মুক্তিযুদ্ধে কলমাকান্দা উপজেলা (নেত্রকোনা)
কলমাকান্দা উপজেলা (নেত্রকোনা) সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগ ও এর প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে সরকার গঠন করতে না দেয়ায় বাংলাদেশের সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ দিকনির্দেশনা পেয়ে কলমাকান্দায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এডভোকেট সাদিরউদ্দিন আহমেদ এমএনএ, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া এমপিএ, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াব আলী, সাধারণ সম্পাদক শামছুল হুদা তালুকদার ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জব্বার আনসারী এ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন।
১৩ই মার্চ কলমাকান্দায় ডা. মোসলেম উদ্দিন আহাম্মদকে আহ্বায়ক ও শামছুল হুদা তালুকদারকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মনতলা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সাদিরউদ্দিন বিশ্বাসকে গারো ও হাজংদের তৈরি তীর-ধনুক ও বল্লম সংগ্রহ করে এলাকার আন্দোলনকারী ছাত্র-যুবকদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে ছাত্র- জনতা কলমাকান্দা বাজারে পাকিস্তানের পতাকা এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের ছবিতে অগ্নিসংযোগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।
আব্দুল মজিদ তারা মিয়া এমপিএ, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াব আলী ও সাধারণ সম্পাদক শামছুল হুদা তালুকদার, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মোসলেম উদ্দিন আহাম্মদ, সাদিরউদ্দিন বিশ্বাস, আব্দুল জব্বার আনসারী, আব্দুল কুদ্দুস, আক্কাস আলী শেখ, রজব আলী ফকির প্রমুখ কলমাকান্দায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর কলমাকান্দা থানার একজন জমাদার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। কলমাকান্দায় সংগ্রাম কমিটি ডামি রাইফেল দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। ২৫শে মার্চ ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে কলমাকান্দা সীমান্ত ফাঁড়ির বাঙালি ইপিআর, পুলিশ ও সেনা সদস্যরা এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ইয়ুথ ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরে সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলা, রংড়া, মাহাদেও এবং দেশের ভেতরের বিশরপাশা ইয়ুথ ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠান। সেখান থেকে বাছাই করে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের তুরায় অবস্থিত স্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কমান্ডার মো. আব্দুল খালেক-সহ ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা তুরা থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বিশরপাশা গ্রামের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
৩০শে এপ্রিল পাকবাহিনী কলমাকান্দায় অনুপ্রবেশ করে। এদিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে তারা চলে যায়। পরে পাকবাহিনী কলমাকান্দায় স্থায়ীভাবে অবস্থান নিয়ে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
কলমাকান্দা থানার মুসলিম লীগ নেতা চত্রমপুর গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে থানা সদরে একটি দালাল চক্র গড়ে ওঠে। পাকহানাদারদের সহযোগিতা করার জন্য সে কলমাকান্দায় শান্তি কমিটি গঠন করে এবং নিজে আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করে। তার উদ্যোগে কলমাকান্দার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিডি সদস্যদের নিয়ে ২১ সদস্যবিশিষ্ট ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয়। বড়খাপন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আলী, নাজিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামছুল হুদা, কৈলাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল, পোগলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোজাফফর বেপারী স্ব-স্ব ইউনিয়নে অগ্নিসংযোগ, অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন, নারীধর্ষণ ও গণহত্যার মতো ঘৃণ্যতম কর্মকাণ্ড চালায়। প্রভাবশালী দালালদের প্ররোচনায় এলাকার অনেকে অর্থের লোভে -রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হয়। পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি- (পিডিপি), মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী- ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল। এসব দলের নেতা-কর্মীরা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। কলমাকান্দার উল্লেখযোগ্য অন্য রাজাকাররা হলো- একদিল মোড়ল, জব্বর আলী, আব্দুল হেকিম, আমিন, দিয়ার হোসেন মিয়া প্রমুখ।
৩০শে এপ্রিল কলমাকান্দায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশের পর থেকেই দালালরা দলবদ্ধ হয়ে হিন্দুদের বাড়িঘর দখল, অর্থসম্পদ লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যা ও নানা রকম নির্যাতনের হলি খেলায় মেতে ওঠে। অনুপ্রবেশের দিনই বেশ ক’টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এদিন তারা ডা. মোসলেম উদ্দিন আহাম্মদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে। একই দিনে তারা চত্রমপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মঞ্জুরুল হকের বাড়িতে, বাশাউড়া গ্রামের সতীশচন্দ্র সাহা ও প্রভাত চন্দর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বিশরপাশা গ্রামের দিলীপ সাহা, গুজাখুলিয়া গ্রামের দিগেন্দ্র ভেন্ডার, কালা আবু, ডুপিয়ারকোনার কালাচান তালুকদার, তেলিগাঁও গ্রামের হায়দার মোড়ল, শাদত মোড়ল, বাহাদুরকান্দার তালে হোসেন মোড়লের বাড়িতে অগুন দেয়। এছাড়া ভবানীপুর, গৌরীপুর, কুয়ারপাড়-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। কলমাকান্দা বাজারে যতীন্দ্রনাথের দোতলা বাড়িটি দালালরা দখল করে নেয়। তারা বাড়ির সমস্ত মাল লুণ্ঠন করে। দূর্লভপুরে কালাচান তালুকদারের বাড়ি, বাসাউড়া গ্রামের সতীশ বাবুর বাড়িও লুট করা হয়।
কলমাকান্দায় পাকবাহিনী প্রবেশের পর রাজাকার, আলবদরদের সহযোগিতায় প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারীদের ধরে এনে ক্যাম্পে নির্যাতন করা হতো। চানপুর গ্রামের রোশেদা উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মহিষাশুড়া হাওড়ে আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে মারিয়া নামের এক নারীকে তুলে আনা হয় কলমাকান্দা ক্যাম্পে। ক্রমাগত ধর্ষণের শিকার মারিয়া ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মুক্তাঞ্চল সীমান্তবর্তী গোবিন্দপুর গিয়ে অতিরিক্ত রক্তরণে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া অনেক নারী দালাল, রাজাকার ও পাকবাহিনী দ্বারা ধর্ষিত হন।
কলমাকান্দা থানার বিভিন্ন গ্রামের অনেক নিরীহ মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনী ও দালালচক্র হত্যা করে। যারা হত্যার শিকার হন, তাদের মধ্যে আমিরুল ইসলাম (রঘুরামপুর), তালে হোসেন মোড়ল (বাহাদুরপুর), কৈলাশ চন্দ্র পাল (সিদলী), আব্দুল খালেক (নাজিরপুর), মানিক চন্দ্ৰ সাহা (গোজাবুলিয়া), দিলীপ সাহা (বিশরপাশা), কালাচাঁন তালুকদার (ডপিয়ারকোনা) ও মহর আলী (আজগড়া)-র নাম জানা যায়।
কলমাকান্দায় পাকবাহিনী থানা ভবনকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এ উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি রয়েছে – উব্ধাখালী নদীঘাট বধ্যভূমি ও বাকতা নদী বধ্যভূমি।
২৯শে মে সুবেদার মোবারক আলী খান কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা-সহ কলমাকান্দা থানা সদরে অবস্থান নেন। এ খবর পেয়ে একদল পাকসেনা তাঁদের আক্রমণ করে। আকস্মিক আক্রমণের পর মুক্তিযোদ্ধারা নৌকায় উঠে উদ্ধাখালী নদী দিয়ে ভাটির মুক্তাঞ্চলে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সুবেদার মোবারক আলী খান-সহ মূল দলের মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে যেতে পারলেও প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত দুজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আলী উছমান গণি দালালদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা নির্মম নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করে।
১৩ই জুলাই কোম্পানি কমান্ডার তফাজ্জল হেসেন চুন্নু তাঁর বাহিনী নিয়ে ৪টি ভাগে বিভক্ত হয়ে কলমাকান্দা থানা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ সময় থানার দারোগা সিদ্দিকুর রহমান, তিনজন পুলিশ ও ৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এদিন থানার অস্ত্রাগার থেকে ২৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১টি ব্যাটাগান, ১টি বন্দুক ও প্রচুর গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
২৬শে জুলাই কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল হক তারার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর বাজার সংলগ্ন বাকতা নদীতে পাকবাহিনীর একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। নাজিরপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত এ-যুদ্ধে আব্দুল আজিজ (নেত্রকোনা), ফজলুল হক (নেত্রকোনা), ইয়ার মাহমুদ (মুক্তাগাছা), ভবতোষ চন্দ্র দাস (মুক্তাগাছা), নুরুজ্জামান (মুক্তাগাছা), দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস (মুক্তাগাছা), জামাল উদ্দিন (জামালপুর) – এ ৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ১ জন পথচারী শহীদ হন। গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত নাজমুল হক তারার কণ্ঠনালী ছিড়ে যায়। অন্যদিকে ৩ পাকসেনা নিহত ও তাদের বেশ কয়েকজন আহত হয়।
অক্টোবর মাসে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল খালেক (পিতা মো. রিয়াজ উদ্দিন, মনতলা)-এর নেতৃত্বে কলমাকন্দা থানা আক্রমণ করা হয়। এ আক্রমণের সময় কমান্ডার আব্দুল খালেক ও মুক্তিযোদ্ধা সুরেশ মারাক মারাত্মকভাবে আহত হন। ৭ই ডিসেম্বর কলমাকান্দা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। কলমাকান্দার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- লে. কর্নেল আনোয়ারুল ইসলাম (পিতা আব্দুল হাফিজ, মহনপুর; ২৯শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে শহীদ), পাইলট ইসলাম উদ্দিন (পিতা আব্দুল মজিদ মন্ডল, রঘুরামপুর; ৭ই অক্টোবর বল্লা বাজার যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মান্নান মিয়া (পিতা শহর আলী, জিগাতলা; ২রা আগস্ট শিববাড়ি যুদ্ধে শহীদ), হাফিজ উদ্দিন (পিতা সদর আলী, লেঙ্গুড়া; ১২ই মে ইপিআর ডালু যুদ্ধে শহীদ) এবং ইপিআর আবুল কাশেম (পিতা আলীম উদ্দিন, উদয়পুর; ঢাকায় শহীদ)। শহীদদের স্মরণে কলমাকান্দায় কিছু স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে কলমাকান্দা মধ্য বাজারে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক, নাজিরপুরে ৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে স্মৃতিসৌধ, নির্যাতিত নারী মারিয়া স্মরণে গোবিন্দপুরে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। [জুলফিকার আলী শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড