যুদ্ধাহত নারী মুক্তিযোদ্ধা করুণা বেগম
করুণা বেগম (১৯৫৩-২০০৯) যুদ্ধাহত নারী মুক্তিযোদ্ধা। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি ১৯৫৩ সালের ২রা এপ্রিল বরিশাল জেলার মুলাদী থানার অন্তর্গত পাতারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শাহ আলী আহমেদ খন্দকার এবং মাতার নাম জোবেদা খাতুন। করুণা বেগম পাতারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মুলাদী মাহমুদজান উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ইপিআর-এর প্রাক্তন সৈনিক ও কাজীরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদুল হাসান চুন্নুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও নির্দেশের পর থেকেই শহীদুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং এলাকার তরুণদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক হিসেবে মুলাদী এলাকায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুলাদী থানার নন্দীরবাজার এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদুল হাসান আহত ও বন্দি হন। তাঁর দুই সহযোদ্ধাসহ এক সঙ্গে বেঁধে মুলাদীর জয়ন্তী নদীতীরে নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
এ ঘটনার পরপরই স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে করুণা বেগম গেরিলা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্প নেন। শ্বাশুড়ির কাছে তিন বছর বয়সী একমাত্র সন্তান মান্নাকে রেখে রাতের অন্ধকারে তিনি গৌরনদী থানার নলচিড়ার মুক্তিবাহিনী শিবিরে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন নিজাম উদ্দিন ও মো. কুতুব উদ্দিন আহমেদ। পূর্বপরিচিত কুতুব উদ্দিন করুণা বেগমকে তাঁদের শিবিরে দেখে আশ্চর্যান্বিত হন। তাঁদের কাছে করুণা বেগম মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে প্রথমে তাঁরা কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করুণা বেগম তাঁদের জানান যে, তিনি পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করবেন এবং তিনি যে নারী তা শিবিরের কেউ বুঝতে পারবে না। এতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও অপারেশনের সময় হয়ত কিছুটা সুবিধা হবে। পরদিন সন্ধ্যায় তিনি পুরুষের বেশে শিবিরে আসেন। তিনি গ্রেনেড, স্টেনগান ও রাইফেল চালানো ছাড়াও বিস্ফোরক দ্রব্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। মূলত তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি বরিশালের বামরাইল, কাশিমাবাদ, বাটাজোড়, নন্দীবাজার, টরকিসহ বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়ে সফল্যের পরিচয় দেন। তাছাড়া তাঁর দায়িত্ব ছিল ছদ্মবেশে শত্রু-ছাউনির কাছে গিয়ে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণপূর্বক মুক্তিযোদ্ধাদের অবগত করা।
বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন করুণা বেগম। কাশিমাবাদ যুদ্ধে তিনি একজন ভিখারিণীর বেশে গ্রেনেড হাতে পুলের কাছে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাংকারের ওপর তা নিক্ষেপ করে নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা পেছন থেকে হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকার আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০ জন সৈন্য ও কয়েকজন রাজাকার- হতাহত হয়। পরে করুণা বেগম বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি চলন্ত ভ্যানের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে আহত করেন।
অধিনায়ক মো. কুতুব উদ্দিনের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযোদ্ধা ৬ই নভেম্বর বামরাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। আক্রমণ শুরু করার পূর্বে কুতুব উদ্দিন তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবক চান, যিনি প্রথমে গিয়ে শত্রুর বাংকার ধ্বংস
করবেন। মুহূর্তেই করুণা বেগম এ কার্য সম্পাদনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং কুতুব উদ্দিন করুণা বেগমকে দুটি গ্রেনেড দিয়ে শত্রুর বাংকার ধ্বংস করতে পাঠান। ক্রলিং করে শত্রুর অবস্থানের কাছে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন করুণা বেগম। তাঁর লক্ষ্যভেদী গ্রেনেডে শত্রুর বাংকারটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত আক্রমণ করে সেই এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হতাহত করে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।
গৌরনদীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি স্টিলবডি লঞ্চের ওপর আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেন মুক্তিযোদ্ধা কুতুব উদ্দিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ই নভেম্বর লঞ্চটি যখন নদীতীরে ভেড়ে, তখন নদীর পাড়ে পজিশন নিয়ে থাকা করুণা বেগম লঞ্চের ভেতরে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এর সঙ্গে-সঙ্গেই মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চের ওপর ও আশপাশে গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। ফলে যেসব পাকিস্তানি সৈন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তারাও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় এবং লঞ্চটি ধ্বংস হয়ে যায় এ অপারেশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
২১শে নভেম্বর সংঘটিত মাহিলারা অপারেশন ছিল করুণা বেগমের শেষ যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাহিলারায় শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে সেখান থেকে তারা আশপাশের গ্রামগুলোর বাসীন্দাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধারা মাহিলারা ঘাঁটি আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের দিকে এগিয়ে যায়। করুণা বেগমের অবস্থান ছিল মাহিলারা পুল সংলগ্ন এলাকায়। প্রতিবারের মতো এবারও তাঁর হাতে ছিল স্টেনগান ও সঙ্গে দুটি গ্রেনেড। তখন চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছে। অধিনায়কের নির্দেশ অনুযায়ী গ্রেনেড নিক্ষেপ করার জন্য এগিয়ে যান করুণা বেগম। হঠাৎ শত্রুর একটি গুলি এসে তাঁর ডান পায়ে বিদ্ধ হয়। তখন সেখানে তাঁকে চিকিৎসা দেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না এবং আশপাশের কোনো হাসপাতালে নেয়াও সম্ভব ছিল না। ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বিধায় সহযোদ্ধারা গামছা দিয়ে তাঁর ক্ষতস্থান পেঁচিয়ে রাখেন এবং নদীর পানি দিয়ে তাঁর ক্ষতস্থান ধোয়ার চেষ্টা করেন। তারপর রক্তে ভেজা কাপড় নদীতে ফেলে দেয়া হয় যেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা তাদের দোসররা কিছু বুঝতে না পারে। এতদিন পরে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন বুঝতে পারেন যে, করুণা একজন নারী।
এদিকে নিজেদের শিবিরে আসার পর করুণা বেগমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে না পাঠালে তিনি হয়ত আর বাঁচবেন না। ছদ্মবেশে নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে গোপনে বরিশাল সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের চিকিৎসকরাও সাবধানতার সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন যেন তিনি শত্রুপক্ষের হাতে গ্রেফতার না হন৷
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। কিন্তু আহত করুণা বেগমের চিকিৎসার তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় ডিসেম্বরের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে পরবর্তীতে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তবে তাঁর পা আর কখনোই পুরোপুরি ভালো হয়নি। সারাজীবনের জন্য তাঁকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তাঁকে দেখতে গিয়ে তাঁর সাহসিকতার প্রশংসা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী- এবং আরো অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে করুণা বেগমকে একটি পত্রও পাঠিয়েছিলেন। পত্রটি হলো-
প্রিয় বোন করুনা,
বিগত স্বাধীনতা সংগ্রামে তুমি যে ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহসিকতা ও নির্ভীকতা দেখিয়েছ তা দানিয়ার ইতিহাসে দেশ-প্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছে। তাই দেশ আজ তোমাদের জন্য গর্বিত। দেশকে স্বাধীন করার যে মহান দায়িত্ব তোমরা পালন করেছ সেজন্য বাঙ্গালীরা তোমাদের কাছে চিরঋণী।
তাই বাংলাদেশ সরকার, জনগণ ও আমার নিজের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো।
(শেখ মুজিবর রহমান)
দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ শেষ হলেও করুণা বেগমের জীবনযুদ্ধ শেষ হয়নি। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রাকুদিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা মানিকের সাথে করুণা বেগমের বিয়ে হয়। উল্লেখ্য, গোলাম মোস্তফা মানিক ও করুণা বেগম একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু পঙ্গুত্বের কারণে শ্বশুরবাড়ির কেউ করুণা বেগমকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। এক পর্যায়ে করুণা বেগমকে নিয়ে তাঁর স্বামী বাড়ি ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন। খুব কষ্টে সংসার চলছিল তাঁদের। ঢাকায় তখন তাঁদের মাথা গোঁজার মতো কোনো ঠাঁই ছিল না। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী হিসেবে বসবাসের জন্য করুণা বেগমকে ১৪৪ নম্বর লালবাগে একটি বাড়ির অংশ বরাদ্দ দেন। সেই জায়গায় আবাসস্থল নির্মাণ করে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করুণা বেগম। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁর রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। পরে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিহ্নিত হয় যে, তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে তাঁর অনেক ধারকর্জ হয়ে যায়। ফলে তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের পড়ালেখার খরচও ঠিকমতো চালাতে পারছিলেন না তিনি।
অবহেলা, দারিদ্র্য আর ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা করুণা বেগম। অবশেষে ২০০৯ সালের ২২শে জানুয়ারি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করতে পেরেছেন, কিন্তু দারিদ্র্য আর ক্যান্সারকে পরাজিত করতে পারেননি। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড