You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা

কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এ-যুদ্ধে সর্ব সম্প্রদায়ের তথা সকল শ্রেণি- পেশার মানুষ, তরুণ, কিশোর, আবালবৃদ্ধবনিতা অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ, গ্রামের কৃষক তাতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে একটা বিশাল অংশ ছিল কম বয়সী কিশোর। নির্ভীক কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন, সম্মুখ সমরে অনেক ক্ষেত্রে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রাণোৎসর্গ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কথাই আমরা জানি না, আলোচনার মধ্যে আনি না, কারণ তাঁদের সেই সামাজিক পরিচিতি ছিল না। তাই তাঁদের কথা মানুষের মন থেকে বহুলাংশেই মুছে গেছে। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে ৪ জন আত্মত্যাগী কিশোর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকাহিনী ও আত্মত্যাগের কথা এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার কুজেখানি গ্রামের গোসিংগা হাইস্কুলের নবম শ্রেনির ছাত্র মো. সাহাবউদ্দিন- (১৪)-এর শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

মো. আবু বকর- বীর বিক্রম আনোয়ারা খাতুন ও রেলওয়ে কর্মকর্তা মো. আবু জাফরের সন্তান মো. আবু বকর সৈয়দপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পরিবার ঢাকার গুলশানে বসবাস করত। আবু বকর ১৯৭১ সালে তৎকালীন কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কলেজের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালি তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে প্রশিক্ষণের জন্য যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। ২৫শে মার্চ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশের নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করলে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে সেনাবাহিনীর অফিসারের চাকরির মোহ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিনি মায়ের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু মা তাঁর অনুরোধ রাখতে রাজি হননি। মা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি না দেয়ায় আবু বকর তাঁর মাকে বলেছিলেন, “মা, তোমার তো সাত ছেলে। তাঁদের মধ্যে একজন দেশের জন্য শহিদ হলে কোনো সমস্যা হবে না। পরবর্তীকালে তিনি মে মাসে ভারতে গমন করেন। ভারতের মেলাঘরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তিনি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাড়িতে আসেন। বাড়ির সবাই তাঁকে এসব অস্ত্র বাড়িতে রাখতে নিষেধ করেন। কিন্তু পরিবারের সবাইকে আশ্বস্ত করে তিনি জানান যে, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা এসব অস্ত্র খুব শিগগিরই নিয়ে যাবেন।
গেরিলা যোদ্ধা আবু বকর মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় অপারেশন। ১৯৭১ সালের ১১ই আগস্ট সকালে মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর অপর একজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে বায়তুল মোকাররম থেকে একটি ব্রিফকেস কিনে আনেন। ব্রিফকেসের ভেতরে তাঁরা ২৮ পাউন্ড পিইকে ও ৫৫ মিনিট মেয়াদি টাইম বোমা সাজিয়ে রাখেন। বিকেলে গাড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর, সামাদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও গাজী গোলাম দস্তগীর হোটেলের গাড়ি পার্কিংয়ে পৌছেন। অতঃপর আবু বকর ও সামাদ ব্রিফকেস নিয়ে হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করেন। বাকি ২ জন স্টেনগান নিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করতে থাকেন। মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে মুক্তিযোদ্ধারা সুইস এয়ার অফিসের দরজা ব্যবহার করেন। তাঁদের হোটেলে প্রবেশের ব্যাপারে অফিসের একজন বাঙালি কর্মকর্তা সাহায্য করেন। ব্রিফকেস হাতে নিয়ে আবু বকর শৌচাগারের একেবারে কোণার কক্ষে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেন এবং সামাদ দরজার বাইরে পাহারা দিতে থাকেন। আবু বকর কক্ষের ভেতরে টাইম বোমা চালু করে ব্রিফকেসটি কমোডের পিছনে রেখে বাইরে এসে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে উভয়ে দেয়াল টপকে অপেক্ষমাণ গাড়িতে চড়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
৫৫ মিনিট পর বিকট শব্দে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়ে হোটেলের লাউঞ্জ, বিপণিবিতান ও আশপাশের কক্ষের কাচ ভেঙ্গে টুকরো- টুকরো হয়ে যায়। কক্ষের ও লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে। বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ গেরিলা আক্রমণের খবর বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়। এ অপারেশনটিই ছিল আবু বকরের শেষ অপারেশন।
অপারেশন শেষে আবু বকর বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। এ খবর পেয়ে ৩০শে আগস্ট রাত ৩টার সময় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আদিলের নেতৃত্বে এক দল সৈন্য আবু বকরদের বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন আদিল তাঁর পরিবারের সদস্যদের জানায় যে, তাঁদের গ্যারেজে আবু বকরের বন্ধুরা কিছু অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে, সেগুলো কোথায় আছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য জানার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর আবু বকরের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকেই আবু বকরকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শহীদ মো. আবু বকরকে মরণোত্তর ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয় (দি বাংলাদেশ গেজেট, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩, ক্রমিক নম্বর ১৫০)।

ফজলুল হক- শহীদ ফজলুল হকের জন্ম নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার চক্রধা ইউনিয়নের কোণাহাটা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সালামত আলী ও মাতার নাম আমেনা বেগম। তাঁরা ছিলেন ৪ ভাই ও ২ বোন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন ৮ম শ্রেণির ছাত্র।
৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে নরসিংদী, শিবপুর ও আশপাশের এলাকায় অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেখানকার কৃষক ও ছাত্রসংগঠনগুলো ছিল বেশ শক্তিশালী। সে সময় নরসিংদী শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান ছিল।
নরসিংদী থেকে শিবপুরের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নরসিংদী থেকে শিবপুর যাওয়া- আসা করত। মধ্যবর্তী স্থানে ছিল পুটিয়া বাজার।
সেখানকার একটি ব্রিজ পার হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মনোহরদী, বেলাবো ইত্যাদি এলাকায়ও যাওয়া-আসা করত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যাতে সহজে শিবপুরে আসতে না পারে সেজন্য এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্রিজটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন।
১২ই আগস্ট পুটিয়া বাজারে অপারেশনের খবর পেয়ে এলাকার বিভিন্ন শিবিরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করতে তাঁদের অধিনায়কদের অনুরোধ করতে থাকেন। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হকও সবার কাছে নিবেদন করতে থাকেন যেন তাঁকেও ঐ যুদ্ধে নেয়া হয়। ফজলু হাবিলদার মজনু মৃধার কাছে এসে অনুরোধ করেন, ‘মামু, যুদ্ধে যাইতাম, পাঞ্জাবি মারতাম।’ অধিনায়ক মজনু মৃধা তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, তাঁর যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, বয়স কম, ভালোমতো রাইফেল চালাতেও পারবে না। ফজলু তাঁকে জানান যে, তিনি রাইফেল চালানো শিখে ফেলেছেন এবং যুদ্ধে গেলে পাঞ্জাবি মেরে দেখাবেন সবাইকে। মজনু মৃধা বিরক্তি সহকারে তাঁকে বলে, ‘চল যুদ্ধে, মরার যখন এত শখ তখন মরতেই চল।’ ফজলু খুশিতে টগবগ। অপারেশনের জন্য ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার দলে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সিদ্ধান্ত হয়, ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ব্রিজটি ধ্বংস করা হবে। ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনের প্রেশার মেকানিজম খুলে ১ ফুট লম্বা পি কে ফিউজ লাগিয়ে তার সঙ্গে একত্রে অনেকগুলো গ্রেনেড স্থাপন করে ব্রিজের পিলারের নিচে লাগিয়ে দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ব্রিজের একাংশ ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু আশানুরূপ কাজ হয়নি। কিন্তু একটু পরেই দেখা গেল শতশত মানুষ আশপাশের গ্রাম থেকে হাতুড়ি, শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি নিয়ে ব্রিজের কাছে দৌড়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা ব্রিজের মাঝখানের অংশটা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে গ্রামবাসীরা এলাকা ত্যাগ করে।
প্রায় ২ ঘণ্টা পর ৬টি ট্রাকে করে এসে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রিজ থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণ করে। ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে বেশ কিছু পাকসেনা। তবুও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে ক্রমাগত গুলি চালাতে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক ক্রলিং করে তাঁদের অবস্থানে গিয়ে গুলি সরবরাহ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন। ফজলুর অবস্থানের কাছে আসতেই মজনুকে দেখে হঠাৎ করে উত্তেজিত ফজলু দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, “মামু, আমি তিনটা পাঞ্জাবিকে শ্যাষ করছি, কইছিলাম না পাঞ্জাবি খতম করুম।’
ফজলুকে দাঁড়াতে বারণ করার চেষ্টা করেন মজনু। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যায়। মুহূর্তেই একটি গুলি এসে ফজলুর দেহ ভেদ করে। কি যেন বলতে চাচ্ছিলেন ফজলু, কিন্তু একটু আওয়াজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় মজনু দ্রুত ফজলুকে ধরাধরি করে পেছনের নিচু জমিতে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। ফজলুকে নিজ হাতে ধরে রেখে অধিনায়ক সবাইকে ধীরে- ধীরে নিচের দিকে সরে যেতে নির্দেশ দেন। তখন ফজলু আবার ক্ষীণ কণ্ঠে মজনুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘মজনু মামু, পাঞ্জাবি মারলাম আর নিজেও মরলাম।’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন মজনু মৃধা। তাঁর পূর্বের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। একটু পরেই ফজলু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেবতার গ্রাস কবিতাটির কথা। মাসি তাঁর চঞ্চল ছেলেটিকে সাগর সঙ্গমে যেতে বারণ করেও যখন বোঝাতে সক্ষম হলেন না, তখন তিনি ছেলেটিকে বলেছিলেন, ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে।’ মজনু মৃধার ফজলুকে বারণ করার পরও ফজলু যুদ্ধে চলে আসেন এবং এক মর্মান্তিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক তাঁর জীবনের প্রথম যুদ্ধে শহীদ হন। এ-যুদ্ধে তিনি অনেক চেষ্টা করে যোগ দিয়েছিলেন এবং দেশমাতৃকার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ ত্যাগ করে যান।

হাসান আলী- শহীদ হাসান আলীর জন্ম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বোহানপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম জাবু মণ্ডল ও মাতার নাম খুশীমান্নেছা। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। তিনি তখন ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কথা দেশ-বিদেশের অনেকে তাদের লেখনীর মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন, যাঁদের একজন পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মেজর হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তিনি Witness to Surrender (Karachi, Oxford University Press 1977; UPL edition, 1997) শীর্ষক একটি পুস্তক রচনা করেন। এ পুস্তকের ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে উল্লেখ আছে, যার বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ-
মুক্তিযোদ্ধারা ২৩১টি সেতু, ১২২টি রেললাইন, ৯০টি বৈদ্যুতিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করেন। প্রচণ্ড মানসিক শক্তিসম্পন্ন বাঙালিদের মনোবল ছিল উচ্চ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের জুনে রাজশাহীর রহনপুর এলাকা থেকে একজন কিশোরকে গ্রেফতার করে। কিশোরটি ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ছিলেন। তাঁকে কোম্পানির সদর দপ্তরে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, কিন্তু সেই কিশোর কোনোরকম তথ্য প্রদান করতে অস্বীকার করেন। সর্বপ্রকার জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া (নিশ্চয়ই অমানুষিক নির্যাতনের প্রক্রিয়া) যখন ব্যর্থ হয়, তখন মেজর ‘আর’ (লেখক নামটি প্রকাশ করেননি) একটি স্টেনগান এনে কিশোরের বুকে ধরে বলে: এই তোমার শেষ সুযোগ। তুমি যদি তথ্য দিয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা না করো তবে এখনই স্টেনগানের গুলিতে তোমার বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হবে। সেই কিশোর তখনই হাঁটু গেঁড়ে বসেন, মাথা নামিয়ে মাটিতে চুম্বন করেন এবং দাঁড়িয়ে বলেন: আমি এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমার রক্ত দিয়ে আমার জন্মভূমি স্বাধীনতার পথে আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে।
মেজর সিদ্দিক সালিক আজ মৃত, সুতরাং কে এই মেজর ‘আর’ (Major ‘R’), কারা এই ঘটনার সাক্ষী, সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধার পরিণতি কী হয়েছিল, এতদ্বিষয়ে এ প্রবন্ধের লেখক {লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক} গবেষণা করে তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন। ৪ঠা জুন রাতে হাসান আলির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রহনপুরের কাছে ৩ নম্বর রেলসেতু ধ্বংস করেন। তারপর তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে সেতুর নিকটবর্তী তাঁর বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ করার জন্য আসেন। এ ঘটনার পর আশপাশের এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা (চরণ ওঁরাও, হাসান আলী, ওসমান আলী ও মাজেদ আলী)-কে গ্রেফতার করে রহনপুরের সেনাছাউনিতে নিয়ে আসে। সেখানে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁদের কারোরই দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলির দেশপ্রেম ও বীরত্ব কাহিনিই সিদ্দিক সালিকের পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। একজন যোদ্ধার সবচেয়ে বড়ো সফলতা হচ্ছে শত্রু কর্তৃক প্রশংসিত হওয়া।
রহনপুর সেনাছাউনিতে বহু মানুষকে নিয়ে অত্যাচারের পর হত্যা করা হতো। জানা যায় যে, পাকিস্তানি সেনাছাউনির নিমতলার জোড়া বাবলা গাছে পা উঁচুতে ও মাথা নীচের দিকে দিয়ে হাসান আলীকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা যাঁরা সেনাছাউনিতে বন্দি ছিলেন, মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা হাসানের পরিবারের সদস্যদের জানান যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা যতজনকে ধরেছিল তার মধ্যে হাসানের ওপরই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার চালানো হয়েছিল, কেননা হাসান কম কথা বলতেন আর গম্ভীর হয়ে থাকতেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কঠিন নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও তিনি মুখ খোলেননি। মেজর উত্তেজিত হয়ে হাসান আলিকে সেনাছাউনির সামনের মাঠে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেয়। হাসানের পরনে তখন ছেঁড়া রক্তাক্ত লুঙ্গি, শরীরটাও রক্তাক্ত। মেজর এই কিশোরের দিকে তাকিয়ে তার অধীনস্থদের বলে, ‘এই বাচ্চা ছেলেটার কাছ থেকে তোমরা কথা বের করতে পারো না। হাসানের দিকে মেজর স্টেনগান তাক করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, এমন নিম্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কীভাবে কথা বের করতে হয় সেই কৌশল আমার জানা আছে।’ তারপর সেই মেজর হাসান আলীকে বলে, “তোমাকে ৩টি প্রশ্ন করা হবে আর জবাব দেয়ার জন্য মাত্র ৫ সেকেন্ড সময় দেয়া হবে। এর মধ্যে মুখ না খুললে তোমাকে এই স্টেনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হবে, যা আমি সচরাচর করি।’ পাকিস্তানিদের একজন দোসর মেজরের উর্দু ভাষার নির্দেশ হাসান আলীকে বাংলায় বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু হাসান আলী নির্লিপ্ত। মেজর যখন ৪ পর্যন্ত গণনা করে তখন হঠাৎ হাসান আলী মাটিতে শুয়ে পড়েন। উৎফুল্ল মেজর অট্টহাসি হেসে বলে, ‘এখনই বাঙালি প্রাণভিক্ষা চাইবে, আমার পা জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু মেজর দেখল, হাসান আলী প্রাণভিক্ষাও চাইছেন না, পা-ও জড়িয়ে ধরছেন না। হতভম্ব মেজর প্রত্যক্ষ করল, হাসান আলী মাটিতে শুয়ে বারবার মাটিতে চুমু খাচ্ছেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে মেজরের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার জন্মভূমির মাটি চুম্বন করেছি। আমি প্রস্তুত। আমাকে হত্যা করুন। আমার রক্তে পুণ্য হবে আমার দেশের মাটি, ত্বরান্বিত হবে স্বাধীনতা। হাসান আলীর কথা পাকিস্তানি সেই দোসর উর্দুতে অনুবাদ করে মেজরকে বুঝিয়ে দিল। মেজর শুনে খুবই উত্তেজিত। পর মুহূর্তেই একটি গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল এবং হাসান আলীর মৃতদেহ পাকিস্তানিদের দোসররা টেনে নিয়ে গেল। সেই কুখ্যাত মেজরের নাম ইউনুস। সিদ্দিক সালিক নিশ্চয়ই তার সহকর্মীর অবৈধ হত্যার কথা প্রকাশ করতে চাননি। তাই হয়ত মেজর ইউনুসের গোপনীয়তা রক্ষার্থে তিনি তাকে মেজর ‘আর’ বলে সম্বোধন করেছেন। রাজশাহীর রহনপুর পাকিস্তানি সেনা ছাউনির এই খুনি মেজর ইউনুস নিরীহ গ্রামবাসীসহ বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। এলাকাবাসীর ধারণা, রহনপুরের বধ্যভূমিতেই শুয়ে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হাসান আলী।
সিদ্দিক সালিক এরূপ মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে লিখেছেন, ‘It was not an easy job for the army to stamp out insurgents so sophisticated in technique and so highly motivated.’

মো. শিরাজুল ইসলাম- কিশোরগঞ্জের এক দরিদ্র গ্রাম্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শরিফুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। বয়স তখন ১৮ হয়নি। দেশব্যাপী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্যাতন ও গণহত্যার সংবাদ পেয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ১৯শে এপ্রিল ভারতের মেঘালয়ের ইকো-১ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান করেন। ৪ নম্বর ব্যাচের সঙ্গে তিনি ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। রাইফেল চালনায় তাঁর খুবই পারদর্শিতা ছিল।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে শিরাজুল ইসলাম সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট মুক্তিবাহিনীর শিবিরে যোগদান করেন। প্রথম থেকেই অপারেশনে যাওয়ার জন্য তিনি তাঁর অধিনায়কদের বারবার অনুরোধ করেন এবং শিগগিরই তাঁর সেই সুযোগ আসে। মুক্তিযোদ্ধা আলী আমজাদের নেতৃত্বে ৬ই জুলাই রাতে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল আক্রমণের জন্য রওনা হয়। জামালগঞ্জে আনুমানিক ১০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও প্রায় ৮০ জন রাজাকার অবস্থান নিয়েছে বলে তাঁদের কাছে খবর ছিল। প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধা বদরুজ্জামান গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। প্রায় ২ ঘণ্টা গোলাগুলির পর পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের দিক থেকে আর কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পাকিস্তানি সৈন্যরা ইতোমধ্যে অবস্থান ত্যাগ করে নদী পার হয়ে অপর পাড়ে সাচনাবাজারে তাদের আরেকটি ঘাঁটিতে অবস্থান নেয় ৷ এ-যুদ্ধে শিরাজুল ইসলাম অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দেন। জামালগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয় এবং সফল অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি টেকেরঘাটে ফিরে যায়।
পুনরায় সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ আসে যে, সিলেট-সুনামগঞ্জের সংযোগ সড়কের ওপর সদরপুর সেতুটি ধ্বংস করতে হবে।
এ সড়ক দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করত। রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধারা সেতুর কাছে অবস্থান নেন। তাঁদের কাছে তথ্য ছিল যে, প্রায় ২০ জন রাজাকার সদরপুর সেতু পাহারায় নিয়োজিত আছে। সেতুর দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় রাজাকাররা টের পেয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি চালায়। প্রায় এক ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর শিরাজুল ও তাঁর ১০ জন সহযোদ্ধা রাইফেল হাতে গুলি করতে-করতে এগিয়ে যান। আক্রমণের মুখে রাজাকাররা অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা সেতুটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন। এ অপারেশনের পর শিরাজুল ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন।
জামালগঞ্জ আক্রমণের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা সাচনাবাজারে তাদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে পরিকল্পনা করা হয় যে, সাচনাবাজারকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হবে। এ অপারেশনে শিরাজুল প্রথমে এসএলআর হাতে গুলি করতে-করতে সেতুর দিকে ছুটে যান। সেতুর ওপর পৌঁছার পরপরই শত্রুপক্ষের ছোড়া এক ঝাঁক গুলি তাঁর বুকের ডানদিকে এসে আঘাত হানে। সঙ্গে-সঙ্গে শিরাজুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সহযোদ্ধারা তাঁর মৃতদেহ টেকেরঘাটে নিয়ে আসেন এবং সেদিন বিকেলে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেদিন ছিল ৮ই আগস্ট।
ইতঃপূর্বে টেকেরঘাট থেকে শিরাজুল ৩০শে জুলাই তাঁর পিতার কাছে একটি চিঠি লেখেন। তাঁর পিতা সেই চিঠিটি হাতে পান ৮ই আগস্ট। আর সেদিনই শিরাজুল শহীদ হন। তাঁর পিতা টেকেরঘাটে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে এসে চিঠিটি নিয়ে সাব-সেক্টর অধিনায়ক মেজর মুসলিম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। মেজর মুসলিম উদ্দিন তাঁর কাছে শিরাজুলের শাহাদত বরণের বর্ণনা দেন এবং আন্তরিক সমবেদনা জানান। শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা শহীদের পিতাকে তাঁর সন্তানের কবরের কাছে নিয়ে যান।
পিতাকে লেখা শিরাজুলের পূর্বে উল্লেখিত চিঠিটি মুক্তিবাহিনীর শিবিরে পড়ে শোনানো হতো। শহীদ হয়েও শিরাজুল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর এই চিঠির মাধ্যমে। এ পরাধীন দেশকে স্বাধীন করতে যেসব কিশোর মুক্তিযোদ্ধা প্রবল আবেগ আর গভীর দেশপ্রেম নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের মৃত্যু নেই – তাঁরা মৃত্যুঞ্জয়। তাঁদের রক্তেই বাংলাদেশ। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড