মুক্তিযুদ্ধে কমলনগর উপজেলা
কমলনগর উপজেলা (লক্ষ্মীপুর) ১৯৭১ সালে রামগতি থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০৬ সালে রামগতি উপজেলাকে বিভক্ত করে কমলনগর উপজেলা গঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে কমলনগর এবং নোয়াখালীর রামগতি, রামগঞ্জ, রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা গঠিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে রামগতি থেকে আওয়ামী লীগ- নেতা এম সিরাজুল ইসলাম এমপিএ নির্বাচিত হন। তাঁর বাড়ি রামগতির উত্তর অঞ্চল কমলনগরে। ছাত্রনেতা ও ডাকসু-র তৎকালীন ভিপি আ স ম আবদুর রব রামগতি ও কমলনগরের সন্তান। ছাত্র আন্দোলন বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্বে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা কমলনগর এলাকার মানুষকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী কমলনগরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধু সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। একই দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ৩রা মার্চের পর কমলনগরের রাস্তায় ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের বাড়িতে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ এ গান বাজতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর সারাদেশের মতো কমলনগরও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য মরণপণ যুদ্ধ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে কমলনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। গভীররাতে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি নিধন শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কমলনগরে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, ফজলুর রহমান চেয়ারম্যান, সুলতান আহম্মদ ভূঁইয়া, ছাত্রনেতা ভিপি আবু তাহের ছাত্র-জনতাকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন।
কমলনগরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানির কারণে কমলনগরকে তখন দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ইপিআর-এর অনেক বাঙালি সদস্য ছুটি নিয়ে এ এলাকায় ছুটে আসেন। প্রশিক্ষিত ও ছুটি ভোগরত সেনা, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর নেতা-কর্মীরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। ডামি বন্দুক ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো হতো। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর অনেকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। ঢাকা থেকে ছাত্রনেতারা এসে কমলনগরের অনেক ছাত্র-যুবককে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রেরণ করেন। কমলনগরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- এম সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, মো. আবু তাহের, মো. শাহজাহান চৌধুরী, সুবেদার (অব.) আব্দুল মালেক, আবুল বারাকাত দুলাল, নিজাম উদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ। এম সিরাজুল ইসলাম (পিতা আলহাজ্ব আমিন উদ্দীন পাটওয়ারী, চর লরেন্স)-এর জন্ম ১৯৩৫ সালে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকাকালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে
জড়িত হন। তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। ভাষা আন্দোলন-এ ও অংশ নেন। আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেন। কারাগারে থেকে আইএ পরীক্ষা দেন। ১৯৫৪ সাল থেকে দৈনিক ইত্তেফাক-এর নোয়াখালী সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও রামগতি থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হন। বঙ্গবন্ধু দুবার তাঁর বাড়িতে আসেন। ১৯৭০ সালে রামগতি এলাকা থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি বেগমগঞ্জ হয়ে ভারতে যান। সেখানে ১৬টি যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করেন। যুবকদের রিক্রুট করে বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রেরণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। ৭ই ডিসেম্বর ভারত থেকে মাইজদী আসেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন।
মো. আবু তাহের (পিতা মৌ. আব্দুল বারী, চর জগবন্ধু)-এর জন্ম ১৯৪৮ সালে। তিনি চরসীতা তোরাব আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর লক্ষ্মীপুর কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে আইএ এবং ১৯৭২ সালে বিএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন, কিন্তু এমএ পরীক্ষা দিতে পারেননি। স্কুল জীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি ও ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। ১৯৭০ সালে সামরিক আইনের মামলায় এক বছর সাজা ভোগ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর এলাকায় এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এপ্রিলে ভারতে গিয়ে আ স ম আব্দুর রবের সহযোগিতায় উত্তর প্রদেশের টেন্ডুয়ায় প্রশিক্ষণ নেন। দেশে এসে আন্ডার চরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ওঠেন যুদ্ধপরিচালনার সুবিধার্থে রামগতিকে দুভাগে ভাগ করা হলে উত্তর ভাগের কমান্ডার হন। রামগতি থানা অপারেশনসহ এ এলাকার প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে অংশ নেন। চরসীতা, জমিদারহাট অপারেশনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। জমিদারহাট অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নেতৃত্বে রাজাকার-দের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এ-যুদ্ধে ২৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে এখানে রাজাকারদের পতন ঘটে।
মো. শাহজাহান চৌধুরী (পিতা আজিজ উল্যা, চর জাঙ্গালিয়া)-র জন্ম ১৯৫১ সালে। ১৯৬৭ সালে লক্ষ্মীপুর এইচ এ সামাদ একাডেমি থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর লক্ষ্মীপুর কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যাম্বেলপুরে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ২৭ ফিল্ড আর্টিলারিতে তাঁর পোস্টিং হয় আজাদ কাশ্মীরে। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের সময় ছয় মাসের ছুটিতে এলাকায় আসেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরে না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-র নির্দেশে রামগতি ছাত্র-যুবকদের নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের মাইজদীতে ডাক পড়লে সেখানে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। সুবেদার লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে বাগমারা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এরপর নাথের পেটুয়া, বজরা সোনাইমুড়ীতে যুদ্ধ করেন। ফেনীতে পাকবাহিনীর একটি ছোট ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। রামগতি এলাকায় এসে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। সুবেদার আবদুল লতিফ কমান্ডারের অধীনে রামগতি থানা অপারেশন, রামদয়াল, চর আলেকজান্ডার, বিবিরহাট, চরসীতা, জমিদারহাট, কড়ইতোলাসহ প্রতিটি যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন। ফলে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পালিয়ে যেতে বা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। রাজাকাররা তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, তাঁর পিতাকে হত্যা এবং মাকে নির্যাতন করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
সুবেদার (অব.) আব্দুল মালেক (পিতা মন্তাজ মিয়া, চর ফলকন)-এর জন্ম ১৯৫০ সালে। ১৯৬৭ সালে হাজিরহাট মিল্লাত একাডেমি থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ছয় মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তাঁকে রংপুর সেনানিবাসে পাঠানো হয়। সেখান থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি রামগতি চলে আসেন। কয়েকদিন বাড়িতে থাকার পর স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। ২৫ জনের একটি দলের নেতা হিসেবে রামগতি থানা, চর আলেকজান্ডার, কলাকোপা মাদ্রাসা, করুননগর ও চরসীতায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রামগতিকে শত্রুমুক্ত করেন। তিনি ছাত্র ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। স্বাধীনতার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগ দেন। দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে চাকরির পর ১৯৯৭ সালে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন।
আবুল বারাকাত দুলাল (পিতা হাজী মো. ইউনুস, চর জাঙ্গালিয়া)-এর জন্ম ১৯৫৪ সালে। ১৯৬৮ সালে হাজিরহাট মিল্লাত একাডেমি থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হন। – উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ ঢাকার ছাত্রনেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আ স ম আব্দুর রবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সক্রিয় অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালের মার্চে স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যখন এক দফা আন্দোলন শুরু করে, তখন সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে দিনরাত কাজ করেন। ২৩শে মার্চের পর রামগতিতে আসেন। নাছির হাজীকে সভাপতি ও তাঁকে সেক্রেটারি করে সংগ্রাম কমিটির ইউনিয়ন শাখা গঠিত হয়। আন্ডার চর গিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। এরপর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের চোত্তাখোলা যান ৷ কয়েকদিন পর উত্তর প্রদেশের টেন্ডুয়া যান। ৫২ দিন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে শিলচরে আসেন। সেখান থেকে ট্রাকে করে পাহাড়ি পথে পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করেন এবং মিজোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ক্যাম্পে অবস্থান নেন। চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
নিজাম উদ্দিন মাহমুদ (পিতা আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম, চর লরেন্স)-এর জন্ম ১৯৫৫ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রশিক্ষণ নিতে রামগতি থেকে ২য় ব্যাচে ভারতে যান। প্রায় দুমাসের প্রশিক্ষণ শেষে এলাকায় এসে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। চরসীতা, জমিদারহাট, রামগতি মিলিশিয়া ক্যাম্প ইত্যাদি অপারেশনে অংশ নেন।
কমলনগরে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো বাহিনী ছিল না। তবে নকশাল বাহিনী নামে পরিচিত তোহা বাহিনীর সশস্ত্র তৎপরতা ছিল। তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল। রাজাকার ও নকশালদের মধ্যেও শত্রুতা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে কমলনগর এলাকায় পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করেনি। রামগতি সদরে তাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প থেকে রাজাকারদের মাধ্যমে কমলনগর এলাকায় তাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করত। কমলনগরে পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না। তবে তোরাবগঞ্জ, কড়ইতোলা সাইক্লোন সেন্টার, হাজিরহাট স্থানে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল।
কমলনগর উপজেলায় জামায়াত ও মুসলিম লীগ-এর নেতারা রাজাকার বাহিনী গঠন করে। মাওলানা সৈয়দ আহাম্মদ, আবুল খায়ের মিয়া, ওবায়েদ ডাক্তার, সৈয়দ শামসুল আলম প্রমুখ কমলনগরে স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতৃত্ব দেয়। তোরাবগঞ্জ, কড়ইতোলা, হাজিরহাট রাজাকার ক্যাম্প থেকে তারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অত্যাচার, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালাত।
কমলনগরের রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান ও আলী আহাম্মদকে ধরে লক্ষ্মীপুরস্থ পাকসেনাদের ক্যাম্পে পাঠায়। পরে তাঁরা শহীদ হন। মোতাহারের নেতৃত্বে রাজাকাররা চর আলেকজান্ডার থেকে কমলনগরে এসে মণ্ড উকিলের বাড়িসহ অনেক হিন্দু বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। মোতাহারের অধীনস্থ রাজাকাররা চর বাদামে ছুল্যা মৌলভীর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তার দুই ছেলেকে হত্যা করে।
কমলনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর কোনো যুদ্ধ না হলেও রাজাকারদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধ হয়। এছাড়া কমলনগরের মুক্তিযোদ্ধারা রামগতি থানা অপারেশনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের শেষদিকে রাজাকাররা কমলনগরের হাজীরহাটে একাধিক ক্যাম্প স্থাপন করে নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তখন সম্মিলিতভাবে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
কমলনগরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান (পিতা সুলতান আহম্মেদ, চর লরেন্স), আলী আহাম্মদ (পিতা আবদুর রব, তোরাবগঞ্জ) এবং বেনু মজুমদার (পিতা সূর্য কুমার মজুমদার, করুনানগর)।
মোস্তাফিজুর রহমান মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেট্রিক ও আইএ পাস করার পর তিনি চৌমুহনী কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে চৌমুহনী কলেজ অত্র এলাকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মোস্তাফিজুর রহমান ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা থেকে ছাত্রনেতা মোশারেফ হোসেন কমলনগরে এসে ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য ছাত্রদের সংগ্রহ করলে মোস্তাফিজুর রহমান দ্বিতীয় ব্যাচে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কমলনগর ফিরে আসেন। রামগতি থানা আক্রমণ, করুনানগর, জমিদারহাটসহ বেশ কয়েকটি অপারশেনে অংশ নেন। কড়ইতোলা সাইক্লোন সেন্টারের রাজাকার ক্যাম্পে রেকি করতে মুক্তিযোদ্ধা আলী আহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তোরাবগঞ্জের তোরাব আলীর খামার বাড়িতে অবস্থান নেন। এখান থেকে রাজাকাররা তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এরপর লক্ষ্মীপুর ও ফেনী ক্যাম্পে নির্যাতন শেষে মোস্তাফিজুর রহমানকে হত্যা করে।
আলী আহাম্মদ ১৯৬৭ সালে ভবানীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। এরপর পাকিস্তান নৌবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন। কমলনগরে ছুটিতে আসা সেনা সদস্যদের নিয়ে আজাদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দেন। রামগতি থানা অপারেশনসহ বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কড়ইতোলা রাজাকার ক্যাম্পে রেকি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। পাকবাহিনী তথাকথিত সামরিক বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
বেনু মজুমদার আলেকজান্ডার হাইস্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে মেট্রিক পাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর তিনি আন্ডার চর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে থাকতেন। স্থানীয়ভাবে এক মাস প্রশিক্ষণ নেন। আজাদ চেয়ারম্যানের কাছে একটি বার্তা নিয়ে যাবার সময় ১৬ই আগস্ট কলাকোপা মাদ্রাসার পূর্বপাশে রাজাকাররা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর ভাই পরমলেন্দু মজুমদার ডাক্তার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে কাজ করতেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বেনু মজুমদারের নামে করুনানগর থেকে ফজু মিয়ার হাট পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে। [আবুল কাসেম নিজাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড