You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.30 | কৃষিভবন যুদ্ধ (চট্টগ্রাম মহানগর) - সংগ্রামের নোটবুক

কৃষিভবন যুদ্ধ (চট্টগ্রাম মহানগর)

কৃষিভবন যুদ্ধ (চট্টগ্রাম মহানগর) সংঘটিত হয় ৩০ ও ৩১শে মার্চ। এতে ৬ জন পাকসেনা নিহত ও অনেক আহত হয় এবং বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
চট্টগ্রাম শহরে প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ শেষ করে ২৬শে মার্চ থেকে ২৯শে মার্চের মধ্যে ৮ম রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আসনার সদস্য নিয়ে সম্মিলিত বাহিনী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর কাছাকাছি কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত কালুরঘাট রেলসেতুর দুপাশে প্রচলিত প্রতিরক্ষা (Conventional Defense) পদ্ধতি অনুসরণ করে অবস্থান গ্রহণ করে। তাঁদের এ অবস্থানকে মূলত একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সেখান থেকে বিভিন্ন প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন।
কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং কালুরঘাট রেলসেতুর উভয় পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান গ্রহণ পাকিস্তানি সেনা শাসকদের বেশ বিচলিত করে তোলে। মুক্তিবাহিনী-র এসব অবস্থানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন (Special Service Group)-এর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের নেতৃত্বে হামজা কমান্ডো প্লাটুনকে নির্দেশ দেয়। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের নেতৃত্বে হামজা প্লাটুন একটি মটর লঞ্চযোগে ২৯শে মার্চ রাতে কর্ণফুলী নদীর তীর ধরে কালুরঘাট রেলসেতুর কাছাকাছি নদীর পূর্বপাড়ে নেমে পায়ে হেঁটে নিকটবর্তী একটি ভবনে অবস্থান গ্রহণ করে। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনীকে সহায়তা করে। এটি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যবহৃত একটি তিনতলা ভবন, যা স্থানীয় জনগণের নিকট ‘কৃষিভবন’ নামে পরিচিত ছিল।
পরের দিন ৩০শে মার্চ আসিফ নামে একজন স্বেচ্ছাসেবী যুবক কালুরঘাটে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কৃষিভবনে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের অবস্থানের কথা জানালে সঙ্গে-সঙ্গে লেফটেন্যান্ট এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম- ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সদস্য সমন্বয়ে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কৃষিভবন আক্রমণ করে শত্রুসৈন্যদের বিতাড়িত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বে ৩০শে মার্চ ভোরবেলা মুক্তিযোদ্ধারা গাড়িতে করে কৃষিভবন আক্রমণের জন্য কিছুদূর অগ্রসর হলে তাঁদের ওপর শত্রুসৈন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিবাহিনী গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার দুপাশে বাড়িঘর ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে অবস্থান নেয়। কিছু সময়ের মধ্যেই লেফটেন্যান্ট মাহফুজ শত্রুদের অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন। তিনি দেখতে পান কালুরঘাট রেলসেতুর পশ্চিমে কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিশন সেক্টরের নিকটবর্তী কৃষিভবন থেকে শত্রুসেনারা গুলিবর্ষণ করছে। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ ও তাঁর প্লাটুন ঐ ভবন থেকে ৫০০ গজ দূরত্বে অবস্থান নেন। ইতোমধ্যে শত্রুসৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হালকা ও ভারী মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে তাঁরা ক্রলিং করে কৃষিভবনের প্রায় ২০০ গজের মধ্যে পৌঁছে যান। কৃষিভবনের কাচের জানালা দিয়ে শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। এরই মধ্যে শত্রুসৈন্যরা মেশিনগানের সঙ্গে রকেট লঞ্চারের ব্যবহারও শুরু করে। উল্লেখ্য, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ২টি জঙ্গি বিমান (স্যাবর জেট, এফ-৮৬) উড়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা একটু পিছিয়ে এসে তাঁরাও শত্রুসেনাদের ওপর রকেট লঞ্চার ব্যবহার শুরু করেন। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধের পরও কোনো পক্ষই উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে না পেরে তারা এদিনের জন্য অক্রমণ বন্ধ রাখে।
দিনের বেলা শত্রুসেনাদের কঠিন বেষ্টনী ভেঙ্গে তাদের পরাস্ত করা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তাদের চতুর্দিক থেকে কৃষিভবনে সারারাত অবরুদ্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, কৃষিভবনের পার্শ্ববর্তী এলাকার বহু বাঙালি অসামরিক সাধারণ লোক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কৃষিভবন অবরুদ্ধ করে রাখে। ৩১শে মার্চ ভোরবেলা লেফটেন্যান্ট মাহফুজ শত্রুসেনাদের অবস্থানের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ করেন। তিনি অত্যন্ত কৌশলে রকেট লঞ্চারের সাহায্যে কৃষিভবনের অংশবিশেষ ভেঙ্গে ফেলেন। এর ফলে শত্রুসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়; তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে-করতে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন। তার আগে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ এবং তার কমান্ডো বাহিনী ৫টি লাশ ও দুজন আহত সৈনিক, বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ ফেলে কৃষিভবন ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন আহত সৈনিক মারা যায়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনো সদস্য বা সাধারণ জনগণের কেউ হতাহত হননি।
মুক্তিবাহিনী কৃষিভবন যুদ্ধের পর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। সেগুলো হলো- চাইনিজ রাইফেল ১টি, চাইনিজ হালকা মেশিনগান ১টি, জি-৩ রাইফেল ২টি, এসএমজি ২টি, স্টেনগান ১টি, রকেট লঞ্চার ৩টি, ওয়ারলেস সেট ১টি, পিস্তল ১টি, বিভিন্ন ধরনের গুলি ২০০০টি এবং প্রচুর পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য। [সাজাহান মিয়া]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয় ১৯৮২; রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, ঢাকা, অনন্যা ১৯৮১; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-১, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা ২০০৬; ডিসপ্লে বোর্ড, বিজয় কেতন জাদুঘর, ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড