কাতলমারী গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর)
কাতলমারী গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর। এতে ১৯৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। নবাবগঞ্জ উপজেলার ১নং জয়পুর ইউনিয়নে কাতলমারী ও খোসলামপুর গ্রাম অবস্থিত। আফতাবগঞ্জ হয়ে ফুলবাড়ি বরাবর পশ্চিম দিকে ৪ কিলোমিটার দূরত্বে খোসলামপুর থেকে কাতলমারী যাওয়ার সহজ পথ। কাতলমারী মুসলিম অধ্যুষিত আর খোসলামপুর হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম। এ গ্রামদুটি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুর গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আছে। অত্র এলাকার রাজাকার ও আলবদর-রা পাকবাহিনীর প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে নবাবগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলো থেকে প্রায়ই গরু-ছাগল ধরে এনে তাদের আপ্যায়ন করত। এছাড়া বাড়িঘরগুলোতে লুটপাট চালাত। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সোনা-রূপার অলংকার, তামা-কাসার তৈজসপত্র ও টাকা-পয়সা লুট করত। তারা লুটপাট চালানোর উদ্দেশ্যে হানাদার বাহিনীকে উত্তেজিত করতে বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করত। মুসলিম গ্রামগুলোতে পাকবাহিনীর আক্রমণ জোরদার করতে তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান দিত; আর হিন্দু গ্রামগুলোর নারীদের সন্ধান হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত। এভাবে তারা গ্রামের মানুষদের ওপর নির্যাতন চালায়।
পাকবাহিনী এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত খোসলামপুর গ্রামের বেশকিছু যুবতী মেয়েকে তাদের ক্যাম্পে তুলে আনে। কাতলমারী গ্রামে তারা বেশ কয়েকবার টহল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান চালায়। এরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ৬ই মে সকাল ৮টার দিকে পাকবাহিনীর দোসররা হিন্দু অধ্যুষিত খোসলামপুর গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। তাদের মধ্যে রাজাকার ও পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়ি উপজেলার বিহারিরাও ছিল। তাদের হাতে ছোরা, বল্লম ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র ছিল। পুরুষ-মহিলা-শিশু-কিশোর-যুবক – সবাইকে বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি করে বের করে নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। রাজাকাররা তাদের গ্রামের পূর্ব মাথায় জমায়েত করে পাকবাহিনীকে খবর দেয়। সকাল ১১টার দিকে ফুলবাড়ি থেকে একটি ট্রাকসহ পাকসেনারা খোসলামপুর গ্রামে ঢোকে। ট্রাকে সোনা-রূপা, তামা-কাসা, সাইকেল ইত্যাদি মূল্যবান জিনিসপত্র তুলে নেয়। তারপর বন্দীদের মধ্য থেকে শিশু ও কিশোরদের ছেড়ে দিয়ে প্রায় ২০০ জনকে হাঁটাপথে আফতাবগঞ্জ থেকে ফুলবাড়ি বরাবর পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গে মালামাল বোঝাই ট্রাকটিও যায়। পাকবাহিনী এই বন্দিদের ৪ কিলোমিটার হাঁটিয়ে কাতলমারী গ্রামে নিয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে কাতলমারী গ্রামের জনগণ পাশের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেউ-কেউ কচুরিপানায় ভরা পুকুরে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচায়। হানাদার বাহিনী বন্দিদের কাতলমারী গ্রামের মান্নান সাহেবের বাড়ির দক্ষিণ দিকের মাঠে একত্রিত করে আবার তল্লাশি চালায়। দুপুর ৩টার দিকে পাকবাহিনীর বড় কর্মকর্তা কাতলমারীতে আসে। তারা হানাদার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ১০-১৫ মিনিট মিটিং করে স্থান ত্যাগ করে। এরপর বন্দিদের বসিয়ে প্রথমে এসএলআর দিয়ে ফায়ার করা হয়। কাউকে-কাউকে বন্দুকের গুলিও করা হয়। এ অবস্থায় তারা মাটিতে পড়ে চিৎকার করতে ও গোঙ্গাতে থাকে। কেউ-কেউ নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আহতদের গগণবিদারী চিৎকারে কাতলমারীর চারদিক ভারী হয়ে ওঠে। জনশূন্য কাতলমারীতে সে চিৎকার ছিল বড়ই অসহায়! যারা পুকুরে আর জঙ্গলে লুকিয়েছিল, তারা সেই আর্তনাদ ও চিৎকার শুনতে পেয়েছিল।
হানাদার বাহিনী কাতলমারী গ্রাম থেকে বিকেল ৪টা নাগাদ চলে যায়। যাবার সময় বেশ কয়েকটি খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর গ্রামবাসীরা গ্রামে ফিরে আসে। আহতদের মধ্য থেকে কেউ-কেউ উঠে এসে পানি খেতে চায়। কেউ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত নাড়িভুঁড়ি নিয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করে। গ্রামবাসীরা তাদের পরিচর্যা দিলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। এমন অবস্থায় কাতলমারীর অধিবাসীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এতগুলো লাশ তারা কি করবে। মাঠের সন্নিকটস্থ মান্নান সাহেবের বাড়ির পাশে বেশ কয়েকটি কূপ ছিল। অবশেষে তারা লাশগুলোকে বাঁশের ভারে করে এনে কূপগুলোতে ফেলে দেয়। গ্রামবাসীরা এভাবে ১৯৫ জনকে সমাহিত করে। সেই থেকে কূপগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় এবং সেগুলো গণকবর হিসেবে পরিচিতি পায়। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার পর কূপগুলো ভরাট করে ফেলা হয়। কাতলমারী গ্রামের প্রবীণরা আজো সেই গণহত্যার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন। কাতলমারী গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে ৬৭ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন— কালীকুমার দাস গেদু (পিতা কমল চন্দ্ৰ দাস), কমল চন্দ্র দাস (পিতা দীনবন্ধু দাস), পাতানী রানী (পিতা কমল চন্দ্র দাস), অঞ্জলী রানী (স্বামী তারিণী কান্ত দাস), শেফালী রানী (পিতা তারিণী কান্ত দাস), বাচ্চা, সচী রানী (পিতা ধনপতি দাস), মালতী রানী (পিতা কমল চন্দ্ৰ দাস), ক্ষেপীমনি (পিতা দীনবন্ধু দাস), গুরুচরণ দাস (পিতা বাদিরাম দাস), বাবুরাম দাস ওরফে দীনবন্ধু (পিতা ঘনশ্যাম দাস), দ্বিজেন দাস (পিতা গুরুচরণ দাস), গুন্দ বালা (পিতা ঘনশ্যাম দাস), গিরিবালা (স্বামী ঘনশ্যাম দাস), কিরণবালা (স্বামী খোকা রাম দাস), বাসন্তী বালা (পিতা গুরুচরণ দাস), গিরিশ চন্দ্র (পিতা গোপীনাথ দাস), সুরীণ দাস (পিতা গদাধর চন্দ্র দাস), হরিপদ দাস (পিতা রজনীকান্ত দাস), নগেন চন্দ্র দাস (পিতা মোহন চাঁন), বেহুলা (স্বামী মোহন চাঁন), ভুবন মোহন মণ্ডল (পিতা শিবনাথ মণ্ডল), বায়ামনি ওরফে ক্ষীরদা (পিতা শিবনাথ মণ্ডল), ডালোমনি (স্বামী দীনবন্ধু দাস), পারুল (পিতা দীনবন্ধু দাস), রাধিকা, পাকডু (পিতা দুর্গাচরণ দাস), ভূষণ (পিতা লক্ষ্মণ চন্দ্র দাস), শান্তনা বালা (স্বামী কলিপদ দাস), পরমেশ্বর মণ্ডল (পিতা যাত্রা মণ্ডল), দক্ষরানী (স্বামী পরমেশ্বর মণ্ডল), কেশব চন্দ্ৰ (পিতা পরমেশ্বর মণ্ডল), ভবেশ চন্দ্র মণ্ডল (পিতা ভগবান মণ্ডল), তিলোত্তমা মণ্ডল (স্বামী ভগবান মণ্ডল), শান্তি রানী (স্বামী মহেশ্বর মণ্ডল), বরদা মণ্ডল (পিতা যাদব মণ্ডল), ললিতা মণ্ডল (পিতা স্বামী বরদা মণ্ডল), রক্ষিণী মণ্ডল (পিতা বরদা মণ্ডল), নিখিল মণ্ডল (পিতা বরদা মণ্ডল), ভগবান মণ্ডল (পিতা খড়গো মণ্ডল), জ্যোৎস্না (পিতা গুরুচরণ), সন্তোষ (পিতা শোটা), সুনীল (পিতা বরদা মণ্ডল), সাবিত্রী (পিতা গুরুচরণ), যশোদা, ঠাকুরমনি, নিধুবালা (পিতা দীনবন্ধু দাস), দীনবন্ধু (পিতা ধারা কান্ত দাস), যতীন (পিতা রুদ্র দাস), কৈলাশ (পিতা গেনারাম দাস), মাদার (পিতা ভোদারাম দাস), কুমুদিনী ওরফে কাচেনী (পিতা শ্রীদাম), জিতেন (পিতা শ্রীদাম), বিন্দামনি (স্বামী মদন মোহন), হরিমনি (স্বামী জানকী নাথ), হরিমনি (স্বামী গুরুচরণ দাস), রাজমনি (স্বামী মহিনচন্দ্র দাস), রনজি বালা (স্বামী দুর্গাচরণ দাস), আদিন বালা (স্বামী ভোলানাথ দাস), পুষ্প বালা (স্বামী লক্ষ্মণ চন্দ্র দাস), নির্মল চন্দ্র দাস (পিতা কালীপদ দাস), সনেকা বালা (পিতা দীনবন্ধু দাস), নীলকণ্ঠ মণ্ডল (পিতা যাদব মণ্ডল), বাদলী বালা (স্বামী যাদব মণ্ডল), মমতা রানী (পিতা ধনপতি দাস), বিনোদিনী বালা (স্বামী কালীকুমার দাস গেদু) এবং দুর্গামনি (স্বামী গুরুচরণ দাস)। [মাসুদুল হক] কাতলসার উত্তরপাড়া গণহত্যা (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ) সংঘটিত হয় ২রা আগস্ট। এতে ১৪ জন গ্রামবাসী হত্যার শিকার হন।
মুক্তাগাছা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে বড়গ্রাম ইউনিয়নের একটি গ্রাম কাতলসার। পাকবাহিনী ২রা আগস্ট এ গ্রামে ঢুকে উত্তরপাড়ায় গণহত্যা চালিয়ে ১৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এটি বড়গ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যায় যারা প্রাণ হারান, তারা হলেন- রজব আলী (পিতা নছিমুদ্দিন), আবেদ আলী (পিতা নছিমুদ্দিন), আহাদ আলী (পিতা শুকুর আলী), রাজমামুদ (পিতা আবদুল আলী), হাছেন আলী (পিতা আজিমুদ্দিন), সাহাব আলী(পিতা হাছেন আলী), কুমেদ আলী (পিতা হাছেন আলী), শাহেদ আলী মণ্ডল (পিতা আয়েন উদ্দিন মণ্ডল), জবেদ (পিতা শাহাদ আলী), মনির উদ্দিন (পিতা আয়েদ আলী মুন্সি), মেহের আলী মণ্ডল (পিতা চামারি মণ্ডল), কানু মণ্ডল (পিতা মন্তি মণ্ডল), খোরশেদ আলী মণ্ডল (পিতা সফর আলী মণ্ডল) ও মনেছ আলী (পিতা সিরাজ আলী)। কাতলসার কয়াবিলে শহীদদের স্মরণে একটি নামসহ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড