You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কূটনীতিকদের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কূটনীতিকদের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দুটি ফ্রন্ট, অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয়। শুধু অভ্যন্তরীণভাবে লড়াই করে এ-যুদ্ধে সফল হওয়া অসম্ভব বা কঠিন। এজন্য একই সঙ্গে বহিঃফ্রন্টেও তৎপরতা চালাতে হয়। আর এ দায়িত্ব পালন করে একটি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনীতিকবৃন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উভয় ফ্রন্টে পরিচালিত হয়। এ-যুদ্ধে বিজয় অর্জনে মাঠ পর্যায়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের পাশাপাশি দ্বিতীয় ফ্রন্টের যোদ্ধারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ কে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত ৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকার-এর নেতৃত্বে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। কাজের সুবিধার্থে ঐ সরকারের জন্য বেশ কয়েকটি বিভাগ, সংস্থা ও সংগঠন সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কলকাতার সার্কুলার এভিন্যু-তে অবস্থিত ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলীর অফিস ছিল এর কার্যালয়। একজন মন্ত্রী (খন্দকার মোশতাক আহমেদ) ছিলেন এর দায়িত্বে। জনবল ছিল খুবই স্বল্প (মাত্র ১৫ জন)। পররাষ্ট্র বিষয়ের গুরুত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার মোশতাকের মার্কিন ও পাকিস্তানঘেঁষা অপতৎপরতা বিবেচনায় রেখে শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড তদারকি, নির্দেশনা প্রদান এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বৈঠক করতেন। পররাষ্ট্র বিষয়ে সরকারের মন্ত্রিসভা সাধারণ গাইডলাইন প্রণয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। কখনো-কখনো তা রিভিউ হতো।
বিদেশে পাকিস্তানের দূতাবাস ও মিশনসমূহে কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পররাষ্ট্র বিষয়ক তৎপরতা চালানো হয়। কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ না করে কিছু বাঙালি কূটনীতিক বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তথ্য সরবরাহ করে ভূমিকা রাখেন। এছাড়া সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং রাষ্ট্রে কূটনীতিক, জনপ্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। উপরন্তু প্রভাবশালী প্রবাসী বাঙালি ও উচ্চ শিক্ষার্থে যাওয়া বাঙালি শিক্ষক-ছাত্ররাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
দিল্লিস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে দায়িত্বরত দ্বিতীয় সচিব কে এম শেহাবুদ্দিন ও সহকারী প্রেস এটাশি আমজাদুল হক বাঙালি কূটনীতিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম (৬ই এপ্রিল) পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের পরের দিন (১৮ই এপ্রিল) কলকাতা মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী কর্মরত অন্যান্য বাঙালিদের নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও নবগঠিত সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এসবের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হন।
এরপর ২৬শে এপ্রিল নিউইয়র্কে পাকিস্তান দূতাবাসে দায়িত্বরত বাঙালি ভাইস-কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী (২০১৩-২০১৯ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এবং ২৭শে এপ্রিল লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। এমনকি নিউয়র্কে পাকিস্তান কনসাল জেনারেলের অফিসটি বাঙালি ছাত্র ও অন্যান্য বাঙালিরা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাকিস্তানের দূতাবাস ও মিশনসমূহে কর্তব্যরত বাঙালি কুটনীতিকদের ওপর এসব দারুণ প্রভাব ফেলে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার সে-সময় ঘোষণা করে যে, অন্যান্য কূটনীতিকগণ অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের বেতনাদিসহ পূর্ণ নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা প্রদান করা হবে। এর ফলও পাওয়া গিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব বাঙালি কূটনীতিক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, তাঁরা হলেন- কে এম শেহাবুদ্দিন (দ্বিতীয় সচিব, দিল্লি, ৬ই এপ্রিল), আমজাদুল হক (সহকারী প্রেস এটাশি, দিল্লি, ৬ই এপ্রিল), এম হোসেন আলী (ডেপুটি হাইকমিশনার, কলকাতা, ১৮ই এপ্রিল) রফিকুল ইসলাম (প্রথম সচিব, কলকাতা, ১৮ই এপ্রিল), আনওয়ারুল করিম চৌধুরী (তৃতীয় সচিব, কলকাতা, ১৮ই এপ্রিল), কাজী নজরুল ইসলাম (তৃতীয় সচিব, কলকাতা, ১৮ই এপ্রিল), মাকসুদ আলী (তৃতীয় সচিব, কলকাতা, ১৮ই এপ্রিল), সাইদুর রহমান (সুপারিন্টেন্ডেন্ট, কলকাতা, ১৮ই এপ্রিল), এ এইচ মাহমুদ আলী (ভাইস কনসাল, নিউইয়র্ক, ২৬শে এপ্রিল), হাবিবুর রহমান (শিক্ষা অফিসার, লন্ডন, ২৭শে এপ্রিল), আবদুর রাজ্জাক খান (সহকারী শিক্ষা এটাশি, ওয়াশিংটন, ১৭ই মে) আবুল মাল আবদুল মুহিত (অর্থনৈতিক কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন, ৩০শে জুন), মহিউদ্দিন আহমেদ (দ্বিতীয় সচিব, লন্ডন, ১লা আগস্ট), এস আনওয়ারুল করিম (উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক, ৪ঠা আগস্ট), এনায়েত করিম (মিনিস্টার, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), শাহ এ এস এম এস কিবরিয়া (কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), আবু রুশদ মতিন উদ্দিন (শিক্ষা কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), আতাউর রহমান চৌধুরী (তৃতীয় সচিব, হিসাব, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (তৃতীয় সচিব, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), এ এম শরফুল আলম (সহকারী প্রশাসন এটাশি, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), শেখ রুস্তম আলী (সহকারী তথ্য এটাশি, ওয়াশিংটন, ৪ঠা আগস্ট), লুৎফুল মতিন (তৃতীয় সচিব, হিসাব, লন্ডন, ৫ই আগস্ট), আবদুর রউফ (সহকারী তথ্য এটাশি, লন্ডন, ৮ই আগস্ট), ফজলুল হক চৌধুরী (সহকারী শ্রম এটাশি, লন্ডন, ১১ই আগস্ট), মহিউদ্দিন আহমদ (অস্থায়ী ট্রেড কমিশনার, হংকং, ১৮ই আগস্ট), এ এফ এম আবুল ফতেহ (রাষ্ট্রদূত, ইরাক, ২৯শে আগস্ট), খুররম খান পন্নী (রাষ্ট্রদূত, ফিলিপাইন্স, ১৩ই সেপ্টেম্বর), মুহিউদ্দিন আহমদ জায়গীরদার (তৃতীয় সচিব, লেগোস, ১৩ই সেপ্টেম্বর), এম মুস্তাফিজুর রহমান (দ্বিতীয় সচিব, কাঠমন্ডু, ৩রা অক্টোবর), হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী (কাউন্সেলর, দিল্লি, ৪ঠা অক্টোবর), এম রেজাউল করিম (প্রথম সচিব, লন্ডন, ৭ই অক্টোবর), আবদুল মোমিন (রাষ্ট্রদূত, বুয়েন্স আইরেস, ১১ই অক্টোবর), ফজলুল করিম (তৃতীয় সচিব, কায়রো, ২৬শে অক্টোবর), এস এম মাসুদ (তথ্য সচিব, টোকিও, ২রা নভেম্বর), কিউ এ এম এ রহিম (তৃতীয় সচিব, টোকিও, ২রা নভেম্বর), ওয়ালিউর রহমান (দ্বিতীয় সচিব, জেনেভা, ২রা নভেম্বর), সৈয়দ আমিরুল ইসলাম (তৃতীয় সচিব, টিউনিস, ১১ই নভেম্বর) ও আজিজুল হক চৌধুরী (তৃতীয় সচিব, লন্ডন, ৭ই ডিসেম্বর)।
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার যেসব স্থানে দূতাবাস প্রতিষ্ঠা বা প্রতিনিধি নিয়োগদানে সক্ষম হয়,
প্রতিনিধিসহ সেসব হচ্ছে- কলকাতা (এম হোসেন আলী), নয়াদিল্লি (এইচ আর চৌধুরী), লন্ডন (বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী), স্টকহোম (এ রাজ্জাক), নিউইয়র্ক (এস এ করিম), ওয়াশিংটন (এম আর সিদ্দিকী), হংকং (মহিউদ্দিন আহমেদ), ম্যানিলা (খুররম খান পন্নী), কাঠমন্ডু (এ এম মুস্তাফিজুর রহমান), বার্ণ, সুইজারল্যান্ড (ওয়ালিউর রহমান) ও টোকিও (এস এম মাহমুদ)।
পররাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ (পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত), ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ (প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা), ফকির শাহাবুদ্দিন (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রেরিত প্রতিনিধিদলের দলনেতা), শাহ্ মুয়াজ্জেম হোসেন এমপিএ (পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি), শাহ এ এস এম এস কিবরিয়া (কাউন্সেলর, যুক্তরাষ্ট্র), এ এম এ মুহিত (অর্থ উপদেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্র), এনায়েত করিম (মিনিস্টার, যুক্তরাষ্ট্র), এস আনোয়ারুল করিম (উপস্থায়ী প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক), হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী (কাউন্সেলর, দিল্লি), এ রেজাউল করিম (প্রথম সচিব, লন্ডন), এ এইচ মাহমুদ আলী (ভাইস কনসাল, নিউইয়র্ক), এ এফ এম আবুল ফতেহ (রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত) এবং খুররম খান পন্নী (রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত)।
সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (যুক্তরাজ্যসহ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি)-কে দলনেতা করে ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা হয়। এর অন্য সদস্যরা ছিলেন- এম এ সামাদ (সদস্য, জাতীয় পরিষদ, বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা), অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (ন্যাপ সভাপতি ও বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য), ফণিভূষণ মজুমদার (সদস্য, জাতীয় পরিষদ), সিরাজুল হক (সদস্য, জাতীয় পরিষদ), সৈয়দ আবদুস সুলতান (সদস্য, জাতীয় পরিষদ), ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদ (সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ), ড. মফিজ চৌধুরী (সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ), ডা. আসহাবুল হক (সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ), ড. এ আর মল্লিক (উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), অধ্যাপক রেহমান সোবহান (অর্থনীতিবিদ, পূর্ব-ইউরোপীয় দেশসমূহে রাষ্ট্রদূত), এম আর সিদ্দিকী (জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ প্রতিনিধি), খুররম খান পন্নী (দূর-প্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত), এ এফ এম আবুল ফতেহ (রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা), এস এ করিম (উপস্থায়ী প্রতিনিধি, জাতিসংঘ), এ এম এ মুহিত (আমেরিকাস্থ বাংলাদেশ মিশনে কাউন্সেলর), এ এইচ মাহমুদ আলী (আমেরিকাস্থ বাংলাদেশ মিশনের ভাইস কনসাল)।
সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনীতিকদের উদ্দেশে সে-সময় যেসব গাইডলাইন প্রদান করা হয়, তা ছিল নিম্নরূপ-
এক. ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়’ – এ নীতি; দুই. জোট নিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান; তিন. শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী সকল প্রকার সামরিক চুক্তির বিরোধিতা; চার. পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ মীমাংসা; পাঁচ সকল পরাশক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা; মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকার নিন্দা; আমেরিকার জনগণ, কংগ্রেস ও সিনেট সদস্যদের বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি-সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, ছয়. সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাত্মক সমর্থন- সহযোগিতা লাভে খুবই সতর্কতার সঙ্গে প্রয়াস চালানো; সাত. চিনের ব্যাপারে সরকারের ইচ্ছাকৃত নীরবতা অবলম্বন নীতি অব্যাহত রাখা; আট. আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন ও সংহতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকা; নয়. মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে আরব দেশসমূহরে অবস্থান বেদনাদায়ক হলেও প্রকাশ্যে নীরব অবস্থান গ্রহণ ও তা অব্যাহত রাখা এবং বাস্তব সত্যের প্রতি ঐসব দেশের দৃষ্টি – আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া; দশ. আরব-ইসরাইল সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপাতত না জড়ানো; এগার. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহের সমর্থন-সহানুভূতি লাভে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি; বার. মুক্তিযুদ্ধের প্রতি স্পষ্ট সমর্থন জ্ঞাপনকারী পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্কের আরো উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি।
কূটনীতিক তৎপরতার প্রধান বিষয় ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার চিত্র ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা তুলে ধরা, ভারতের শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়া জীবন বিপন্ন বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধদের করুণ অবস্থা ও ডায়েরিয়ায় অগণিত মানুষের মৃত্যু, মানুষ হত্যায় নিয়োজিত পাকিস্তান সরকারকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য না দেয়া বা তা বন্ধ করা, বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচার বন্ধে ইয়াহিয়ার – সামরিক জান্তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। উল্লিখিত তৎপরতার ফলে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশ সংকটের প্রকৃতি ও গভীরতা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, বাংলাদেশের অনুকূলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জনমত সৃষ্টি হয় এবং কোনো-কোনো দেশ (যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন) পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে সে দেশের জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের বাধার সম্মুখীন হয়। এ ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, ফ্রাঙ্ক চার্চ প্রমুখের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যসহ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি, একই সঙ্গে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিচারপতি <আবু সাঈদ চৌধুরী-র নেতৃত্বে লন্ডন পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রচার ও কূটনৈতিক তৎপরতার হেডকোয়ার্টার্স বা প্রধান কেন্দ্রে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে এর সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করেন। জেনেভায় থাকাকালে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন ছাত্র নিহত হওয়ার খবর পেয়ে ১৫ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে সঙ্গে-সঙ্গে তিনি জেনেভা থেকে লন্ডন চলে আসেন এবং ২৭শে মার্চ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর সকল সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন। ২৩শে এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপত্র লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যসহ বিভিন্ন দেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান, পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম-এর সভা চলাকালে প্রবাসী বাঙালিদের বিক্ষোভ আয়োজনসহ পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধে অন্যান্য তৎপরতা, বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপাচার্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ এসোসিয়েশন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সোসালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, বেসরকারী সাহায্য সংস্থা ইত্যাদির এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিক কারণ ও পাকিস্তানিদের গণহত্যাসহ বর্বরতার চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২৪শে জুলাই ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের একটি কক্ষে কয়েকজন খ্যাতিমান ব্রিটিশ এমপির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক টিকেট প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বহুল আলোচিত ঘটনা ছিল। এর পরের মাসে (২৭শে আগস্ট) লন্ডনের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনস-এ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনসহ বাংলাদেশ দূতাবাসের অফিস উদ্বোধন ছিল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক, যা বিশ্বের সর্বত্র সাড়া জাগায়। লন্ডনভিত্তিক তৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস, পিটার শোর, মাইকেল বার্নস, ক্রচ ডগলাস-ম্যান প্রমুখের অকুণ্ঠ সমর্থন- সহযোগিতা লাভ করেন। এঁদের ছাড়াও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থা-র কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনায় নানাভাবে সহায়তা করেন।
একটি স্বাধীন দেশের নিয়মিত সরকারের মতোই মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা, ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে এ ফ্রন্টের অবদান অপরিসীম। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমি ২০১২; Harun-or-Rashid “British perspective, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971,” Contemporary South Asia 1995, 4(2); আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ২০১২

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড