বীর প্রতীক এম হামিদুল্লাহ খান
এম হামিদুল্লাহ খান, বীর প্রতীক (১৯৩৮-২০১১) বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মেজর আবু তাহের আহত হওয়ার পর ১১নং সেক্টরের কমান্ডার। তিনি ১৯৩৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের লৌহজং থানার মেদিনীমণ্ডল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দবিরুদ্দিন খান ও মাতা জসিমুন্নেসা। তিনি পারিবারিভাবে বাঙালি সংস্কৃতির আবহে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৫৪ সালে লৌহজং কাজির পাগলা এ টি ইনস্টিটিউট থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৯ সালে একই কলেজ থেকে বিকম ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর রিসালপুর একাডেমিতে ৩৪তম জিডি ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দান করেন। দুবছর প্রশিক্ষণশেষে ১৯৬২ সালে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকায় বিমান বাহিনীর সহকারী প্রভোস্ট মার্শাল হিসেবে ৫নং পি এন্ড এস-এর কমান্ডিং অফিসার এবং তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ডেপুটি ডাইরেক্টর (নিরাপত্তা) নিযুক্ত হন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস বাঙালি হত্যার প্রতিবাদে তিনি বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। তখন তাঁর র্যাংক ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে বহু প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি প্রথমে ত্রিপুরার মেলাঘরে এবং পরে আগরতলায় পৌঁছান। ২৯শে এপ্রিল তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহৎ গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্প ভারতের বিহারের চাকুলিয়ায় বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধান সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ২৫শে জুন উত্তর ফ্রন্টে তাঁর ওপর মেজর জিয়ার অধীন ‘জেড’ ফোর্সের সদর দপ্তর ন্যস্ত করা হয়। তিনি ১১- ১৭ই জুলাই কর্নেল ওসমানীর সভাপতিত্বে কলকাতার থিয়েটার রোডে তাঁর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডার্স কনফারেন্সে যোগ দেন।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান থেকে এসে মেজর তাহের ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করলে হামিদুল্লাহ খান তাঁর সঙ্গে এ সেক্টরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাঁরা ৭ নম্বর সেক্টরভুক্ত বিভিন্ন স্থানেও যুদ্ধ করেন। হামিদুল্লাহ খান গাইবান্ধা, রৌমারী, রাজিবপুর, মধুপুরসহ ৩০টিরও অধিক স্থানে সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে স্কোয়াড্রন লিডার পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কুড়িগ্রামের চিলমারী যুদ্ধ। চিলমারী ছিল একটি বন্দর এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় অন্যান্য স্থানের সাথে সংযুক্ত। পাকিস্তানি বাহিনী দুটি কোম্পানি ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তখন চিলমারীতে অবস্থান করছিল। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তারা সুরক্ষিত বাংকার তৈরি করেছিল। ১১ই অক্টোবর পাকবাহিনীর এ শক্তিশালী ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। প্রথম আক্রমণেই জোড়াগাছা, রাজভারটা, পুলিশ স্টেশন ও সেতু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তাহের এবং হামিদুল্লাহ পুলিশ স্টেশন থেকে সেখানে পাকহানাদারদের মওজুদ করা প্রচুর সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরাপদ অবস্থান গাজীরচরে সরিয়ে নেন। ১২ই নভেম্বর তাঁদের নেতৃত্বে মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি অবস্থান বান্দরকাটা আক্রমণ করেন। স্থানটি হানাদারমুক্ত হয় এবং সেখানে ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৪ই নভেম্বর কামালপুরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিসেনাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। এ- যুদ্ধে মেজর তাহের মারাত্মকভাবে আহত হন। যুদ্ধে হামিদুল্লাহ খান বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুপক্ষের অনেক সৈন্য হতাহতসহ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হন। মেজর তাহের আহত হওয়ায় উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানকে ১১ নম্বর সেক্টরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নেবার পর তিনি চিলমারী ও কামালপুরের পরবর্তী যুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। তিনি ঢাকা অভিযানে মিত্রবাহিনী-কে সাপোর্ট দিয়ে ৮ই ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার ও জয়দেবপুরে পৌঁছান। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সরকার হামিদুল্লাহ খানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান ১৯৭৮ সালে বিমান বাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে মুন্সিগঞ্জ-২ আসন থেকে বিএনপি-র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের ৩০শে ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বনানী আবাসিক এলাকার ২৩ নম্বর সড়কটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম রাবেয়া সুলতানা খান। এ দম্পতির ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ ও শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
তথ্যসূত্রঃ জাতীয় সংসদের স্পিকার কর্তৃক ২০১২ সালের ২৫শে জানুয়ারি উত্থাপিত শোক প্রস্তাব
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড