কিশোরগঞ্জ শহর গণহত্যা (কিশোরগঞ্জ সদর)
কিশোরগঞ্জ শহর গণহত্যা (কিশোরগঞ্জ সদর) সংঘটিত হয় ১৯শে এপ্রিল। এতে ৯ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
ঘটনার দিন দুপুরের পর ট্রেনযোগে হানাদার পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ শহরে অনুপ্রবেশ করে। এদিনই তারা প্রথম আসে এবং ৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য যশোদল-কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আগে থেকেই রেললাইন উপড়ে রেখেছিল। ফলে পাকসেনারা যশোদল স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কিশোরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। পথে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ আর এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করে তারা জনমনে ভীতির সঞ্চার করে। সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের খবর পেয়ে শহরবাসী প্রাণের ভয়ে সহায়-সম্পদ ফেলে যে যেদিকে পারে দৌড়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করে।
কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে সিগন্যাল পয়েন্টের কাছে তারাপাশা (বন্দের বাড়ি) গ্রামের রুস্তম মিয়ার রিক্সাচালক ছেলে জজ মিয়া ওরফে জজে প্রাণভয়ে পালাবার সময় হঠাৎ হানাদারদের সামনে পড়ে যায়৷ সঙ্গে- সঙ্গে তারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। রিক্সাচালক জজ মিয়া এ শহরের প্রথম শহীদ। এরপর হানাদার বাহিনী মূল শহরের দিকে এগিয়ে আসার পথে একরামপুর ব্রিজের কাছে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ জাহাঙ্গীর মামু নামে একজনকে পেয়ে যায়। জাহাঙ্গীর এক হাতে একটি বটগাছের চারা নিয়ে প্রতিদিন শহরময় ঘুরে বেড়াত। পাকবাহিনীকে দেখে সে ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। সঙ্গে-সঙ্গে হানাদারদের রাইফেল তীব্র আক্রোশে গর্জে ওঠে। একরামপুর ব্রিজের পাশেই পড়ে থাকে তার নিষ্প্রাণ দেহ। কিশোরগঞ্জ শহরের দ্বিতীয় শহীদ জাহাঙ্গীর মামু। তার স্মৃতি আজও কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে অম্লান। এরপর পুরান থানার ক্ষুদ্র পান দোকানদার বীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার বীরু (পিতা বীরেন্দ্র সরকার)-কে হানাদার বাহিনী দোকানেই গুলি করে হত্যা করে। তার বাড়ি নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার আমতলা গ্রামে। সে কিশোরগঞ্জ শহরের পুরান থানা এলাকায় বসবাস করে একটি পানের দোকান চালাত। এরপর হানাদার পাকবাহিনী একে-একে হত্যা করে খড়মপট্টি এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি যতীন্দ্র পাল, কালাচাঁদ সরকারের স্ত্রী জ্ঞানদা সুন্দরী সরকার, তার পুত্র দুলু সরকার, অন্নদা চন্দ্র দে-র পুত্র রমেশ চন্দ্র দে, রশিদাবাদ গ্রামের সোনাধর ভূঁইয়ার ছেলে ও গুরুদয়াল কলেজের পিয়ন আব্দুল খালেক ভূঁইয়া, হারুয়া গ্রামের আবদুর রেজ্জাকের রিক্সাচালক ছেলে মো. আব্দুল খালেক প্রমুখকে।
পাকহানাদাররা এদিন কিশোরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে। তাদের নির্বিচার গণহত্যা আর অগ্নিসংযোগে সারা শহরে ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাদের অনুগত হাতেগোনা কতিপয় দালাল আর বিহারি সম্প্রদায়ের কয়েকটি চিহ্নিত পরিবার ছাড়া শহরে উল্লেখযোগ্য কোনো বাঙালি পরিবারের উপস্থিতি ছিল না। এ সুযোগে দালালরা পাকবাহিনীর ছত্রছায়ায় শহরের বিভিন্ন বাসায় ইচ্ছেমতো লুটপাট চালায় ও কেউ-কেউ হিন্দুদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর দখল করে। [জাহাঙ্গীর আলম জাহান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড