You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.30 | কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) - সংগ্রামের নোটবুক

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) সংঘটিত হয় ৩০শে সেপ্টেম্বর ও ২২শে নভেম্বর। এতে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার ধামালিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম কাটেঙ্গা। ডুমুরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খুলনা ও যশোর জেলার সীমান্তে গ্রামটির অবস্থান। এ গ্রামের পশ্চিম দিকে ভবদহ নদী, পূর্ব পাশে টোলনা এবং দক্ষিণে চেঁচুড়ি গ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ধামালিয়া ইউনিয়ন ছিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র প্রভাবাধীন এলাকা। এ ইউনিয়নের কাটেঙ্গা, টোলনা, চেঁচুড়ি ও পাশ্ববর্তী জামিরা বাজারে -রাজাকার- বাহিনীর দাপট ছিল। এলাকার রাজাকাররা ডুমুরিয়ার উত্তরাঞ্চলে বেশকিছু গণহত্যা সংঘটিত করে। তারা এ ধরনের একটি গণহত্যা চালায় কাটেঙ্গা গ্রামে। কাটেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে দুই পর্বে ৩০শে সেপ্টেম্বর ও ২২শে নভেম্বর এ গণহত্যা সংঘটিত হয়।
কাটেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের পাশে তাগের আলী হালদার নামের একজনের বসতবাড়ি ছিল। রাজাকাররা বাড়িটি দখল করে সেখানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যুবকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করত। ৩০শে সেপ্টেম্বর রাতে কিছু যুবককে ধরে এনে এ বাড়িতে তারা আটক করে। প্রথমে তাদের ওপর ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন চালায়। পরে গভীর রাতে স্কুলের মাঠে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করে। কাটেঙ্গা গ্রামের এ গণহত্যায় রাজাকারদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জামিরা বাজার ক্যাম্পের রাজাকাররাও অংশ নেয়। এ গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে চেঁচুড়ি গ্রামের ৭ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- শাহাদাৎ হোসেন গাজী (পিতা ওসমান গাজী), আবদুল হাই গাজী (পিতা হাশেম আলী গাজী), সাজ্জাদ আকুঞ্জি (পিতা হাশেম আকুঞ্জি), আবদুল হামিদ পেয়াদা (পিতা আছিরউদ্দিন), কাওছার মোলঙ্গি (পিতা কেয়ামউদ্দিন মোলঙ্গি), আমজাদ আকুঞ্জি (পিতা শরিতুল্লা আকুঞ্জি) ও জোনাব আলী সরদার (পিতা মোবারক আলী সরদার)।
কাটেঙ্গা স্কুল মাঠে দ্বিতীয়বার গণহত্যা সংঘটিত হয় ২২শে নভেম্বর। এদিন রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে ২৪ জন যুবককে আটক করে। দিনভর নির্যাতন শেষে রাতে তাদের প্রাইমারি স্কুল মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। নিহত ২৪ জনের মধ্যে কাটেঙ্গা গ্রামের ১১ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন— মজিদ গাজী (পিতা কাসেম গাজী), মোকছেদ ফকির (পিতা সাহেব আলী), আহাদ আলী গাজী (পিতা মদন গাজী), মোকছেদ গোলদার (পিতা গোলাম রসুল), জালাল উদ্দিন গাজী, জব্বার মোল্লা (পিতা গহর আলী মোল্লা), সিকান্দার সরদার (পিতা ফটিক সরদার), বশির পাশা (পিতা এবাদ আলী), লুৎফর সরদার (পিতা ছবেদ আলী), কাশেম সরদার (পিতা ফানেজ সরদার) এবং রহমান গাজী (পিতা ছোড়ান গাজী)।
কাটেঙ্গা স্কুল মাঠে গুলিবিদ্ধ হয়েও জব্বার মোল্লা (চেঁচুড়ি) ও বশির গাজী (চেঁচুড়ি) জীবিত ছিলেন। কিন্তু হাত পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা থাকায় তারা পালাতে পারেননি। পরদিন সকালে রাজাকাররা এ দুজনকে জামিরা বাজারে নিয়ে খেজুর গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে।
কাটেঙ্গা গণহত্যায় নিহত লুৎফর সরদার (পিতা ছবেদ আলী সরদার, চেঁচুড়ি) ছিল দরিদ্র পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। রাজাকাররা তাকে তাদের বাহিনীতে যোগ দিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে বলেছিল। লুৎফর তাতে রাজি না হওয়ায় রাজাকাররা তাকে কাটেঙ্গা স্কুল মাঠে ধরে নিয়ে যায়। এ- সময় লুৎফরের পিতা-মাতা রাজাকার ও শান্তি কমিটি র লোকজনের পায়ে ধরে ছেলের জীবন রক্ষার জন্য মিনতি জানান। রাজাকাররা তাদের জানায় যে, লুৎফরকে হত্যা করা হবে না, একটু বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। আশ্বস্ত হয়ে লুৎফরের পিতা-মাতা বাড়ি চলে যান। কিন্তু অনবরত গুলির শব্দ হতে থাকলে লুৎফরের পিতা-মাতা রাতেই স্কুল মাঠে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন লুৎফরের মৃতদেহ পড়ে আছে, চোখ খোলা, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। একমাত্র পুত্রের এ বীভৎস মৃত্যু দেখে লুৎফরের পিতা ছবেদ আলী ও মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
কাটেঙ্গার পার্শ্ববর্তী ভবদহ নদীতেও একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে হত্যা করে এ নদীতে ফেলে দিত। মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এসব গণহত্যা সংঘটিত হয়।
ডুমুরিয়ার চেঁচুড়ি গ্রামের আকবর সরদার নামে একজন যুবককে রাজাকাররা ভবদহ নদীর পার্শ্ববর্তী কপালিয়া বাজারে নির্মমভাবে হত্যা করে। পার্শ্ববর্তী মান্দ্রা গ্রাম থেকে তাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে কপালিয়া বাজারে একটি বকুল গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে। কিছুক্ষণ প্রহার করার পর রাজাকাররা তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ছুরি দিয়ে জখম করে। নির্যাতন আর রক্তক্ষরণে আকবর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ-সময় পার্শ্ববর্তী মসজিদে আজান হচ্ছিল। আজান শুনে আকবর শেষবারের মতো একটু নামাজ পড়ার জন্য রাজাকারদের কাছে করুণ মিনতি জানিয়েছিল। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে আকবরকে তারা গাছে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। ডুমুরিয়ার মজিদ বাহিনীর গেরিলা সাইদ হোসেন, আবদুল আলী, এম এম হক প্রমুখকে রাজাকাররা হত্যা করে এ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। [দিব্যদ্যুতি সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড