You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর) সংঘটিত হয় ২৫শে মার্চ। এতে কর্মকর্তাসহ ৩১ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন।
অপারেশন সার্চলাইট-এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল জেলা রিজার্ভ পুলিশকে নিরস্ত্র করা। ২৫শে মার্চের কয়েকদিন আগে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদকে ময়নামতি সেনানিবাসে এক সভায় ডেকে নিয়ে পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারের চাবি দিতে চাপ প্রয়োগ করে। পুলিশ সুপার ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। আর আই (রিজার্ভ ইন্সপেক্টর) এ বি এম আবদুল হালিম এবং ফোর্স সুবেদার রুহুল আমিনও ছিলেন অভিন্ন ভাবধারার। ২২-২৩শে মার্চ কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের পুলিশ বাহিনী রাইফেল কাঁধে সামনের সড়কে ‘রোর্ড মার্চ’-এ স্লোগান তোলেন ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। এর নেতৃত্ব দেন আর আই এ বি এম আবদুল হালিম।
পুলিশ বাহিনী পুলিশ লাইন্সের চারপাশে বাঙ্কার বানায় এবং প্রতি বাঙ্কারে ৪-৫ জন করে পুলিশ সদস্য অবস্থান গ্রহণ করেন। ২৪শে মার্চ রাতে ময়মনামতি সেনানিবাস থেকে পুলিশ লাইন্স আক্রমণের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে পুলিশ সুপার ২৪শে মার্চ রাতে পুলিশ লাইন্সে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেদিন অবশ্য আক্রমণ হয়নি। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার পুলিশ লাইন্সে রোল কলে তেজোদীপ্ত ভাষণে বলেন, ‘যে করেই হোক যেকোনো আক্রমণ শক্ত হাতে প্রতিহত করতে হবে। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।’ অস্ত্রাগারের সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পুলিশ সদস্যদের দিয়ে দিতে তিনি নির্দেশ দেন। ফলে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ৭১-এ কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সে প্রায় ৩০০ জন পুলিশ ছিলেন। এছাড়া ছিলেন অনেক রিক্রুট পুলিশ, যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাত ১:৩০টার কিছু আগে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া বহর সন্তর্পণে এসে পুলিশ লাইন্সের কাছে অবস্থান গ্রহণ করে। রাত ১:৩০টা বাজার সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা অত্যাধুনিক অস্ত্র ও মর্টার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশ সদস্যরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে পাল্টা জবাব দেয়া শুরু করেন। চারদিক অন্ধকার থাকায় হানাদার বাহিনী ট্রেসার বুলেট ছোড়ে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। ভোর পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে। এ-সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুলিশ লাইন্স ঘিরে ফেলে। কিছু পুলিশ সদস্য পাশের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যান। অনেকে পুলিশ লাইন্সে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী ভোরে প্রবেশ করে পুলিশ হাসপাতালের কয়েকজন অসুস্থ পুলিশকে হত্যা করে। আত্মগোপনকৃত এবং পলায়নপর পুলিশ সদস্যদেরও গুলি করে হত্যা করে। নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ তারা ট্রাকে করে নিয়ে যায়। অন্যদের বন্দি করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসে। ২৬শে মার্চ ভোরে এসপি মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদ ও জেলা প্রশাসক এ কে এম শামসুল হক খানকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন বোখারী মিটিংয়ের কথা বলে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যায়। ৩০শে মার্চ তাঁদের দুজনকে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইন্সের আবাসিক এলাকায় হানা দিয়ে তল্লাশি ও অত্যাচার-নির্যাতন করে। তারা প্রফুল্ল কুমার দে (ইন্সপেক্টর, সদর কোর্ট) ও অর্জুন চন্দ্র দে (সাব-ইন্সপেক্টর, সদর নর্থ কোর্ট)-কে গ্রেফতার করে। অস্ত্রাগারের চাবির জন্য তারা আর আই এ বি এম আবদুল হালিমের বাসা তছনছ করে। ২৮শে মার্চ তারা প্রফুল্ল কুমার দে, অর্জুন চন্দ্র দে, আর আই এ বি এম আবদুল হালিম, তাঁর কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলে খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান লুলু ও খন্দকার মুশফিকুর রহমান বকু এবং ফোর্স সুবেদার রুহুল আমিনকে ধরে নিয়ে যায় ময়নামতি সেনানিবাসে। তাঁদের কেউ আর ফিরে আসেননি।
কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স আক্রমণে নেতৃতে দেয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন ইফতেখার হায়দার শাহ ও ক্যাপ্টেন আগা বোখারী। ২৬শে মার্চ সকালে ও পরববর্তী কয়েকদিন পুলিশ লাইন্স আবাসিক এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে সহায়তা ও ইন্ধন দেয় পাকিস্তানি পুলিশ সদস্য আর আর আই আবদুস সাত্তার খান ও কনস্টেবল মোহাম্মদ খান। পূর্ব থেকেই তারা কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের খবর ময়নামতি সেনানিবাসে গোপনে জানাত।
কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের প্রতিরোধযুদ্ধ এবং পূর্বাপর ঘটনায় অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হন। তাঁদের কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশের পরিচয় জানা যায়নি। শহীদদের মধ্যে রয়েছেন— পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদ, আর আই এ বি এম আবদুল হালিম, ইন্সপেক্টর প্রফুল্ল কুমার দে, সাব- ইন্সপেক্টর অর্জুন চন্দ্র দে ও ফোর্স সুবেদার রুহুল আমিন। কনস্টেবলদের মধ্যে পরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, খাজা সাইফুর রহমান, সুনীল কান্তি ঘোষ, হারিস চৌধুরী, আবদুল লতিফ হাওলাদার, ফজলুল করিম, ওবায়দুল হক, সাইদুল হকের নাম জানা যায়।
শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সে একটি নামফলক, একটি স্মৃতিসৌধ ও একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। শহীদদের নামে পুলিশ লাইন্সে কয়েকটি স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে। শহীদদের নামফলকে উল্লিখিত পুলিশ সদস্য ছাড়াও কুমিল্লা জেলায় যেসব পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নাম উৎকলিত রয়েছে। তাঁরা হলেন- খগেন্দ্রলাল চাকমা (সার্কেল ইন্সপেক্টর), মীর ফজলে আলী (এসআই), গঙ্গারাম চৌধুরী (এএসআই), কনস্টেবলদের মধ্যে রয়েছেন প্রতাপচন্দ্র সিংহ, গোপেন চন্দ্র দে, আহসানউল্লাহ, মজিবুর রহমান খান, এনছাব আলী, কুটি চান্দ মিয়া, আকাকুল আম্বিয়া, আবদুল খালেক, আবদুল হাকিম, গোলাম সারওয়ার, আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া, ফজলুল হক, সলিমউদ্দিন, মোজাফফর হোসেন, ফারুক মিয়া, জহিরুল হক ও নূরুল ইসলাম। [মামুন সিদ্দিকী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড