You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.13 | কর্ণপাড়া-পান্তাপাড়া-পাথরিয়াপাড় যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

কর্ণপাড়া-পান্তাপাড়া-পাথরিয়াপাড় যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর)

কর্ণপাড়া-পান্তাপাড়া-পাথরিয়াপাড় যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় ১৩ই নভেম্বর ও ৩রা ডিসেম্বর। এতে ২ জন পাকসেনা ও ৪ জন রাজাকার- গুরুতর আহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৩ই নভেম্বর শনিবার কালকিনির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল হাকিম তালুকদারের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল বিস্ফোরক দিয়ে কালকিনি থানার কর্ণপাড়া ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। ফলে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়। কমান্ডার আবদুল হাকিম তালুকদার ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গোপালপুর ও বালিগ্রাম ইউনিয়নের মিলনস্থল পাথরিয়াপাড় ব্রিজের দুই পাড়ে অবস্থান নেন। পূর্ব থেকেই কমান্ডার আবদুল হাকিম তালুকদার তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি জিপ-সহ একটি বড় কনভয় পাথরিয়াপাড় ব্রিজ অতিক্রমকালে মুক্তিযোদ্ধা এছহাক সরদার প্রথম গ্রেনেড চার্জ করেন। একই সঙ্গে এসএলআর, মার্ক থ্রি, মার্ক ফোর রাইফেল এবং স্টেনগান থেকেও গুলিবর্ষণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং স্বয়ংক্রিয় গান থেকে অনবরত গোলাবর্ষণের ফলে পাকিস্তানি সেনাদের ৫টি জিপ বিধ্বস্ত হয়। পরে পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজের পাশে পড়ে থাকা বিকল গাড়িগুলো তুলে নিয়ে যায়। এখানে অনেক পাকসেনা ও রাজাকার- হতাহত হয়।
পাথরিয়াপাড় ব্রিজ যুদ্ধ হয় ৩রা ডিসেম্বর। এদিন সকালে পাকিস্তানি সেনাদের একটি বড় কনভয় মাদারীপুর থেকে এসে পাথরিয়াপাড় ব্রিজের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়। পূর্ব থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের আশেপাশে বাংকার খুঁড়ে পজিশন নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছিলেন। এসব বাংকারে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দিনভর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করেন। এলাকার হাজার-হাজার গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। ছোট- ছোট ছেলেমেয়ে ও নারী-পুরুষরা রান্না করা খাবার ও পানি শত্রুসেনাদের গুলি উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারে পৌঁছে দেয়। সারাদিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দমাতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা পাথরিয়াপাড়-কর্ণপাড়া থেকে সন্ধ্যা নাগাদ পজিশন প্রত্যাহার করে পালিয়ে যায়। রাজাকার ফটিক উপায়ান্তর না দেখে একটি মার্ক ফোর রাইফেল ও এক পেটি গুলিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা ও ৪ জন রাজাকার গুরুতর আহত হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন দেওয়ান শহীদ হন। তিনি কোরআনে হাফেজ ছিলেন। বুকে কোরআন শরিফ বাঁধা অবস্থায় বীরত্বের সঙ্গে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি শহীদ হন। এখানে মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান খলিফাও (পিতা নুর মহম্মদ খলিফা, আলীপুর) শহীদ হন। পরদিন পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি-আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। তাই পাথরিয়াপাড়ে আরো শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে কমান্ডার আবদুল হাকিম তালুকদার ও তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা মহাসড়কের পাশে এম্বুশ পেতে অপেক্ষা করেন। দুপুর ১টার পর মুক্তিযোদ্ধারা ডাসার বি এম কোয়ানির ক্যাম্পে চলে যান। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর মাদারীপুর থেকে আলবদর ও পাকিস্তানি সেনারা এসে বীরমোহন হাইস্কুলের নিকট বটতলায় পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে নিরীহ ১৪ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
প্রশিক্ষিত ও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে এ ধরনের সম্মুখ যুদ্ধে নিজ অবস্থানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনড়ভাবে টিকে থাকতে পারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট বিজয় ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যূহ ভেদ করে যেতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা মাদারীপুরে ফেরত যায়। এটা তাদের জন্য ছিল একটা বড় পরাজয়। একজন পাকিস্তানি সেনাও নিহত না-হলেও এ-যুদ্ধের ফলাফলের তাৎপর্য সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে। পাকিস্তানি সেনারা চলে যাবার পরপর আনন্দোল্লাসে তারা রাস্তায় নেমে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় নিয়ে মিছিল করে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়। তারা এতটাই আনন্দ প্রকাশ করে যেন মাদারীপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধে আশপাশের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা করে। ক্রলিং করে ট্রেঞ্চে গিয়ে তারা ডাব, দুধ ও অন্যান্য খাবার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড