You dont have javascript enabled! Please enable it! কুলাঘাট যুদ্ধ (লালমনিরহাট সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

কুলাঘাট যুদ্ধ (লালমনিরহাট সদর)

কুলাঘাট যুদ্ধ (লালমনিরহাট সদর) সংঘটিত হয় আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বেশ কয়েককবার। এ যুদ্ধে পাকসেনারা পিছু হটে কুলাঘাট ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং রত্নাই ব্রিজসহ কুলাঘাট ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের দুরাকুটি বাজারের ১০০-১৫০ গজ দূরত্বে রত্নাই নদীর ওপর একটি ব্রিজ রয়েছে, যা রত্নাই ব্রিজ হিসেবে পরিচিত। ব্রিজ পার হয়ে মোঘলহাট যাওয়া যায়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ ব্রিজের পূর্ব পাড়ের দক্ষিণ শিবেরকুটি গ্রামে অবস্থান নেন। তাঁরা গ্রামের মো. মনিরউদ্দিন, হুরমুজ আলী, মগর দেওয়ানী, আলতাফ মিস্ত্রি ও মো. সাবুল্লাহর বাড়িতে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর বিহারি-রাজাকারদের বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় অপারেশন শুরু করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা উল্লিখিত পাঁচ বাড়ির প্রত্যেকটিতে ৩০ জন করে ছিলেন। দিনের বেলা লুকিয়ে থেকে রাতের বেলা অপারেশনে বের হতেন। অপারেশন শেষ করে তাঁরা আবার গ্রামে ফিরে আসতেন। তখন তাঁদের কাজ ছিল হঠাৎ করে ঝটিকা হামলা চালিয়ে নিশানার দিকে গুলি বর্ষণ করে দ্রুত ফিরে আসা। গ্রামবাসী এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার- দাবারের যোগান দিতেন। মুক্তিবাহিনী – এক মাসের মতো ঐ গ্রামে অবস্থানকালে হঠাৎ একদিন সংবাদ পায় যে, পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হামলা চালাবে। এ খবর দ্রুত গতিতে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। পরিকল্পিত আক্রমণের তিনদিন পূর্বে মধ্যরাতে মুক্তিযোদ্ধারা শিবের কুটি গ্রাম থেকে সরে গিয়ে ধরলা নদীর উত্তর প্রান্তে অবস্থান নেন।
কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের দুদিন পূর্বে পাকিস্তানি সেনারা সকাল ১০টার দিকে রত্নাই ব্রিজের ওপর এসে অবস্থান নেয় এবং সেখান থেকে শিবের কুটি গ্রামের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে গ্রামবাসী গরু-ছাগল নিয়ে ধরলা নদীর অপর প্রান্তে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। এক ঘণ্টাব্যাপী গুলিবর্ষণ শেষে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় পাকসেনারা গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ স্বর্ণ, টাকা ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এরপর তাদের এক অংশ রত্নাই ব্রিজের দুপাশে এবং অপর একটি অংশ আরো সামনে গিয়ে ধরলা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান নেয়। তারা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে। অপর প্রান্ত থেকে মুক্তিবাহিনীর তীব্র বাধায় শেষ পর্যন্ত তারা নদী পার হতে পারেনি। ধরলা নদীর এক প্রান্তে মুক্তিবাহিনী এবং অপর প্রান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়ে প্রতিদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা বারবার নদী অতিক্রমের চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র প্রতিরোধের মাধ্যমে তা ভুণ্ডল করে দেন। নদী পার হওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রত্নাই ব্রিজের দুপ্রান্তে অবস্থান নেয়। এ-সময় তারা বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ধরে এখানে এনে গণহত্যা চালায়। ব্রিজের তলদেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করলে তারা অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকলে কুলাঘাটের গাগলা নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ৩রা ডিসেম্বর কুলাঘাট ছেড়ে লালমনিরহাট শহরের দিকে চলে যায়। ৪ঠা ডিসেম্বর রত্নাই ব্রিজসহ কুলাঘাট ইউনিয়ন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড