You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কয়রা উপজেলা (খুলনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কয়রা উপজেলা (খুলনা)

কয়রা উপজেলা (খুলনা) সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত। খুলনা জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। ১৯৭১ সালে এটি পাইকগাছা থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে পরিচালিত মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর ঢেউ দক্ষিণাঞ্চলের এই প্রত্যন্ত এলাকাও পড়ে। আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ – ন্যাপ- ছাত্র ইউনিয়ন- প্রভৃতি রাজনৈতিক ও শ্রমিক-ছাত্র সংগঠন এখানে আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর খুলনা তথা দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বত্র পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২৫শে মার্চের পর সারা দেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কয়রায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন খুলনার বি এল কলেজ, সরকারি আজম খান কমার্স কলেজ এবং দৌলতপুর দিবা-নৈশ কলেজের ছাত্র। তাঁদের মধ্যে স ম বাবর আলী, কেরামত আলী, গাজী রফিকুল ইসলাম, মতিউর রহমান প্রমুখ ছিলেন নেতৃস্থানীয়। এ ছাড়াও আমীর আলী শেখ (পিতা নৈমুদ্দিন শেখ), আশরাফুল আলম, শামসুর রহমান, প্রফুল্ল চন্দ্র বাছাড় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কয়রার ছাত্র-যুবকদের একটি অংশ ভারতে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়। আগস্টের প্রথমদিকে তাঁরা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সাতক্ষীরা, খুলনা, সুন্দরবন ও বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
কয়রা ও পাইকগাছায় মুক্তিযোদ্ধাদের মোট ২৩টি ক্যাম্প ছিল। কয়রায় ছিল তিনটি ক্যাম্প এবং একটি সাব-ক্যাম্প। হাতিয়ারডাঙ্গার বাছাড় বাড়িতে ছিল ‘বঙ্গবন্ধু ক্যাম্প’। একে ‘মনোরঞ্জন ক্যাম্প’ও বলা হতো। এর দায়িত্বে ছিলেন গাজী রফিকুল ইসলাম। বামিয়াতে ছিল ‘মণ্ডল ক্যাম্প’ এবং ৪ নং কয়রায় ছিল ‘নারায়ণ ক্যাম্প’। ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে ছিলেন প্রথমে এস এস শামছুর রহমান এবং পরে কেরামত আলী। সবগুলো ক্যাম্পের সমন্বয়ক ছিলেন স ম বাবর আলী।
খুলনার মুসলিম লীগ নেতা ও স্বাধীনতাবিরোধী খান-এ- সবুরের প্রভাবে এখানে অনেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের হয়ে কাজ করে। তারা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ও সাধারণ মানুষদের ওপর নির্যাতন চালায়। কয়রার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের মধ্যে এলেম বক্স সরদার (মঠবাড়ি; শান্তি কমিটি-র প্রধান), আব্দুল হামিদ মল্লিক (মঠবাড়ি; রাজাকার), আব্বাস উদ্দীন (মহারাজপুর; রাজাকার), এজাহার উদ্দীন গাইন (মঠবাড়ি; শান্তি কমিটির সদস্য), আবুল কাশেম হাওলাদার (৫নং কয়রা; রাজাকার), মোহাম্মদ হাওলাদার (৫নং কয়রা; রাজাকার), ছালাম মাওলানা (ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সংগঠক), আব্দুল হাই সরদার (দক্ষিণ বেদকাশী; রাজাকার) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। স্থলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকার কারণে এ উপজেলায় পাকবাহিনীর স্থায়ী কোনো ক্যাম্প স্থাপিত হয়নি স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার বা মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যখন কোনো অপারেশনের খবর দিত, তখন খুলনা বা সাতক্ষীরা থেকে পাকসেনারা গানবোটে করে এসে এখানে অভিযান চালিয়ে আবার ফিরে যেত। পাইকগাছার গোলবুনিয়া গ্রামের ভীম সর্দারের পরিবার ছিল খুবই প্রভাবশালী। এপ্রিল মাসে রাজাকাররা ঐ বাড়িটি আক্রমণ করে। এতে একজন গর্ভবতী মহিলা প্রাণ হারান। বাড়ির ভেতর থেকে রাজাকারদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। রাজাকাররা বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনা শুনে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভারতে চলে যায়। মে মাসের প্রথমদিকে তিন শতাধিক দেশত্যাগী মানুষ নৌকায় করে যখন কয়রার শিবসা নদীর বনহাড্ডা নামক স্থান দিয়ে যাচ্ছিল, তখন গড়াইখালীর রাজাকার আব্দুল ছিদ্দিকের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র লোক তাদের আক্রমণ করে। আক্রান্তদের পক্ষ থেকেও পাল্টা আক্রমণ করা হয়। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে নারী-শিশুসহ দেড়শতাধিক মানুষ শহীদ হয়। পাল্টা আক্রমণে ছিদ্দিক রাজাকারও নিহত হয়। এই বনহাড্ডা গণহত্যা- কয়রা উপজেলার সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড।
মে মাসের ৫ তারিখ সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা প্রচুর অস্ত্র ও রসদ নিয়ে ‘আনোয়ারা’ ও ‘সোহাগ’ নামের দুটি লঞ্চযোগে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিলেন। একটি লঞ্চে ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ, নাসের, ডা. আসিকুর রহমান, ইস্কান্দর কবীর ও বাচ্চুসহ ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। অপর লঞ্চে ছিলেন মেজর জলিল ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। লঞ্চদুটি কয়রার গাবুরা নামক স্থানে পৌছলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পাকবাহিনী তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকেও পাল্টা আক্রমণ করা হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর মেশিনগানের বিরামহীন গুলিবর্ষণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চদুটি ফেলে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ-যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। পাকবাহিনী লঞ্চদুটির অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায় এবং তাদের গোলার আঘাতে লঞ্চে রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যসামগ্রী, ১০০ ব্যারেল পেট্রল ও ৭৫ ব্যারেল ডিজেল ধ্বংস হয়ে যায়। পরের দিন ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শান্তি কমিটির লোকদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের মধ্যে বাকেরঞ্জ-১০ আসন থেকে নির্বাচিত (আওয়ামী লীগ) মহিউদ্দিন আহমেদ এমপিএ (পিস্তল মহিউদ্দিন নামে খ্যাত), বরিশাল বি এম কলেজের ছাত্রনেতা আ স ম ফিরোজ (খেপুপাড়া; দশম জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ), ক্যাপ্টেন নাসির, জালাল সর্দার ও আমিনুল ইসলাম সুরুজ (স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমের সদস্য) ছিলেন। শান্তি কমিটির লোকদের কর্তৃক পাকবাহিনীর গানবোটে তাঁদের তুলে দেয়ার পূর্বে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এক সঙ্গীসহ আ স ম ফিরোজ প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম হন। মহিউদ্দিন আহমেদ এমপিএ-সহ বাকি ১৭ জনকে পাকসেনারা নিয়ে গিয়ে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং কারাগারে বন্দি করে রাখে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর তাঁরা মুক্তি লাভ করেন।
কয়রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার কপিলমুনি। খুলনা সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পাইকগাছা থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। বাজারের বিনোদ বিহারী সাধুর দোতলা বাড়িতে রাজাকারদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। ১১ই জুলাই লে. আরেফিনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের এই ঘাঁটি আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। ৫ই ডিসেম্বর রহমত উল্লাহ দাদু, স ম বাবর আলী, ইউনুস আলী ইনু, সাহিদুর রহমান টুকু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম, কামরুজ্জামান টুকু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা পুনরায় ঘাঁটিটি আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। ৭ই ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এরপর রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে কয়রা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। কয়রা উপজেলা পরিষদ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [অমল কুমার গাইন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড