১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র-এর অষ্টম খণ্ডের ৪৬৫ পৃষ্ঠায়, ১৯৯৭ সালের ৩ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদী ও ২০০৭ সালের ১৩ এপ্রিল ভােরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই ধরনের তথ্য রয়েছে। নূতনচন্দ্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৭২ সালে তার বড় ছেলে সত্যরঞ্জন সিংহ রাউজান থানায় মামলাও করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আরও চারজন সাক্ষী ওই ঘটনাকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন, তবে তারা ঘটনা শুনেছেন। তাঁদের বক্তব্য প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের বক্তব্যকে সমর্থন করে। তারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ সিরু বাঙালি, দেবব্রত সরকার এবং নূতনচন্দ্রের ছােট ছেলে প্রফুল্লরঞ্জন সিংহ। ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রশ্ন উঠতে পারে নূতনচন্দ্র কেন ফজলুল কাদের চৌধুরীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন? নূতনচন্দ্র সারা দেশে বিশেষত, চট্টগ্রামে খুবই জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক স্কুল, কলেজ ও নামকরা কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষকসহ অনেকে কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলাে। হিন্দু জনগােষ্ঠীর জন্য তার অবদান তাঁকে জনপ্রিয় করে তােলে। কোনাে সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বা নির্বাচনে হিন্দুদের কাছে তার মতের আলাদা গুরুত্ব ছিল।
যার কারণে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ফজলুল কাদের চৌধুরী পরাজিত হন। এর প্রতিশােধ হিসেবেই নূতনচন্দ্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করা রায়ে বলা হয়, সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্যের সঙ্গে দালিলিক নথি মিলিয়ে দেখা যায়, রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযােগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। পঞ্চম অভিযােগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ এপ্রিল দুপুরে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে গণহত্যা চালায় এবং বাড়ি ঘরে আগুন দেয়। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের ২২তম সাক্ষী অনিল বরণ ধর ওই ঘটনার একজন ভুক্তভােগী ও প্রত্যক্ষদর্শী। তার বাবা উপেন্দ্র লাল ধর ওই গণহত্যার একজন শিকার। অনিলকেও অনেকের সঙ্গে সারিতে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করেছিল, তিনিও অন্যদের সঙ্গে পড়ে যান এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তবে পরে আহত অবস্থায় তার জ্ঞান ফিরে আসে। হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সাকা চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে দেখেছেন। বণিকপাড়ার ওই গণহত্যার ঘটনায় অনিল ১৯৭২ সালে সাকা চৌধুরীসহ ১৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন। সিরু বাঙালির সাক্ষ্য ও তদন্ত কর্মকর্তাকে দেওয়া বাদল বিশ্বাসের জবানবন্দি বণিকপাড়ার ওই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বিনাশের উদ্দেশ্যে ওই পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনা রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। ষষ্ঠ অভিযােগ অনুসারে, একাত্তরের ১৩ এপ্রিল বিকেলে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে রাউজানের হিন্দু-অধ্যুষিত উনসত্তরপাড়া গ্রামে সশস্ত্র অভিযান চালায়।
স্থানীয় ক্ষিতিশ মহাজনের বাড়ির পুকুরপাড়ে শান্তিসভার কথা বলে হিন্দুদের জড়াে করার পর সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে সেনারা এলােপাতাড়ি গুলি করে ৬০-৭০ জনকে হত্যা করে। রায়ে বলা হয়, এ অভিযােগ প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ পাঁচজন সাক্ষীকে (৩, ৭, ৩১, ৩২, ৩৭ নম্বর) পরীক্ষা করেছে এবং তদন্ত কর্মকর্তাকে দেওয়া জানতী বালা। পালের জবানবন্দি দাখিল করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ৩৭তম সাক্ষী চপলা রানী ওই ঘটনার ভুক্তভােগী ও প্রত্যক্ষদর্শী । উনসত্তরপাড়ার ওই হত্যাকাণ্ড তিনি বিস্তৃতভাবে বলেছেন এবং কীভাবে তাদের পুকুরপাড়ে নিয়ে জড়াে করা হয় তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ওই হত্যাকাণ্ডে তার বাবা সতীশ ও দুই স্বজন মারা যান। রাষ্ট্রপক্ষের ৩১তম সাক্ষী সুজিত মহাজন ওই ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী এবং তিনিও চপলার অনুরূপ জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্বাস উদ্দিন খান আরেক প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ওই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালােচনা করে ও দালিলিক নথির সঙ্গে মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে এ গণহত্যায় আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পেরেছে। সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অষ্টম অভিযােগ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মােজাফফর আহমেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে অপহরণ করে হত্যার ।
রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযােগের সমর্থনে চারজন সাক্ষীকে পরীক্ষা করেছে এবং নানা পত্রিকার পাঁচটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সাক্ষীদের মধ্যে উম্মে হাবিবা সুলতানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং শেখ আলমগীরের স্ত্রী। তার সাক্ষ্যে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডের তিন মাথা থেকে মােজাফফর আহমেদ ও শেখ আলমগীরকে অপহরণের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে। ওই অপহরণের সময় তিনি উপস্থিত সাকা চৌধুরীকে শনাক্ত করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের ২০তম সাক্ষী মােজাফফর আহমেদের আরেক ছেলে শেখ মােরশেদ আনােয়ারের সাক্ষ্য উম্মে হাবিবার সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে গেছে। অন্য দুই সাক্ষীর। সাক্ষ্য ও দালিলিক নথির বক্তব্য একই ধরনের হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযােগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সিরু বাঙালি, নির্মলচন্দ্র শর্মা ও সুবলের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে রায়ে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টা-সাতটার দিকে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে রাউজানের মধ্য গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায়। পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র অভিযান চালায়। সেখানে গ্রামবাসীকে আটক করে স্থানীয় চিকিৎসক মাখন লাল শর্মার বাড়ির উঠানে জড়াে করা হয়।