মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী
এম মনসুর আলী, ক্যাপ্টেন (১৯১৯-১৯৭৫) অন্যতম জাতীয় নেতা ও মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর অর্থমন্ত্রী। ১৯১৯ সালের ১৬ই জানুয়ারি বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানার কুড়িপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরফ আলী সরকার এবং মাতার নাম বেগম রওশন আরা। তিনি ১৯৩৭ সালে সিরাজগঞ্জের বি এল হাইস্কুল থেকে এন্ট্রাস এবং ১৯৩৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪১ সালে বিএ পাশ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে আলীগড় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং পরের বছর এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পাবনায় ফিরে এসে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। তিনি পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতিরবার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। তিনি পাবনা আমিনউদ্দিন আইন মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।
এম মনসুর আলী পাকিস্তান আন্দোলনকালে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তাই তাঁর নামের আগে ক্যাপ্টেন যুক্ত হয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৫২ সাল থেকে মনসুর আলী সক্রিয়ভাবে -আওয়ামী লীগ-এর সঙ্গে যুক্ত হন। একই সালে তিনি পাবনায় ভাষা-আন্দোলন- এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে গ্রেপ্তার বরণ করেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে তিনি দলের অন্যতম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমএলএ নির্বাচিত হন। ১৯৫৬-১৯৫৮ সময়ে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হলে তিনি ঐ সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও এর সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পরে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথমে যোগাযোগ এবং পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করা হলে তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন আর বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রপতি।
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহযোগী। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত ৬ সদস্যবিশিষ্ট মুজিবনগর সরকার- নামে খ্যাত বাংলাদেশ সরকারের তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নৃশংস হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী মোশতাক সরকারের সঙ্গে কোনোরূপ সহযোগিতা না করায় ২২শে আগস্ট ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী অপর তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। সে অবস্থায় ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে গভীর রাতে একদল সেনাসদস্যের হাতে তিনিসহ চার জাতীয় নেতা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। মোশতাক সরকারের সিদ্ধান্তেই এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরিবারের সদস্যদের কর্তৃক বনানী কবরস্থানে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়।
বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম থেকে শুরু করে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করা এবং স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের পুনর্গঠনে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীসহ জাতীয় চার নেতা যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, তা জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড