You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক এম হারুন-আর-রশিদ - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক এম হারুন-আর-রশিদ

এম হারুন-আর-রশিদ, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৭) পূর্ব রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান। ১৯৪৭ সালের ৩১শে আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাট অধীন ধলই গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম ডা. মাহমুদুল হক এবং মাতা জরিনা বেগম। তিনি ১৯৬৪ সালে জাহানপুর হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞানে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আইএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অবস্থায় ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে যোগদানের নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুর এয়ার ফোর্স একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। দুবছর সেখানে অতিবাহিত করার পর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে তাঁকে এয়ার ফোর্স ক্যাডেট জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়। এ কারণে যথাসময়ে তাঁর পক্ষে কলেজ শিক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার ফল প্রকাশের পূর্বে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে নির্বাচনী পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং তাতে সফলকাম হয়ে ১৯৭০ সালের শুরুতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি মিরপুরস্থ ডিফেন্স সার্ভিসেস এন্ড স্টাফ কলেজ এবং যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব ডিফেন্স স্টাডিজ থেকে সামরিক বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রলয়ংকর উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা কার্যে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন মানুষের প্রতি চরম ঔদাসীন্য তাঁকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। সেনাবাহিনীতে চাকরির সুযোগে তাঁর এ অভিজ্ঞতাও হয় কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক অফিসাররা বাঙালিদের ঘৃণার চোখে দেখে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে -আওয়ামী লীগ-এর বিজয় কিছুতেই পাকিস্তানিদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে তারা নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। বাঙালি সৈনিকদের পক্ষ থেকে কোনোরূপ প্রতিরোধ যাতে সংঘটিত না হতে পারে, সেজন্য ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ শুরুর পূর্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাসদস্যদের ছোট-ছোট দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এভাবে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি এবং মেজর সাদেক নেওয়াজ (পশ্চিম পাকিস্তানি)-এর নেতৃত্বে অপর একটি কোম্পানিকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। লে. হারুন ছিলেন মেজর সাদেক নেওয়াজের কোম্পানির অফিসার। এসবই যে ছিল পাকিস্তানিদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের অংশ, তা বাঙালি সৈনিকরা সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ২৫শে মার্চের ক্রাকডাউনের খবর পাওয়ার পর থেকেই তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্রোহের কথা চিন্তা করতে থাকেন এবং ২৭শে মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে ব্যাটালিয়ান কমান্ডার লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান ও মেজর সাদেক নেওয়াজসহ উপস্থিত ও অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি সকল অফিসার ও সেনাসদস্যদের বন্দি করেন। এ ক্ষেত্রে লে. হারুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একই দিন মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম- তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী নিয়ে সিলেটের শমশেরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে মেজর শাফায়াত জামিল ও বিদ্রোহী অন্যদের সঙ্গে যোগ দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত হয়। ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারে সৈন্য অবতরণ করানোসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সর্বাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করলে প্রতিরোধ যোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নিজেদের ডিফেন্স প্রত্যাহার করে আখাউড়া অঞ্চলে নুতন করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। গঙ্গাসাগরসহ অত্র এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। সে- যুদ্ধে লে. হারুন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কৌশলগত কারণে এখান থেকেও মুক্তিবাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। এরপর শুরু হয় হানাদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র প্রতিরোধ, এম্বুশ, গেরিলা অপারেশন ও সম্মুখ যুদ্ধ। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত করা হলে লে. হারুন মেজর খালেদ মোশাররফের অধীন ২নং সেক্টরে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১২ কিমি উত্তরে ভারত সীমান্তবর্তী কালাচড়া চা-বাগানে পাকহানাদার বাহিনীর একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ২রা আগস্ট লে. হারুনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত নার্সিনগড় বেইজ থেকে এসে পাকিস্তানি এ ঘাঁটিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেন। এখানকার যুদ্ধে বহু পাকসেনা হতাহত হয়, ১২ জন সেনাসদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়। এ-যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অক্টোবর মাসে সেনাবাহিনীর ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠিত হলে লে. হারুন মেজর আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বহু পাকসেনা হতাহত করতে সক্ষম হন। ৮ই ডিসেম্বর শত্রুর কবল থেকে কুমিল্লা শহর মুক্ত করার যুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। হারুন-আর-রশিদ, বীর উত্তম ২০০০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। একই সঙ্গে তাঁকে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ২০০২ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। এরপর বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে কয়েকটি দেশে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: Lt. General M. Harun- Ar-Rashid, Bir Pratik (Rtd.), Journey to Freedom: Memoirs of a Freedom Fighter, Dhaka, Shahitya Prakash 2013

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড