মুক্তিযুদ্ধে কচুয়া উপজেলা
কচুয়া উপজেলা (বাগেরহাট) সমুদ্র উপকূলবর্তী বাগেরহাট জেলার অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতার পূর্বে বাগেরহাট ছিল একটি মহকুমা। বর্তমানে এটি জেলা।
ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ বাগেরহাট জেলার আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য। যুগে-যুগে প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষ সংগ্রাম করে টিকে আছে। রাজনৈতিক সংগ্রামেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে কচুয়ার জনসাধারণ অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনে সাধারণ মানুষ ও ছাত্রসমাজ খুবই সোচ্চার ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বাধলি ইউনিয়নের মসান উচ্চ বিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র নিমাই চন্দ্র দাস তার সহপাঠীদের নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় মিছিল করে, স্লোগান দেয়, ‘আইয়ুব- মোনায়েম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র বহিঃপ্রকাশ। আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটে। কিন্তু ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা সে বিজয় নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব ও তালবাহানা করে। এতে বাঙালিদের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ থেকে হরতাল ও আন্দোলনের আহ্বান জানান। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর এ ভাষণ ও ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা কচুয়া এলাকার মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কচুয়া-মোড়লগঞ্জ আসনে বিজয়ী মীর সাখাওয়াত আলী দারু এমপিএ-র নেতৃত্বে কচুয়া থানার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবং অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরীহ বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত পৈশাচিক অত্যাচারে মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এর প্রতিবাদে কচুয়া থানায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে অসংখ্য ছাত্র, যুবক সেনাসদস্য ও পুলিশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। মীর সাখাওয়াত আলী দারু এমপিএ-র নেতৃত্বে কচুয়া থানায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যগণ এতে অংশগ্রহণ করেন। বাগেরহাট, খুলনা, সুন্দরবনসহ পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরিশাল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। বাগেরহাট ও কচুয়া থানা নিয়ে গঠিত সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম।
৯ই মার্চ স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বাগেরহাটে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট শেখ আবদুর রহমান এমপিএ। কচুয়ার এমপিএ মীর সাখাওয়াত আলী দারু এর অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। কচুয়া থানার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকগণ ছিলেন- মীর সাখাওয়াত আলী দারু এমপিএ, মীর আবুল কাশেম আলী, ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, নূর উদ্দিন শেখ, শিকদার আবদুর রহিম, নূরুল হক মুন্সী, এ এম মোস্তাহিদুল ইসলাম, হাজরা জাহিদুল ইসলাম মন্নু, শেখ আবুয়াল বাশার, শেখ মাকফুর রহমান, কাজী আমজাদুল হক, ডা. এস এম মোশাররফ হোসেন, সাখাওয়াত আলী সিকদার, ফরমান আলী প্রমুখ। পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ, অস্ত্র সংগ্রহ এবং প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সংগ্রাম কমিটি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সংগ্রাম কমিটি কচুয়া ফুটবল মাঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দেয়া যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন আনসার কমান্ডার নূর উদ্দিন শেখ এবং সেনাবাহিনীর প্যারা মিলিটারি ও মুজাহিদ বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য শেখ ফজর আহম্মেদ। সেনাবাহিনীর একাধিক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিককে দিয়েও বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের মধ্যে জয়নাল আবেদীন, মানিক মিয়া, কাজী আমজাদ হোসেন, আবদুর রাজ্জাক, খোন্দকার মাহতাব উদ্দিন, রজ্জব আলী শিকদার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মীর সাখাওয়াত আলী দারু এমপিএ-র সঙ্গে তৎকালীন কচুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রউফের সখ্য ছিল। ফলে, রউফ কোনোরকম নিয়ম-নীতির কথা না ভেবে থানা থেকে ৪০টি রাইফেল স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে তুলে দেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে ভর্তি হওয়া যুবকরা এ রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
ধোপাখালী গ্রামের কাজী আমজাদুল হক ৯ নম্বর সেক্টর হেড-কোয়ার্টার্স থেকে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একই গ্রামের গফুর সাহেবের বাড়িতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। ধোপাখালী হাইস্কুলে একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প এবং একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয় এ ক্যাম্পে ছাত্র-যুবকদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা বেশ কয়েকজন বাঙালি সৈনিক যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুবেদার তবারক হোসেন, হাবিলদার কাসেম, সিপাহি আজিম, সিপাহি কামাল প্রমুখ। ধোপাখালীর ফুলতলাতে শৈলেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর পাকা দালান বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। কচুয়া থানার পশ্চিম সীমান্তে পাতিলাখালি গ্রামে বেণী ডাকুয়ার বাড়িতেও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
৯ নম্বর সেক্টরের উত্তর অঞ্চলের সাব-সেক্টর হেড-কোয়ার্টার্স ছিল কচুয়া থানার সন্তোষপুর তহশীল অফিস, প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সন্তোষপুর হাইস্কুল ভবন (বর্তমানে সন্তোষপুর চিতলমারী থানাধীন)। কচুয়া থানায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারগণ হচ্ছেন- ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম (সাব-সেক্টর কমান্ডার), অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন (বেসামরিক প্রধান), আব্দুস সামাদ (সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), কাজী আমজাদুল হক (সিভিল লিয়াজোঁ অফিসার), রফিকুল ইসলাম খোকন (কমান্ডার, চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর ক্যাম্প), মল্লিক শামসুল হক (কমান্ডার, চিতলমারী ক্যাম্প), সরদার বজলুর রহমান (কমান্ডার, এ কোম্পানি), সুবেদার এম এ কাসেম (কমান্ডার, বি কোম্পানি), মোহাম্মদ আলী (কমান্ডার, সি কোম্পানি)। কমান্ডারগণ সমগ্র কচুয়া থানায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। কচুয়া থানার পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম সীমানায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ বাহিনী, যেমন- হবি বাহিনী ও রফিকুল ইসলাম খোকন বাহিনীর তৎপরতা ও অবস্থান থাকায় পাকবাহিনী কচুয়াতে প্রবেশ করতে পারেনি। হবি বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুর রহমান হাবিব ওরফে হবি (পিতা শেখ রহিজ উদ্দিন, বেশরগাঁতী)। যুদ্ধকালীন সময়ে এ বাহিনী দেপাড়া, ধোপাখালী, কামারগাঁতী, আলীপুর, গজালিয়া, মেছোখালী, মাধবকাঠি ইত্যাদি গ্রামগুলো রাজাকারমুক্ত রাখার প্রচেষ্টা চালায়। যাতে স্থানীয় যুবকরা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে না পারে সেদিকে হবি বাহিনী কঠোর নজর রাখে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে দমন করার ক্ষেত্রেও তারা খুবই তৎপর ছিল। হবি বাহিনীর নেতৃত্বে সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধ সংঘটিত হয় মাধবকাঠি মাদ্রাসায় অবস্থানরত রাজাকার ও পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের সঙ্গে। রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল ছিল হবি বাহিনীর বড় কৃতিত্ব। খোকন বাহিনী ওরফে রফিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন (পিতা মো. সায়েল উদ্দিন, চিরুলিয়া)। তিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির বাগেরহাট মহকুমার আহ্বায়ক ছিলেন। পিরোজপুরের ফজলুর রহমান ফজলু রফিক বাহিনীকে ৮টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেন। এছাড়া রফিক বাহিনী ডেমা এলাকা থেকে ৬টি এবং বাগেরহাট শহর থেকে আরো ৬টি রাইফেল সংগ্রহ করে। সংগৃহীত অস্ত্র দিয়ে রফিকুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র বাহিনী ও ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাঁর বাহিনীতে অধিকাংশই ছিল তাঁর গোপন পার্টির সক্রিয় সদস্য। তাঁরা সকলে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন – মেনন গ্রুপের কর্মী। হবি বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে কচুয়া থানার মাধবকাঠি মাদ্রাসা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও তা দখলে তাঁর বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রফিক বাহিনী কচুয়া থানার পশ্চিম সীমানায় পাকহানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাগেরহাট শহরের উত্তরে পাকবাহিনী, মিলিশিয়া, রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে তাঁর বাহিনীর সংঘটিত সবকটি যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান মানুষ আজো স্মরণ করে।
প্রতিরোধযোদ্ধারা এ অঞ্চলে রাস্তার ব্রিজের পাটাতন খুলে ফেলেন। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় কচুয়া থানায় পাকবাহিনী প্রবেশ করেনি এবং কোনো ক্যাম্পও স্থাপন করেনি।
বাগেরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন মোজাম ডাক্তার ৮ই মে কচুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে আহুত সভায় কচুয়া থানা শান্তি কমিটি গঠন করে। এর সদস্যরা হচ্ছে- আশরাফ আলী হাওলাদার (চেয়ারম্যান, গোপালপুর ইউনিয়ন), এস এম মাহের উদ্দিন (চেয়ারম্যান, মঘিয়া ইউনিয়ন), মাহমুদ কাজী (চেয়ারম্যান, ধোপাখালী ইউনিয়ান), জহুর আলী হাজরা (চেয়ারম্যান, ধোপাখালী ইউনিয়ন), খান ইব্রাহীম হোসেন ওরফে গম মৌলবী (চেয়ারম্যান, রাড়িপাড়া ইউনিয়ন), মোদাচ্ছের মোল্লা (চেয়ারম্যান, রাড়িপাড়া ইউনিয়ন), আজাহার শিকদার (প্রতিনিধি, গজালিয়া ইউনিয়ন), আব্দুর রহমান শেখ (চেয়ারম্যান, গজালিয়া ইউনিয়ন), সফিউদ্দিন শেখ (চেয়ারম্যান, চরবানিয়ারী ইউনিয়ন), হাতেম শেখ (চরসোনাকুড়), নওয়াব আলী শেখ (চরসোনাকুড়), আশরাফ আলী (টেংরাখালী), সেকেন্দার আলী (মাধবকাঠি) প্রমুখ। কমিটি গঠন শেষে মোজাম ডাক্তার তার বক্তৃতায় ‘ভারতের দালালদের দমন করো এবং তাদের সম্পত্তি লোটোপাটো খাও’ মর্মে সরাসরি নির্দেশ দেয়। এর পরের দিন থেকেই থানার প্রায় সর্বত্র লুটপাটের ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকেরাই এর শিকার হন। শান্তি কমিটি ও তার সহযোগী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী যৌথভাবে কচুয়া থানায় গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, গণনির্যাতন ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অনেক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে।
কচুয়া থানা রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হচ্ছে- রাকাব আলী শিকদার (রাড়িপাড়া), মজিবুর রহমান (জোবাই), মাহাতাব আলী খান (কচুয়া), সেকেন্দার আলী (মাধবকাঠি), রিজিয়া খাতুন (পাশগা), ডা. আবিদ আলী (মাধবকাঠি), মনিরুজ্জামান (মাধবকাঠি), নূর মোহাম্মদ, আবদুল আজিজ শেখ, সামছুল হক, সুরতান আলী ডাকুয়া, আফসার উদ্দিন শেখ, আব্দুল হামিদ শেখ, আবদুল হামেদ মোল্লা, আবদুল জলিল শেখ, ফজর আলী কাজী, জালাল উদ্দিন কাজী, জালাল উদ্দিন শেখ, আ. রসিদ শেখ, আফজাল হোসেন, উকিল উদ্দিন শেখ, আবদুল আলী মোল্লা, আবদুল লতিফ গাজী, আবুল বাশার শেখ, লুৎফর মাঝি, শহিদুল ইসলাম, আবেদ আলী শেখ, হাবিবুর রহমান, মকবুল হোসেন মল্লিক, মনসুর আলী মোল্লা, সোলায়মান দরানী, শেখ আব্দুর রহমান, শেখ আদম আলী, মোজাম্মেল হক, আবদুল আজিজ দিদার, লাল মিয়া সরদার, শেখ আহমদ আলী, আইয়ুব আলী হাওলাদার, আতিয়ার রহমান খান, হোসেন উদ্দিন শেখ, আ. গফুর শেখ, আফতাব হোসেন শেখ, কাশেম আলী মল্লিক, সরোয়ার হোসেন হাওলাদার, মোশাররফ হোসেন মোল্লা, শেখ ইয়াহিয়া, শেখ জাবেদ আলী, মতিয়র রহমান সরদার, আবদুল বারেক মৃধা, আনোয়ার হোসেন শেখ, আফজাল হোসেন শেখ, আজহার আলী শেখ, ইসমাইল মোল্লা, মাহতাব উদ্দিন সরদার, মকবুল হোসেন মোল্লা, রুহুল আমিন সরদার, তৈয়ব আলী ফকির, মোতালেব হোসেন, ছেকেন্দার আলি, মাহতাব উদ্দিন শিকদার, তৈয়ব আলী শিকদার, শেখ মোশারেফ হোসেন, বজলুর রহমান, লিয়াকত আলী শেখ, মোতালেব সরদার, আবদুস সাত্তার মৃধা, আব্দুস সাত্তার বেপারী, শাহজাহান শেখ, আ. লতিফ তালুকদার, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
পাকবাহিনী কচুয়া থানার কোথাও ক্যাম্প স্থাপন করেনি এবং সরাসরি অভিযানও চালায়নি। তারা রাজাকার বাহিনী গঠন করে তাদের মাধ্যমে কচুয়া থানায় তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ২৭শে আগস্ট কচুয়া থানা সদরে রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। মাধবকাঠি রাজাকার ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধ্বংস হওয়ার ২১ দিন পর রাজাকার কমান্ডার মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে তৎকালীন সিও অফিস দখল করে তারা ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠা করে। প্রথমদিকে রাজাকারদের সংখ্যা ছিল ৪১ জন। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে ১৪১ জনে দাঁড়ায়। তিন-চার মাস ধরে এই রাজাকার বাহিনী কচুয়া থানায় হত্যা, নারীনির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। তাদের ক্যাম্পের সামনেই ছিল একটি বধ্যভূমি। রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে খান আকরাম, সুলতান ডাকুয়া (বাড়িপাড়া), আব্দুল গনি সরদার (টেংড়াখালী), হাসেম আলী শেখ (হাজরাখালী), ফজলু তালুকদার, মুজিবর মোল্লা, আজিজ দিদার, করিম দিদার প্রমুখ বিভিন্ন এলাকার লোকজনদের ধরে এনে এসব কর্মকাণ্ড করে।
রাজাকার ফজলু তালুকদার, মুজিবর মোল্লা, আজিজ দিদার, ইদ্রিস মোল্লা, রুস্তম মোল্লা প্রমুখ যৌথভাবে বিলকুল, কাঁঠালতলা গ্রামের মনসুর আলী ও নকীবকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে দেবজ্ঞহাটি গরুহাটের পাশে পোলের নিচে গুলি করে হত্যা করে। তারা বিলকুল গ্রামের ফেলা শেখকে কাঁঠালতলা ব্রিজের নীচে গুলি করে হত্যা করে। পিঙ্গরিয়া গ্রামের মণীন্দ্রনাথের জামাইকেও তারা হত্যা করে। বাধাল ইউনিয়নের কাঁঠালতলায় অবস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন খালের পশ্চিম পাশে সুনীল কর্মকারসহ আরো ৪ জনকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যার পর লাশগুলো খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়। ২৬শে আগস্ট রাজাকার সুলতান ডাকুয়া, নসু মাঝি প্রমুখ কচুয়ার চরকাঠি গ্রামের মুকুন্দ লাল সাহাকে গুলি করে হত্যা করে। কচুয়ার বরুইখালী গ্রামের সুবোধ গুহ ওরফে ধলা গুহকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। মঘিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে নজরুল ইসলামকে রাজাকারা হত্যা করে। রাজাকার হাসেম আলী শেখ (হাজরাখালী) তার আপন ভ্রাতুষ্পুত্র নূর মোহাম্মদ শেখকে হত্যা করে। নূর মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। হাসেম আলী শেখ ও অন্যান্য রাজাকাররা খালেক বালি (পিতা মফিজ উদ্দিন বালি, হাজরাখালী) ও মোবারক খা (পিতা নাদের খা, হাজরাখালী)-কে গুলি করে হত্যা করে। মকবুল হোসেন, জবেদ আলী শেখ, আনোয়ার শেখ, আব্দুল আলী মোল্লা প্রমুখ রাজাকার আলীপুর গ্রামের উকিল মাঝিকে হত্যা করে।
আশ্বিন মাসে (অক্টোবর) দুর্গা পূজার পূর্বে বড়ো আন্ধারমানিক গ্রামে রাজাকার বাহিনী এক বাড়িতে হানা দিয়ে পুরুষ মানুষ না পেয়ে মহিলাদের মারপিট করে। ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মনোহর হাওলাদারকে পাশের এক বাড়িতে খেতে বসা অবস্থায় ধরে নিয়ে মারপিট করতে-করতে আন্ধারমানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে আসে এবং বেয়নেট চার্জ করে হত্যার চেষ্টা করে ফেলে রেখে যায়। মৃতপ্রায় মনোহর হাওলাদার ‘জল দাও জল দাও’ বলে কাতরাচ্ছিল। এ সময় রাজাকার হাকিম পাগলা আবার ফিরে এসে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে।
১৫ই অক্টোবর শুক্রবার কচুয়া থানার দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে মঘিয়া নামক স্থানে ১৫ জন সাধারণ মানুষকে রাজাকাররা হত্যা করে, যা মঘিয়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। কচুয়া সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত ভাসা বাজার থেকে হতভাগ্যদের ধরে নিয়ে এসেছিল কচুয়া থানার রাজাকার বাহিনী। এদিন যারা গণহত্যায় নিহত হয় তারা ছিল তাসা, সানপুকুরিয়া, আন্ধারমানিক, সিটাবাড়ি, রথখোলা ও পাতিলাখালী গ্রামের লোক।
স্থানীয় রাজাকার দেলোয়ার হোসেন এবং মহকুমা ডেপুটি কমান্ডার সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ২২শে নভেম্বর বিকেলে রাজাকার আব্দুল গণি সরদার, হাশেম আলী শেখ, আফসার দিদার, ফজলু তালুকদার, ইদ্রিস মোল্লা প্রমুখ সতীশ চন্দ্র মণ্ডল (পিতা রামচরণ মণ্ডল) ও মো. হাবিব শেখ (টেংড়াখালী)-কে তাদের বাড়ি থেকে ধরে এনে কচুয়া থানার ভৈরব নদীর ঘাটে কাঠের সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। অনুরূপভাবে একই স্থানে বিভিন্ন সময়ে জুজখোলা গ্রামের ধলু সরদার, চরকাঠি গ্রামের আজাহার আলী সরদার, খলিশাখালী গ্রামের অনিল চন্দ্র হালদার (পিতা ক্ষুদিরাম হালদার), কাকারবিল গ্রামের শফিউদ্দিন মৃধা ও তাঁর পুত্র শাহজাহান মৃধাকে ধরে এনে নির্যাতনের পর গুলি ও জবাই করে ভৈরবের পানিতে ভাসিয়ে দেয়।
২২শে নভেম্বর ভোররাতে রাজাকার হাসেম আলী শেখ, সুলতান ডাকুয়া, আব্দুল গনি সরদার প্রমুখ বারুইখালী গ্রামের মণীন্দ্রনাথ সাহাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে মারপিট করতে-করতে কচুয়া বাজারের গুড়ের হাটে নিয়ে আসে। তারপর তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এভাবে এই বধ্যভূমিতে অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষকে রাজাকাররা হত্যা করে। এই শহীদদের অনেকের নাম ও পরিচয় আজো জানা যায়নি।
কচুয়া থানার দক্ষিণ ও মোড়লগঞ্জ থানার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত দৈবজ্ঞহাট বাজারের কাছে বিশ্বাস বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্প। এখানকার রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকবার যুদ্ধ হয়। এ ধরনের একটি যুদ্ধ হয় ৪ঠা নভেম্বর। সারারাত ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। এখানকার রাজাকার সংগঠকরা তখন বাগেরহাট ও কচুয়ার রাজাকার ক্যাম্পে সাহায্যের আবেদন জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরের দিন দুপুরের মধ্যেই কচুয়া থানার রাজাকাররা পৌঁছে যায়। এদিন ছিল কচুয়া থানার দুই কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত শাঁখারীকাঠি গ্রামের একটি হাট। দৈবজ্ঞহাটের রাজাকাররা হাটটি আক্রমণ করে সেখানে আগত হিন্দু যুবকদের হত্যা করার নির্দেশ দেয়। এভাবে ৫ই নভেম্বর বিকেলে শতাধিক অস্ত্রধারী রাজাকার তিনদিক থেকে হাটটি ঘিরে ফেলে। সঙ্গে-সঙ্গে রাইফেলের বাট দিয়ে যাকে খুশি তাকে প্রহার করতে থাকে। মোট ৮২ জন লোককে তারা পাকড়াও করে। দড়ি ও গামছা দিয়ে বেঁধে তাদেরকে রাইফেলের বাট ও লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। নির্যাতিত লোকদের পরে বাজারের পশ্চিম দিকে নিয়ে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি করে বসায়। রাজাকার কমান্ডার সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার বাঁশি বাজিয়ে নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে- সঙ্গে রাজাকার আকরাম খা, আব্দুল লতিফ তালুকদারসহ কয়েকজন রাজাকার একযোগে গুলি করতে থাকে। শাঁখারীকাঠি গণহত্যায় সেদিন অর্ধশতাধিক লোক শহীদ হন। রাজাকাররা হত্যা করে লাশগুলো ফেলে রেখে সন্ধ্যার আগেই তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়।
কচুয়া উপজেলায় একটি বধ্যভূমি আছে – ভৈরব নদীর ঘাট বধ্যভূমি। এখানে বহু লোককে হত্যা করা হয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর হাতে কচুয়া থানার আরো যারা নিহত হন, তারা হলেন— আবদুল খালেক (পিতা রহিম উদ্দিন শেখ, কাকারবিল; আনসার), ইসমাইল শেখ, (পিতা আইনুদ্দিন, কাকারবিল; আনসার), চৌধুরী হেমায়েত উদ্দিন, (পিতা আবদুল মজিদ চৌধুরী, ধোপাখালী; আনসার), মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন, (পিতা শেখ বশির উদ্দিন আহমেদ, পদ্মনগর; সেনাসদস্য), মনসুর আলী ফকির, (পিতা হাচেন আলী নকিব, বিলকুল; আনসার), আবদুল হালিম সরদার (পিতা নওয়াব আলী সরদার, মেছখালী), মনোহর হালদার (পিতা অভয়চরণ হালদার, আন্ধারমানিক), আবদুল খালেক বালি (পিতা মফিজ উদ্দিন, হাজরাখালী), মোবারক খা (পিতা নাদের খা, হাজরাখালী), জিতেন্দ্রনাথ, একলাসুর রহমান (কামার গাঁতি), আতাহার আলী হাওলাদার (পিতা মোকছেদ আলী হাওলাদার, মাধবকাঠি), আবেদ আলী শেখ (পিতা ছবেদ আলী শেখ, মেছখালী), আলহাজ হোসেন ননী (পিতা ডা. সোহরাব হোসেন, দেপাড়া), আতিয়ার রহমান (পিতা হোসেন উদ্দিন শেখ, সিটাবাড়ি), ওমর আলী (লড়ারকুল), মুজিবুর রহমান (পিতা শেখ মনসুর আলী, ধোপাখালী), সুনীল কুমার কর্মকার (পিঙ্গরিয়া), হাবিবুর রহমান কোটালি (পিতা আবদুর রহিম কোটালি, পিঙ্গরিয়া), জিতেন্দ্রনাথ পাটনী (পিতা শীতল পাটনী, কামারগাঁতি), আসাদুজ্জামান (পিতা শেখ মোসলেম আলী, পদ্মনগর), খন্দকার ছারোয়ার হোসেন (পিতা জেন্নাত আলী খন্দকার, ফুলতলা)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কচুয়া থানার নারীদের ওপর নানা ধরনের দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার-নির্যাতন ছিল পাকবাহিনীর বর্বরতার চরম বহিঃপ্রকাশ। এতে রাজাকাররাও পিছিয়ে ছিল না। উপরন্তু রাজাকার বাহিনী বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে পাকবাহিনীকে দিত, কখনো নিজেরাই ভোগ করত। বাধাল ইউনিয়নের দক্ষিণে দৈবজ্ঞহাটি রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাররা শাঁখারীকাঠি, রঘুদত্তকাঠি, আলোকদিয়া, রামচন্দ্রপুর, মসনি, সাগরকাঠি প্রভৃতি গ্রামে সবচেয়ে বেশি নারীনির্যাতন ও অত্যাচার করে। শাঁখারীকাঠি গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশিষ্ট এক ব্যক্তির স্ত্রী ও তাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে বাগেরহাটে অবস্থিত পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ১৫ দিন পর তার স্বামীকে হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে এবং স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে ঐ মহিলা ভারতে চলে যান। বাধাল ইউনিয়নের কলমিবুনিয়া গ্রামের দুই নারীকে রাজাকাররা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় এবং দীর্ঘ দিন ক্যাম্পে বন্দি রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। পিঙ্গরিয়া গ্রামেও তারা নারীনির্যাতন করে।
বারুইখালী গ্রামে রাজাকাররা দুই নারীকে নির্যাতন করে। ভাসা গ্রামের এক বাড়িতে শান্তি কমিটির দুই সদস্য নারীদের নির্যাতন করে। ধোপাখালী ঠাকুর বাড়িতে রাজাকাররা নারীনির্যাতন চালায়। কচুয়া থানার গজালিয়া ইউনিয়নের লাড়ারকুল গ্রামের লুণ্ঠনকারী সৈয়দ মাঝি জোবাই গ্রামের হিন্দু বাড়িতে লুণ্ঠন করতে এসে কিছু না পেয়ে বাড়ির এক কিশোরীকে জোর করে নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। মাদারতলা গ্রামের রাজাকার কমান্ডার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্যরা গজালিয়া থেকে এক হিন্দু নারীকে ধরে নিয়ে কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পে অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে কচুয়া বাজারে পাকহানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় গানবোটে এসে কয়েকটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। কচুয়ার চরকাঠি গ্রামে সুবোধ কুমার সাহা এবং কেশবলাল সাহার বাড়িতে রাজাকাররা প্রথমে লুট এবং পরবর্তীতে অগ্নিসংযোগ করে। মঘিয়া ইউনিয়নের আবাদের খালের গোড়ায় রাজাকার হাসেম আলী শেখের নেতৃত্বে রাজাকার জাবেদ আলী শেখ, মকবুল হোসেন, শেখ আতিয়ার প্রমুখ ঘোনারহুলার দিলীপ সাহা ও অন্য শরিকগণের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। গজালিয়া গ্রামের মো. রুস্তম আলী মাঝি, ঝালোডাঙ্গার মোকাম্মেল হাওলাদারের বাড়ি এবং ফুলতলা গ্রামের হরষিৎ কবিরাজের বাড়িতেও তারা অগ্নিসংযোগ করে। পিঙ্গরিয়ার হাজী মকবুল আহমেদ এবং আঠারোগাতি গ্রামের আজাহার আলী মল্লিক ও জাফর মল্লিকের বাড়িতে রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে। শাঁখারীকাঠি, রঘুদত্তকাঠি, সাগরকাঠি, আরোকদিয়া মসনি, পানবাড়িয়া, পিঙ্গরিয়া, পদ্মসাগর, ফুলতলা, মালিপাটন গোপালপুর, উত্তর গোপালপুর, প্রতাপপুরসহ হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলোতে রাজাকার বাহিনী ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়।
১১ই ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান সরদারকে রেকি করার কাজে কচুয়া বাজারে পাঠানো হয়। রাজাকাররা দেখামাত্র তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। পাল্টা আক্রমণে টিকতে না পেরে ১৩ই ডিসেম্বর রাত আড়াইটার দিকে রাজাকার বাহিনী বাগেরহাটের দিকে পালিয়ে যায় এবং এদিনই কচুয়া থানা হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে বাগেরহাট অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে যে- সকল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা হচ্ছেন- আতাহার হাওলাদার (পিতা মোকছেদ আলী হাওলাদার, মাধবকাঠি), আতিয়ার শেখ (পিতা হোসেন উদ্দিন শেখ, সিটাবাড়ি), আবেদ আলী শেখ (পিতা ছবেদ আলী শেখ, মেছখালী), আলফাজ হোসেন ননী (পিতা ডা. সোহরাব হোসেন, দেপাড়া), মুজিবুর রহমান (পিতা শেখ মনসুর আলী, ধোপাখালী), শেখ আবদুল আসাদ (পিতা শেখ মোসলেম আলী, পদ্মনগর), সুলতান সরদার (পিতা রওশন সরদার, কচুয়া) ও হাবিবুর রহমান কোটলি (পিতা আব্দুল করিম কোটলি, পিঙ্গরিয়া)।
৩রা ডিসেম্বর ভাসা বাজারে রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক যুদ্ধে শহীদ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে কচুয়া থানা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে ভাসা-গজালিয়া রাস্তার পূর্বপাশে এবং বি সি ভাসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ১৫ই অক্টোবর ভাসা বাজার থেকে রাজাকাররা যে ১৫ জন নিরীহ সাধারণ মানুষকে মঘিয়ায় ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তাদের স্মরণে মঘিয়া স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ২২শে নভেম্বর রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজাকার বাহিনী যেসব নিরীহ মানুষকে কচুয়া উপজেলা চত্বরে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে, তৎকালীন সিও অফিস বর্তমান উপজেলা পরিষদের সামনের বধ্যভূমিতে সেসব শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্মৃতিস্তম্ভের এলাকাটি মুক্তিযোদ্ধা হাশেম চত্বর নামে পরিচিত। ৫ই নভেম্বর কচুয়া থানাধীন বাধাল ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে শাঁখারীকাঠি নামক হাটে রাজাকাররা ৫০ জনের মতো যে সাধারণ মানুষকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে, তাদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় শাঁখারীকাঠি স্মৃতিস্তম্ভ। নিহতদের মধ্যে ৪২ জনের লাশ ৬ই নভেম্বর নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রান্তে বিষখালী খালের তীরে গণকবর দেয়া হয়। তাদের মধ্যে রামচন্দ্রপুর গ্রামের ২০ বছর বয়সী যুবক নিরঞ্জন দাসও ছিল। ১৯৯২ সালের ৪ঠা নভেম্বর শহীদ নিরঞ্জন দাসের ছোটভাই মনোরঞ্জন দাস নিজ উদ্যোগে গণকবরটির ওপর শহীদ মিনারের আদলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। স্মৃতিস্তম্ভে ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’ কথাগুলো খোদাই করা আছে। কচুয়ায় মুক্তিযুদ্ধের একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [তাপস কুমার বিশ্বাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড