এম আবদুল আলী
এম আবদুল আলী (১৯২৬-১৯৭১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মুকসুদপুর থানার বালিয়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুন্সি আবদুল ওয়াহেদ মিয়া ও মাতা মোছাম্মৎ আকিরুননেছা। মুন্সি আবদুল ওয়াহেদ মিয়ার চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে এম আবদুল আলী ছিলেন সবার বড়।
ভারতের বালুয়াঘাট মহকুমার (বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত) মহারানী ভিক্টোরিয়া স্কুলে আবদুল আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। মেধাবী আবদুল আলী প্রত্যেক শ্রেণিতে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে এ স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাস করেন এবং সংস্কৃত বিষয়ে লেটারমার্কস পাওয়ায় তাঁকে মহারানী গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি নাটোর শহরের মিরপাড়া গ্রামের আবদুল করিম মিয়ার কন্যা বেগম আনোয়ারাকে বিবাহ করেন।
রাজশাহী কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করার পরপর এম আবদুল আলী ১৯৪৬ সালে রংপুর সদরে খাদ্য অফিসে ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তাঁকে দিনাজপুরে বদলি করা হয়। সেখানে তিনি চিলির বন্দর থানায় খাদ্য অফিসে ইন্সপেক্টর হিসেবে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ইপিসিএস (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, বর্তমানে বিসিএস – বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সে বছরেরই ৮ই নভেম্বর সাব-ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে কুমিল্লা সদরে সার্কেল অফিসার (সিও) পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাঁকে নেত্রকোনোর সুমদুর্গাপুর থানায় বদলি করা হয়। ১৯৫৮ সালের ১লা জানুয়ারি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে পদোন্নতি দেয়া হলে তিনি টাঙ্গাইল মহকুমায় যোগদান করেন। সেখানে দুমাস চাকরি করার পর তাঁকে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট পদে ময়মনসিংহ হেডকায়ার্টার্সে বদলি করা হয়। পরবর্তীতে তিনি নোয়াখালী ও চুয়াডাঙ্গায়ও চাকরি করেন। ১৯৭০ সালের ২০শে নভেম্বর এম আবদুল আলী রাঙামাটির এসডিও হিসেবে যোগদান করেন। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্দেশেই তিনি এ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রশাসনিক কাজে দক্ষতা ও সততার জন্য তাঁর বেশ সুনাম ছিল।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে উদ্দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তখন এম আবদুল আলী দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদেরকে জেলা সদরের পুলিশ লাইন ও স্টেশন ক্লাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুলিশ সুপার বজলুর রহমান।
২৫শে মার্চের আগে এম আবদুল আলী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও পুলিশ বাহিনীর অবাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে ক্লোজ করে নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে বাঙালি সৈনিকদের প্রস্তুত রাখা হয় যাতে তাঁরা নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই রাঙামাটি শহরে চলে আসতে এবং অবাঙালি সদস্যদের গ্রেফতার করতে পারেন। ২৫শে মার্চের পর রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ ও পুলিশ সুপার বজলুর রহমানসহ প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্তের ওপারে চলে যান। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ বারবার বলার পরও এম আবদুল আলী ওপারে যাননি। দিন যতই গড়াতে থাকে, রাঙামাটি ততই জনশূন্য হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু এম আবদুল আলী শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়ে মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সাহস যোগাতে থাকেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র যোগানের ব্যবস্থাও করেন।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় রাঙামাটি দখল করে। এম আবদুল আলী তখনো জানতেন না যে, রাঙামাটি শত্রুবাহিনীর দখলে। তিনি ১৬ই এপ্রিল স্পিড বোটে করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডিসি বাংলোঘাটে আসেন। বোট ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ছুটে আসে। শত্রুবাহিনী রাঙামাটি দখলে নিয়েই জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান এবং এসডিও (মহকুমা প্রশাসক) এম আবদুল আলীর মতো সরকারের বাঙালি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খুঁজছিল। আবদুল আলী যেহেতু স্পিডবোটযোগে এসেছেন, সেহেতু নিশ্চয় কোনো বড় সরকারি কর্মকর্তা হবেন – এরূপ ভেবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে তাদের কমান্ডারের কাছে নিয়ে যায়। তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা রাইফেলের বাট দিয়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেয়। আর বোটের পাটাতন ওল্টাতেই দেখে বস্তাভর্তি সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এ-সময় এম আবদুল আলীর সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে ইউসুফ হারুনও ধৃত হন। প্রথমে আবদুল আলীকে জিজ্ঞেস করা হয় – এইচ টি ইমামসহ প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা কোন পথ দিয়ে গিয়ে কোথায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাদের অস্ত্র ও রসদ কোথা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু এম আবদুল আলী কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছিলেন না। এরপরই তাঁর ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। তাঁর কাছ থেকে কথা বের করার জন্য প্রথমে তাঁর আঙ্গুলে সুঁচ ফোটানো হয়। এরপর হাতের সব আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। এতদ্সত্ত্বেও যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা কোনো তথ্যই বের করতে পারছিল না, তখন পিতা-পুত্রের ওপর অভিনব কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। তাঁদের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে বেত্রাঘাত করা হয়। অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হয়। তাঁদের এই করুণ অবস্থা দেখে পাহাদারের মনে দয়া হয়। তিনি জানালার শিক খুলে দিয়ে ছেলে ইউসুফ হারুনকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এদিকে পুত্র পালিয়ে যাওয়ার পর পিতার ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। একদিন তাঁকে লম্বা রশি দিয়ে জিপের পেছনে বেঁধে টানা হয়। চলন্ত জিপের পেছনে কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পর এম আবদুল আলী রাস্তায় পড়ে যান। এতে তাঁর শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। এভাবে এম আবদুল আলীর ওপর নির্মম নির্যাতন চলানো হয়। তাঁর শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হয়। ক্ষুধা আর পিপাসায় ছটফট করে খাবার ও পানি চাইলে মুখের মধ্যে ইট ঢুকিয়ে দেয়া হতো। আবদুল আলীকে খোলা জায়গায় এনে অন্য বন্দিদের দেখিয়ে হানাদাররা তাঁকে গরম ড্রামের ছ্যাঁকা দিত, যাতে তারাও ভয়ে ভীত হয়। নির্যাতনের ফলে আবদুল আলীর কপালের সামনে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ঐ ক্ষত স্থানে লবণ ঢেলে দেয়। আবদুল আলী যন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকার করতেন। আর হানাদাররা তখন উল্লাসে ফেটে পড়ত। এভাবে দীর্ঘ ১২ দিন নির্মম নির্যাতনের পর ২৭শে এপ্রিল ক্ষত-বিক্ষত আবদুল আলীর নিথর দেহটি কেটে টুকরো-টুকরো করে বস্তাবন্দি অবস্থায় কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
এম আবদুল আলী রাঙামাটিতে এসডিও থাকাকালে শহরের ‘কায়েদে আজম মেমোরিয়াল একাডেমি’-র পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করে “শহীদ আবদুল আলী একাডেমি’ নামকরণ করা হয়। এছাড়া শহরের পুরাতন স্টেডিয়ামের পাশে আইয়ুব খানের আমলে স্থাপিত একটি ফলক উপড়ে ফেলে সেখানে এম আবদুল আলীর নামে একটি বেদী নির্মাণ করা হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ এম আবদুল আলীকে ২০১৬ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড