দুয়া থানায় একটি গণকবর ও একটি বধ্যভূমি রয়েছে। ঘোড়াইল গ্রামে পাকবাহিনীর হাতে নিহতদের বিনোদ চক্রবর্তীর বাড়ির সামনের ডোবার পাড়ে মাটিচাপা দেয়া হয়। এ স্থানকে গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেন্দুয়া থানা সদরের নিকটবর্তী রাজী খালের নৌ-ঘাটে পাকহানাদার বাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেককে ধরে এনে হত্যা করে ফেলে রাখত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছড়ানো-ছিটানো কঙ্কালগুলো এখানে মাটিচাপা দেয়া হয়। এ স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত।
১৩ই আগস্ট কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল হক তারার বাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর সদস্যরা কেন্দুয়া থানা আক্রমণ করেন। তখনো পাকবাহিনী কেন্দুয়ায় অনুপ্রবেশ করেনি। মুক্তিযোদ্ধারা থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকার বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করেন। এ আক্রমণে কোম্পানির সেকশন কমান্ডার চকপাড়া গ্রামের হাফিজুর রহমান, কমলপুর গ্রামের শামসুদ্দিন, কাজী হিরু, তফাজ্জল হোসেন, ছিদ্দিকুর রহমান, আবুল কালাম, মতিউর রহমান, আব্দুস সালাম, আ. ছাত্তার, কমলপুর গ্রামের আ. কদ্দুছ খন্দকার, লালচান, কান্দিউড়ার মনজিল মিয়া, দিগদাইরের আলতাবুর রহমান খন্দকার-সহ অনেকে অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয়ভাবে কেন্দুয়া বাজারের সন্তোষ সরকার, গোপাল পোদ্দার, টেঙ্গুরী গ্রামের আব্দুস ছাত্তার, দিগদাইর গ্রামের আবু তাহের ভূঁঞা বকুল প্রমুখ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করেন। থানার পুলিশ ও রাজাকাররা পাল্টা আক্রমণ করে। তবে শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে পুলিশ ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা থানার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে কয়েকটি রাইফেল দখল করেন।
পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত এবং তাদের রসদ চলাচল বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে কোম্পানি কমান্ডার ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী বসুর বাজার পাটকুড়া নদীর পাকা ব্রিজ পাহারায় নিয়োজিত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ই নভেম্বর ভোরে ইলিয়াস কোম্পানির টুআইসি আব্দুল কাদির তাঁর বাহিনী নিয়ে নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জবাবে রাজাকার বাহিনীও গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী লড়াইয়ের ফলে এক পর্যায়ে রাজাকাররা পালাতে থাকে। রাজাকার কমান্ডার হাফিজুর রহমান কিছু সঙ্গী নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ৪ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। আটককৃতদের পরে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারের নির্দেশে ভারতে পাঠানো হয়। এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বসুর বাজার ব্রিজ আক্রমণ ও ৪ জন রাজাকার আটকে আব্দুল কাদির সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ৭ই ডিসেম্বর কেন্দুয়া হানাদারমুক্ত হয়।
কেন্দুয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোখলেছুজ্জামান খান পাঠান (পিতা ওয়াহেদুজ্জামান খান পাঠান, বালিজুড়া, মাস্কা; মদন যুদ্ধে শহীদ; কেন্দুয়া থানার বহুলী গ্রামে সাইডুলি নদীর তীরে সমাহিত), মোখলেছুর রহমান তালুকদার (পিতা মো. মনফর আলী তালুকদার, কচুন্দরা; আটপাড়া থানার দোওজ গ্রামের যুদ্ধে শহীদ; নিজ বাড়ির পুকুর পাড়ে সমাহিত), ফয়জুর রহমান আহম্মেদ (পিতা মৌলভী আজিম উদ্দিন আহম্মেদ, কুতুবপুর, রোয়াইলবাড়ী; ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনকালে পাকবাহিনী তাঁকে হত্যা করে; তিনি কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ-এর পিতা) এবং নায়েক সুবেদার আব্দুর রশিদ (পিতা শেখ আলম, রায়পুর মাস্কা; ইপিআর-এ চাকরিরত অবস্থায় ২৫শে মার্চ ঢাকাস্থ ইপিআর সদর দপ্তরে যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ)।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজ গ্রাম কুতুবপুরে শহীদদের স্মরণে শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। [সন্তোষ সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড