কাটিরহাট যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম)
কাটিরহাট যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর। এতে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে ১ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এছাড়া কয়েকজন রাজাকার আহত হয়। কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের শক্তিশালী ঘাঁটি। এ ঘাঁটি থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা ছিল হানাদার বাহিনীর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। তারা নিরীহ সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন করত। ১৩ই ডিসেম্বর ভোরে হানাদার বাহিনীর শতাধিক সদস্যের একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় কাটিরহাট বাজারের পূর্বদিক থেকে গুলি করতে- করতে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করতে থাকে। এক পর্যায়ে হানাদারদের গুলিতে নিরীহ গ্রামবাসী সিরাজুল হক (পিতা মকবুল আহমদ) প্রাণ হারান। এ খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছার সঙ্গে-সঙ্গে থানা কমান্ডার এস এম কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে বংশাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সংগঠকদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কমান্ডারদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কাজী মো. মুহসিন, এস এম ইলিয়াছ চৌধুরী, মো. আবুল মনসুর, হারুন উর রশিদ চৌধুরী, আবু তাহের, মো. নূরুল আলম, মোহাম্মদ ফজল করিম, মো. ইউনুছ, ছালে জহুর, আর্মি জহুর ও প্লাটুন কমান্ডার মোক্তারুল আলম। সভায় হানাদার বাহিনীকে কীভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে মোকাবেলা করা যায় এবং তাদের অত্যাচার থেকে এলাকার জনগণের জানমাল ও মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করা যায়, সেই কৌশল নির্ণয় করার জন্য বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠকরা এলাকা ত্যাগ না করে যার কাছে যে অস্ত্র আছে তা দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে হানাদার বাহিনীকে অস্থির করে রাখতে হবে। এরপর হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করার কৌশল হিসেবে থানা কমান্ডারের নেতৃত্বে ২০টি গেরিলা টিম গঠন করা হয়। প্রত্যেকটি টিমে ৫ জন করে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শত্রুপক্ষ যাতে কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট কিংবা মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করতে না পারে, সেজন্য গোপন জায়গা থেকে দু-একটি গুলি বা প্রয়োজনে হ্যান্ডগ্রেনেড ছুড়তে হবে। এর বিনিময়ে শত্রুপক্ষ শতশত গুলি ছুড়বে। ফলে তাদের হাতে মজুত থাকা গোলা-বারুদ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। তারপর তাদের একযোগে আক্রমণ করা হবে। উল্লিখিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার এস এম কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে গ্রুপ কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণে দ্রুত গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়েন এবং গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন শুরু করেন। শত্রুপক্ষের গতিবিধি লক্ষ করে দু-একটি গুলি ও মাঝে- মধ্যে হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করার বিনিময়ে হানাদার বাহিনী শতশত গুলি ছুড়তে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন করছিলেন, তখন রাজাকারদের মধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হওয়ার পর -রাজাকার-রা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পথপ্রদর্শক রাজাকাররা না থাকায় হানাদাররা পথ ভুলে এলোপাতাড়ি গুলি করতে-করতে হালদা নদীর পাড় হয়ে দক্ষিণে সেকান্দর পাড়া, উত্তরে বংশালঘাট, পশ্চিমে সৈয়দ কোম্পানির বাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং দিশেহারা অবস্থায় এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। তাদের কোথাও অবস্থান নেয়ার মতো সুযোগ ছিল না। প্রত্যেকটি জায়গায় হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকে। অবশেষে বিকেলের দিকে হানাদাররা আত্মরক্ষামূলক গুলি ছুড়তে-ছুড়তে কাটিরহাট ঘাঁটিতে চলে যাবার পথ খুঁজতে থাকে। এ খবর পেয়ে সব গেরিলা গ্রুপ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে শত্রুপক্ষের ৯ জন সৈন্য নিহত ও কয়েকজন রাজাকার আহত হওয়ার পর তীব্র আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত হয়ে হানাদাররা লোকালয় ছেড়ে তাদের ঘাঁটিতে চলে যেতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে দেখে হানাদার বাহিনী সন্ধ্যার মধ্যে কাটিরহাট ঘাঁটি ও উদালিয়া চা-বাগান ঘাঁটি ত্যাগ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চলে যায়। এদিনই হাটহাজারীর উত্তরাংশ হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয়। এ সংবাদ শুনে সর্বস্তরের জনগণ বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে এবং বালাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানায়। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড