আব্দুল কাদের মােল্লা। একাত্তরে মিরপুরবাসীর কাছে যে পরিচিত ছিলাে কসাই কাদের নামে। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে নয় মাস মিরপুর এবং আশপাশ এলাকায় যার নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যা-গণহত্যা এবং ধর্ষণের মতাে মানবতা বিরােধী অপরাধ। জাতির মুক্তি আকাক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেয়া ৭১এর এই ঘাতককে ২০১০ সালে বিচারে আওতায় আনা হয় এবং তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ গঠন করা হয়। কাদের মােল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনিত প্রথম অভিযােগে বলা হয়, কাদের মােল্লার নির্দেশেই একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রায়ে বলা হয়, নবাবপুর থেকে পল্লবকে ধরে আনার মতাে দুষ্কর্মে কাদের মােল্লার সহযােগিতা’ ছিল। আব্দুল কাদের মােল্লার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযােগ, একাত্তরের ২৭ মার্চ কাদের মােল্লা তার সহযােগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা করে। রায়ে বলা হয়, সহযােগীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে কাদের মােল্লা এ হত্যাকাণ্ডে ‘নৈতিক সমর্থন’ ও ‘উৎসাহ জুগিয়েছে, যা দুষ্কর্মে ‘সহযােগিতার মতাে শাস্তিযােগ্য অপরাধ।
তৃতীয় অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ২৯ মার্চ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে। মিরপুরের জল্লাদখানা পাম্প হাউসে নিয়ে কাদের মােল্লা ও তার সহযােগীরা জবাই করে হত্যা করে। চতুর্থ অভিযােগ, একাত্তরের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ১১টা পর্যন্ত। কাদের মােল্লা ও তার সহযােগী রাজাকার আল-বদররা কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচর এলাকায় শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও দুজন নিরস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করে। পঞ্চম অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি হেলিকপ্টার মিরপুরের আলােকদী গ্রামের পশ্চিম দিকে নামে। কাদের মােল্লা অর্ধশত অবাঙালি, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিয়ে গ্রামের পূর্ব দিক থেকে ঢােকে এবং এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ওই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মারা যান। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে, হত্যাকাণ্ডের সময় কাদের মােল্লাকে রাইফেল হাতে সশরীরে উপস্থিত দেখা গেছে। কোনাে মানবতাবিরােধী অপরাধ যখন অনেক ব্যক্তি ঘটায়, তখন ওই ব্যক্তিদের প্রত্যেকে ওই অপরাধ এককভাবে সংঘটনের জন্য সমানভাবে দায়ী। ষষ্ঠ অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ মিরপুরের ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর কালাপানি লেনের হযরত আলী, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই বছরের ছেলেকে হত্যা এবং তার ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের সঙ্গে কাদের মােল্লা সংশ্লিষ্ট ছিলাে । হযরতের আরেক মেয়ে ওই ঘটনা লুকিয়ে থেকে দেখেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন হযরতের পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য লুকিয়ে থাকা ওই মেয়ে। রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধের ঘটনাস্থলে কাদের মােল্লার উপস্থিতি অপরাধের সঙ্গে তার সংযুক্ততা প্রমাণ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মােল্লার বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযােগ। ছাড়া বাকি পাঁচটি অভিযােগে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
চলিত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মােল্লাকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ | অভিযােগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযােগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের পর তার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগসহ পুরো দেশ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সমান সুযােগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) সংশােধন বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আগে আইনে সরকারের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযােগ ছিল না।