You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া উপজেলা (সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া উপজেলা (সাতক্ষীরা)

কলারোয়া উপজেলা (সাতক্ষীরা) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাতক্ষীরা থেকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী মমতাজ আহমদ, শিক্ষকনেতা শেখ আমানুল্লাহ (ভাষাসৈনিক ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ), এডভোকেট মনসুর আহমেদ (সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক), নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী (বাসার) প্রমুখ ভাষার অধিকার থেকে স্বাধিকার আন্দোলন পর্যন্ত কলারোয়ার সাধারণ মানুষদের অধিকতর সচেতন করে তোলেন। তাঁরা ১৯৭০-এর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গঠন ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে কলারোয়ায় আওয়ামী লীগ সব আসনে বিজয় অর্জন করে। সমগ্র দেশেই এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে সারা দেশের মতো কলারোয়ায়ও তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ সে-আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তোলেন।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সমগ্র দেশের মতো কলারোয়ায়ও হরতাল পালিত হয়। এ-সময় কেন্দ্র নির্দেশিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর কলারোয়া থানা শাখা গঠিত হয়। মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ কলারোয়া শাখা গঠিত হয়। এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ আহমদ ও শেখ আমানুল্লাহ। পরিষদের অন্যরা ছিলেন সহ-সভাপতি বি এম নজরুল ইসলাম (কলারোয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), সদস্য ডা. আহম্মদ হোসেন, এস এম এন্তাজ আলী, রিয়াজউদ্দীন, আনোয়ার হোসেন, শ্যামাপদ শেঠ এবং জয়নগরের চেয়ারম্যান রিয়াজউদ্দীন। এর পাশাপাশি জনগণকে সংঘবদ্ধ ও উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট একটি আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। এর উপদেষ্টা ছিলেন মমতাজ আহমদ এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে বি এম নজরুল ইসলাম ও শেখ আমানুল্লাহ। কলারোয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কার্যালয় পরিষদের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ পরিষদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল প্রচারণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরা, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করে মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক গণযুদ্ধের রূপ দেয়া, অস্ত্র সংগ্রহ করা ইত্যাদি। উক্ত তিন পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
কলারোয়ায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সঙ্গে আরো ছিলেন কমান্ডার আব্দুল গফফার, মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
২৮শে এপ্রিল পাকবাহিনী কলারোয়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং কলারোয়া থানা ও পাইলট স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনী কলারোয়ায় ক্যাম্প স্থাপনের পর স্থানীয় <মুসলিম লীগ-এর অধিকাংশ নেতাকর্মী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সাতক্ষীরার মুসলিম লীগ নেতা ডা. দিদার বখত খান (ডি বি খান)-এর নেতৃত্বে কলারোয়ায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিল কলারোয়া পৌরসভার ঝিকরা গ্রামের শেখ আবুল কাসেম। শান্তি কমিটির প্রায় ১০০ জন সক্রিয় সদস্য ছিল। জালালাবাদ ইউনিয়নের সৈয়দ এরশাদ হোসেনও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
পাকিস্তান রক্ষার নামে বাঙালি নিধন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে এরপর গঠিত হয় রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। এ তিন বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় দুশ। শান্তি কমিটির সদস্যরা নিরস্ত্র হলেও এরা ছিল সশস্ত্র। এরা পাকবাহিনীকে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেরাও হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত ছিল। পৈশাচিকতায় আজো যাদের নাম কলারোয়ার মানুষ ঘৃণা ও আতঙ্কের সঙ্গে স্মরণ করে, তাদের মধ্যে ডা. মোকছেদ আলী (বামনখালি), আব্দুর রশিদ (লোহাকুড়া), তোফাজ্জেল হোসেন (দেয়াড়া), জল্লাদ আব্দুল হাই (ওফাপুর), কমান্ডার আয়নুদ্দিন গাজী (গদখালি), কমান্ডার কওছার আলী (গদখালি), পিয়ার মোহাম্মদ (সোনাবাড়িয়া), কমান্ডার আকবর আলী (ঝিকরা), মতিয়ার রহমান (পাথরঘাটা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
কলারোয়া থানায় পাকবাহিনীর নৃশংসতার প্রথম শিকার হন মাহমুদপুর গ্রামের আফসারউদ্দীন আহমেদ। ৩০শে এপ্রিল পাকবাহিনী তাকে হত্যা করে। একই দিন মুরারিকাঠি গ্রামের পালপাড়ায় ৯ জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা মুরারিকাঠি পালপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। এপ্রিল মাসের মধ্যভাগে ইলিশপুর গ্রামে আরেকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা ইলিশপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। এতে ৩-৪ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ১৭ই মে কলারোয়া থানা গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ৫ জন ছাত্র শহীদ হন। জুলাই মাসে খুলনা থেকে আগত ৬ জন ছাত্রকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে কুখ্যাত রাজাকার ডা. মোকছেদ আলীর নির্দেশে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী এদেশীয় নরপশুরা গুলি করে। তাঁদের মধ্যে ৩ জন গুরুতরভাবে আহত হন এবং অপর ৩ জন বেঁচে যান। আহত ৩ জনকে অর্ধমৃত অবস্থায় রাজাকার বাহিনীর শ্বাপদেরা কলারোয়া থানার পাশে মাটিতে পুঁতে রাখে এবং তাঁদের মৃত্যু হয়। আর যাঁরা বেঁচে যান তাঁরা পরে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
কলারোয়া পাইলট হাইস্কুল ও কলারোয়া থানা ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। কলারোয়া উপজেলার অনেক গণকবর অযত্ন-অবহেলায় নিশ্চিহ্নপ্রায়। যে-কটি এখনো টিকে আছে সেগুলো হলো মুরারিকাঠি পালপাড়া গণকবর, কলারোয়া ফুটবল মাঠ ও থানা সংলগ্ন গণকবর, বালিয়াডাঙ্গা বাজার গণকবর, গয়ড়া বাজার গণকবর, সোনাবাড়িয়া মোড় ও হিন্দুপাড়া গণকবর এবং বামনখালি ঘোষপাড়া গণকবর।
কলারোয়ায় পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো -হিজলদি পাকক্যাম্প যুদ্ধ, ইলিশপুর রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ সোনাবাড়িয়া ক্যাম্প যুদ্ধ, খোদ যুদ্ধ ও মাদরা ক্যাম্প যুদ্ধ। ২৭শে আগস্ট সংঘটিত হিজলদি পাকক্যাম্প যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং হিজলদি মুক্ত হয়। এরপর চন্দনপুর হাইস্কুলে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইলিশপুর রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে ৬ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। ১৭ থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সংঘটিত সোনাবাড়িয়া ক্যাম্প যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ১৫ই অক্টোবর সংঘটিত খোদ যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ৯ই নভেম্বর সংঘটিত মাদরা ক্যাম্প যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন
৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে কলারোয়া ক্যাম্প আক্রমণ করলে পাকবাহিনী পালিয়ে যায় এবং কলারোয়া হানাদারমুক্ত হয়।
কলারোয়ার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জাকারিয়া (পিতা কেরামত আলী, বৈদ্যপুর; আনসার সদস্য, বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ), হাফিজউদ্দীন মোল্লা (পিতা তছিরউদ্দীন মোল্লা, কাউরিয়া; ছাত্র, বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ), আবুবকর গাজী (পিতা ফকির আলী গাজী, কাউরিয়া; কৃষক, তালা থানার মাগুরা যুদ্ধে শহীদ), ইমাদুল হক (পিতা জাহা বকস দালাল, বাগাডাঙ্গা; ছাত্র), নূর মোহাম্মদ (পিতা ইছাহক সরদার, ধানঘোরা; কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), সোহরাব হোসেন (পিতা আজব আলী সরদার, পাকুড়িয়া; ছাত্র), এস এম এন্তাজ আলী (পিতা আহাদউল্লাহ সরদার, বোয়ালিয়া; রাজনীতিবিদ) এবং আফসারউদ্দীন আহমেদ (পিতা বজলে রহমান সরদার, মাহমুদপুর; প্রাক্তন সৈনিক ও রাজনীতিবিদ)।
কলারোয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কলারোয়া ফুটবল মাঠে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়স্তম্ভ ‘স্বাধীনতা’। বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদদের গণকবরে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিফলক। এছাড়া কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- শহীদ জাকারিয়া সড়ক (কলারোয়া ফুটবল মাঠ থেকে সরসকাঠি বাজার পর্যন্ত), শহীদ হাফিজউদ্দীন মোল্লা সড়ক (কলারোয়া থানা মোড় থেকে সোনাবাড়িয়া বাজার পর্যন্ত), শহীদ আবুবকর গাজী সড়ক (বাগুড়ি মোড় থেকে সোনাবাড়িয়া বাজার পর্যন্ত), শহীদ ইমাদুল হক সড়ক (কলারোয়া কোল্ডস্টোরেজ মোড় থেকে বালিয়াডাঙ্গা বাজার পর্যন্ত), শহীদ নূর মোহাম্মদ সড়ক (কাজীরহাট বাজার থেকে গয়ড়া বাজার পর্যন্ত) এবং শহীদ সোহরাব হোসেন সড়ক (কাজীরহাট মোড় থেকে খোদ বাজার পর্যন্ত)। [শুভ্র আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড