You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কাকন বিবির অবদান - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কাকন বিবির অবদান

কাকন বিবি, বীর প্রতীক (মৃত্যু ২০১৮ ) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, খাসিয়া আদিবাসী সন্তান, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের শিকার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি অবলম্বনকারী ও পরবর্তীতে একাধিক রণাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
কাকন বিবি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের নত্রাই খাসিয়া পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গিসয় ও মাতার নাম মেলি। পিতা-মাতার ৫ সন্তানের মধ্যে কাকন বিবি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর মূল নাম কাঁতেক নিয়তা। ডাক নাম কাকন। তবে তিনি কাকন বিবি নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁদের পরিবার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। শিশু বয়সে তিনি পিতৃ-মাতৃহারা হন। বড় বোন ও তার স্বামী তাঁকে লালন-পালন করেন। ১৫ বছর বয়সে আব্দুল মজিদ খান নামে এক পাঞ্জাবি ইপিআর সৈনিকের সথে তাঁর বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে মজিদ খান কাকন বিবিকে ফেলে রেখে ইপিআর-এর অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে পরে নিরুদ্দেশ হন। এরূপ অবস্থায় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার সাঈদ আলী নামে এক কৃষকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তখন তাঁর নাম রাখা হয় নূরজাহান বেগম। তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। নাম সখিনা। কিন্তু তাঁর ঐ বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। এরপর কাকন পুনরায় পূর্বের স্বামী আব্দুল মজিদ খানের খোঁজে পাকিস্তানি এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে ছুটে যান। জুন মাসে স্বামীর খোঁজে সিলেটের দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকায় এলে তিনি পাকহানাদার বাহিনীর নজরে পড়েন। তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। নরপিশাচরা তাঁকে আটক করে বাঙ্কারে রেখে তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। কয়েকদিন পর তাঁকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় বদলে যায় কাকন বিবির জীবন। প্রতিশোধের আগুন তাঁর অন্তরে দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকে। রহমত আলী নামে স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তিনি ৫নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর কাছে তাঁকে নিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর মীর শওকত তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শত্রুশিবিরের খবরাখবর সংগ্রহে গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব দেন। কাকন বিবি অত্যন্ত সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এক্ষেত্রে কখনো তিনি ভিক্ষুকের বেশ ধারণ করে পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে খবর নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর তথ্যমতো বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেন এবং বহু ক্ষেত্রে সফল হন। এরূপ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকবাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন। এবার এক নাগাড়ে ৭ দিন তাঁর ওপর চরম শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে গরম ছ্যাঁকা দেয়া হয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে মৃত ভেবে হানাদাররা তাদের ক্যাম্প থেকে কিছু দূরে তাঁকে ফেলে রেখে আসে। মুমুর্ষু অবস্থায় গ্রামের কিছু লোক তাঁকে উদ্ধার করে সীমান্ত পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের বালাট ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। সেখানে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এবার তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণে প্রতিজ্ঞা করেন। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে তিনি অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন। ৫নং সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে টেংরাটিলা, আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউরা, জাউয়া ব্রিজ, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূর্বিনটিলা, আধারটিলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অক্টোবর মাসে আমবাড়ি যুদ্ধে তাঁর পায়ে শত্রুর ছোড়া গুলি বিদ্ধ হলে তিনি আহত হন। তা সত্ত্বেও তিনি পরবর্তী টেংরাটিলার বড় যুদ্ধে অংশ নেন। নভেম্বর মাসের শেষদিকে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের জাউয়া ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনেও তিনি সক্রিয় অংশ নেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাকন বিবি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে শহীদ আলীর বাড়িতে এক কুড়েঘরে মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এই বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সাংবাদিক নরেন্দ্র তালুকদার পিংকুর মাধ্যমে তাঁর সন্ধান মেলে। অতঃপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাকন বিবিকে এক একর খাস জমি দান করেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব প্রদান করা হবে মর্মে ঘোষণা দেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে ২২.৭.২০১০ তারিখে স্বাক্ষরিত ‘বীর প্রতীক’ খেতাব প্রদানের একটি সনদপত্র কাকন বিবিকে প্রদান করা হয়, তবে এখনো তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত জমির ওপর নির্মিত একটি ঘরে তিনি বসবাস করে আসছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। অবশেষে ২০১৮ সালের ২১শে মার্চ তিনি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঝিরাগাঁও গ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত জমিতে সমাহিত করা হয়। তাঁর মেয়ে সখিনা স্বামী আব্দুল মতিন ও দুই পালিত কন্যা সন্তান নিয়ে কাকন বিবির গৃহে বসবাস করছেন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে সখিনা লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচিত হন। এ পরিবার সরকার থেকে কাকন বিবির নামে প্রদত্ত মাসে ১০ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা পাচ্ছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসুত্র: রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু, কাকন বিবির খোঁজে, সিলেট, নাগরী প্রকাশনী ২০১৮; কাকন বিবির কন্যা সখিনা বেগমের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার, ১১ই জুন ২০১৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড