You dont have javascript enabled! Please enable it! ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট-এর ম্যানিফেস্টো একুশদফা কর্মসূচি একুশদফা কর্মসূচি - সংগ্রামের নোটবুক

একুশদফা কর্মসূচি

একুশদফা কর্মসূচি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট-এর ম্যানিফেস্টো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সাত বছর পরে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ-এর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের অবসানকল্পে ১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বিরােধী দলের সম্মিলিত নির্বাচনি মাের্চা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ অনুযায়ী ঐ বছর ৪ঠা ডিসেম্বর ৪টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনি জোট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দলগুলাে ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি ও হাজী মােহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল।
যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২১ দফা সম্বলিত যে নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো ঘােষণা করা হয় তা-ই একুশদফা নামে পরিচিত। সংক্ষেপে এই একুশদফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:
১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা।
২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সকল খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা। খাজনার পরিমাণহাস এবং সার্টিফিকেট জারির মাধ্যমে খাজনা আদায় প্রথা রহিত করা।
৩. পাটব্যবসা জাতীয়করণ করে তা পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং মুসলিম লীগ শাসনামলে পাটকেলেঙ্কারির তদন্ত ও অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করা।
৪. কৃষিক্ষেত্রে সমবায় প্রথা প্রবর্তন এবং সরকারি অর্থসাহায্যে কুটিরশিল্পের উন্নয়ন সাধন করা।
৫. পূর্ববঙ্গকে লবণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং লবণ কেলেঙ্কারির তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।
৬. কারিগর শ্রেণির গরিব মােহাজেরদের কর্মসংস্থানের আশু ব্যবস্থা করা।
৭. খাল খনন ও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে বন্যা ও দুর্ভিক্ষ রােধের সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া।
৮. পূর্ববঙ্গে কৃষি ও শিল্প খাতের আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশকে স্বাবলম্বী করা এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) মূলনীতি অনুযায়ী শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা।
৯. দেশের সর্বত্র অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা।
১০. শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যকার বৈষম্য বিলােপ করে সকল বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্যপুষ্ট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইনসহ সকল প্রতিক্রিয়াশীল আইন বাতিল করে সকলের জন্য উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করা।
১২. শাসন পরিচালনা ব্যয় হ্রাস করা; যুক্তফ্রন্টের কোনাে মন্ত্রী এক হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করবেন না।
১৩. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ- রিওয়াত বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৪. জননিরাপত্তা আইন, অর্ডিন্যান্স ও অনুরূপ কালাকানুন বাতিল, বিনাবিচারে আটক বন্দির মুক্তি, রাষ্ট্রদ্রোহিতায়। অভিযুক্তদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অবাধ অধিকার নিশ্চিত করা।
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা।
১৬. বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) পরিবর্তে কম বিলাসের বাড়িতে যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রীর আবাসস্থল নির্ধারণ করা এবং বর্ধমান হাউসকে প্রথমে ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা।
১৭. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে শহীদ মিনার নির্মাণ এবং শহীদদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া।
১৮. একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা করা।
১৯. লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত সকল বিষয় পূর্ববাংলা সরকারের অধীনে আনয়ন; দেশরক্ষাক্ষেত্রে স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স পশ্চিম পাকিস্তানে এবং নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন; এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রনির্মাণ কারখানা স্থাপন ও আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা।
২০. কোনাে অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কর্তৃক আইন পরিষদে অবস্থানের মেয়াদ বাড়ানাে যাবে না; নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
২১. যুক্তফ্রন্টের আমলে সৃষ্ট শূন্য আসনে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট-প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা।
একুশদফা ম্যানিফেস্টোতে পূর্ববাংলার আপামর জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, জমিদারি স্বত্ব উচ্ছেদ, খাজনা হ্রাস, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল, কারিগর শ্রেণির দরিদ্র লােকদের কর্মসংস্থান, খাল খনন ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, উচ্চশিক্ষা সহজলভ্যকরণ, পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পূর্ববাংলার কৃষক শ্রমিকসহ সকল শ্রেণির জনগণের মধ্যে বিপুল প্রত্যাশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। পূর্ববাংলার জনপ্রিয় নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট অচিরেই জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে। [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড