মুক্তিযুদ্ধে কাউখালী উপজেলা (পিরোজপুর)
কাউখালী উপজেলা (পিরোজপুর) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার মুক্তিকামী জনতাও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর কাউখালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি লেহাজউদ্দিন খানের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন তালুকদার বাদশা, ডা. ধীরেন্দ্রনাথ শিকদার, আব্দুল হাই পনা, আব্দুস সাত্তার হাওলাদার, আবুল বাশার খান, মফিদুল ইসলাম দুলাল, এ বি কে এম ফাইজুল হক আবুয়াল প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে কাউখালীতে আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। পাশাপাশি কেউন্দিয়া শিক্ষা মজলিশ ক্লাবে বৈঠক করে কেউন্দিয়া হাই স্কুলমাঠে এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ছুটিতে থাকা সেনাবাহিনীর নায়েক সুবেদার আলী হোসেন শিকদার (কেউন্দিয়া) ও নায়েক সুবেদার আব্দুর শুকুর খান প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন।
২৩শে মার্চ আব্দুল হাই পনা, মফিদুল ইসলাম দুলাল ও হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে কাউখালী থানা থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৩ই এপ্রিল শামসুল আলম ডাকুয়া, দেলোয়ার হোসেন দিলু, হারুনার রশিদ সাইদ, সাইদুর রহমান সাইদ, আব্দুল হাই পনা, জসিমউদ্দিন নান্না, আজমল হোসেন ফিরোজ, মফিদুল ইসলাম দুলাল, আবুল কালাম আজাদ, শাহজাহান হাওলাদার প্রমুখ কাউখালী থানা লুট করে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহ করেন।
কাউখালী উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন দুজন। তাঁরা হলেন- মো. হাবিবুর রহমান (পিতা মোকতের আলী, কেউন্দিয়া) ও আব্দুল হাই পনা (পিতা আব্দুস সালাম তালুকদার, কেউন্দিয়া)।
পাকবাহিনী ৫ই জুন কাউখালীতে অনুপ্রবেশ করে। তারা কাউখালী বন্দরের বিআইডব্লিউটিএ ভবন এবং কাউখালী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়ার হামেদ জমাদ্দারের নেতৃত্বে কাউখালীতে -রাজাকার- বাহিনী গঠিত হয়। সাতুরিয়া কাউখালী উপজেলা সংলগ্ন একটি গ্রাম। কাউখালী উপজেলার দালাল ও রাজাকারদের মধ্যে আজিজ খান (কাউখালী বন্দর), শফি খান (কাউখালী বন্দর), রেজা তালুকদার (সুবিদপুর), মতিউর রহমান (সুবিদপুর), ইসাহাক চৌকিদার (কেউন্দিয়া), মজিদ চেয়ারম্যান (কেউন্দিয়া), আঃ রশিদ খান (কাউখালী বন্দর), নূর মৌলবী (বদরপুর), আব্দুল মালেক শেখ (রাজাকার কমান্ডার, বাকুটিয়া), ক্বারী দেলোয়ার খান (চিরাপাড়া), মোখলেছ ফরাজী (চিরাপাড়া), বেলায়েত (সাতুরিয়া), মিল্লাত জমাদ্দার (সাতুরিয়া), মওলানা আশরাফ (সাতুরিয়া), আব্দুল আউয়াল (দক্ষিণ কাউখালী), মওলানা আব্দুল রহিম (পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে কাঠি সদর আমীর, শিয়ালকাঠি), মোজাম্মেল হোসেন(নিলতী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার-দালালদের সহযোগিতায় কাউখালী উপজেলার কেউন্দিয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে মোক্তাদিদুল ইসলাম (পিতা নূরুল ইসলাম মাঝি), নূরুল আমিন (পিতা হোসেন তালুকদার), শাফায়াত হোসেন (পিতা আশ্রাব আলী), ইসমাইল হোসেন মিন্টু ও নসু (পিতা হাফেজুল ইসলাম)-কে গুলি করে হত্যা করে। এরপর কেউন্দিয়া গ্রাম ও বাজারটি লুণ্ঠন শেষে পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কাউখালী বন্দরে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শতাধিক মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন শেষে লঞ্চঘাটে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে লঞ্চঘাট সংলগ্ন আমড়াজুড়ী মৌজায় ফেলে দেয়া হতো। ঐ স্থানটি – আমড়াজুড়ী বধ্যভূমি- নামে পরিচিত। বন্দরের পাশে কামারপাড়ায় বেশ কয়েকজন নারী পাকবাহিনীর লালসার শিকার হন। গ্রামটি লুণ্ঠন শেষে তারা পুড়িয়ে দেয়। বিআইডব্লিউটিএ ক্যাম্পে কাউখালীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকাররা যুবতী মেয়েদের ধরে এনে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। তাদের একটি কক্ষে বিবস্ত্র অবস্থায় রেখে একজন-একজন করে অন্য কক্ষে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করত। অতঃপর অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আগস্ট মাসে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা কাউখালী লঞ্চঘাটে যাত্রীদের সামনে পিরোজপুরের উত্তররাণীপুর গ্রামের কালু মহাজনসহ চারজনকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে এবং দুজনকে গুলি করে হত্যা করে।
কাউখালী লঞ্চঘাটের বিআইডব্লিউটিএ ভবনটি পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। কাউখালী উপজেলার লঞ্চঘাট সংলগ্ন আমড়াজুড়ী মৌজায় একটি বধ্যভূমি রয়েছে।
৭ই মে কমান্ডার আব্দুল হাই পনা ও হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে কীর্তিপাশা নদীর পাশে পাকিস্তানপন্থী পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়, যা কীর্তিপাশা যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ১৩ জন পুলিশ নিহত হয় এবং ১৩টি রাইফেল ও একটি স্টেনগান মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। পক্ষান্তরে মোফাজ্জল আলী জমাদ্দার, আব্দুর রব খান ও আনু মিস্ত্রী নামে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মে মাসের শেষদিকে কাউখালী ও ঝালকাঠি সীমান্তে কুতুবকাঠির সেওতাখালের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয়, যা কুতুবকাঠি যুদ্ধ – নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। হানাদার বাহিনীর কয়েকটি লাশ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় গ্রামবাসী নদীতে ফেলে দেয়।
কাউখালীর গাবখান নদীর উত্তর পাড়ে মৈশানী ও দক্ষিণপাড়ে শেখের হাট গ্রামে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আব্দুল হাই পনার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে পাকবাহিনীর একটি গানবোট আক্রমণ করেন, যা শেখেরহাট গানবোট আক্রমণ- নামে খ্যাত। এতে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। কাউখালী উপজেলার কেউন্দিয়া ছিল মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। ২২শে সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা কেউন্দিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। আব্দুল হাই পনা ও হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ চালালে সেখানে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যা কেউন্দিয়া যুদ্ধ— নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পরাজিত হয় এবং ৯ জন পাকসেনা ও ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। আমান গোল, শেরে গোল ও মানিক গোল নামে ৩ জন বেলুচ সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। পাকসেনাদের ব্যবহৃত ৩টি এলএমজি, ৬টি এসএমজি, ২টি মর্টার ও বেশকিছু গেলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১৭ই নভেম্বর কাউখালী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আইরন গ্রামে হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়, যা – আইরন যুদ্ধ নামে খ্যাত। এ-যুদ্ধে আ. মাজেদ (কেউন্দিয়া) পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ৭ই ডিসেম্বর কাউখালী হানাদারমুক্ত হয়। কাউখালী উপজেলায় ১৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- আ. মাজেদ (পিতা হারেজুল ইসলাম, কেউন্দিয়া), হারুন অর রশিদ (পিতা হাসেম আলী, কেউন্দিয়া), জামালউদ্দিন (পিতা ফকেরউদ্দিন তালুকদার, কেউন্দিয়া; সেনাসদস্য), লতিফুর রহমান (পিতা ফাজেলউদ্দিন, কেউন্দিয়া), ইসমাইল হোসেন (পিতা হাফিজুর রহমান, কেউন্দিয়া), শাহজাহান হাওলাদার (পিতা মকবুল আলী হাওলাদার, আমড়াজুড়ী), ওমর ফারুক (পিতা সৈয়দুর রহমান, আমড়াজুড়ী), আতাহার আলী (পিতা মমিনউদ্দিন, বাশুরি; আনসার সদস্য), বেলায়েত হোসেন (পিতা আফেজ সরদার, গোসনতারা), হাবিবুর রহমান (পিতা মুজাহার আলী খন্দকার, জয়কুল), আবুল কালাম আজাদ (পিতা মতিয়ার রহমান, কচুয়াকাঠি), হেমায়েত উদ্দিন তালুকদার (পিতা হোসেন আলী তালুকদার, বেতকা), আব্দুর রহমান খান (পিতা নেছার আলী খান, নাংগলী) ও এনামুল হক (পিতা মতিয়া রহমান, কেউন্দিয়া)।
কাউখালী লঞ্চঘাট বধ্যভূমি স্মরণে নিকটবর্তী স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া কাউখালী উপজেলার কেউন্দিয়া গ্রামে শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [আব্দুল লতিফ খসরু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড