এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ
এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ (১৯১৬-২০০৫) বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর কূটনৈতিক চ্যানেলে চাপ প্রয়ােগ, লন্ডনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন স্থাপনে সুযােগ দান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাজ্য সফর কালে তাকে সাদরে গ্রহণ, জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে মার্কিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভােটদান থেকে বিরত থাকা, পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে ৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ও Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রাপ্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
এডওয়ার্ড হিথ ১৯১৬ সালের ৯ই জুলাই কেন্ট শহরে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চ্যাথাম হাউস গ্রামার স্কুলে অধ্যয়নের পর তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় সঙ্গীত ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ও দক্ষতার প্রকাশ ঘটে। অক্সফোর্ড থেকে ১৯৩৯ সালে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিএ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে হিথের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তিনি অক্সফোর্ড কনজার্ভেটিভ এসােসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। হিথ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একজন সেনানী হিসেবে অংশ নেন। দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের বেক্সলি থেকে তিনি ১৯৫০ সালে প্রথম পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টের চিফ হুইপ, ১৯৫৯ সালে শ্রমমন্ত্রী, ১৯৬৫ সালে কনজার্ভেটিভ পার্টির দলনেতা এবং ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ কমন্সসভার সদস্য থাকায় তিনি ‘ফাদার অব দি হাউস’ ছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ পাকিস্তান সফর করেন। এসময় পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সম্পর্কে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অবহিত হন। মার্চ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে ব্রিটেনের পক্ষ থেকে প্রথমে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। ৭ই এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রেরিত এক ব্যক্তিগত বার্তায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিথ …যতাে শীঘ্র সম্ভব [পূর্ব পাকিস্তানে] …রক্তপাত ও শক্তি প্রয়ােগ বন্ধ ও আলােচনায় বসা উচিত বলে তার ওপর পরােক্ষভাবে চাপ প্রয়ােগ করেন। এরপর ইয়াহিয়া তার বিশেষ দূত মিয়া আরশাদ হুসাইনকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করে। তাকেও হিথ পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন। পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধে বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের আহ্বানের প্রতি হিথ ইতিবাচক সাড়া দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই লন্ডনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ হয়। আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত এ কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধানমন্ত্রী হিথের সরকার এসব কার্যক্রমের প্রতি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক মনােভাব প্রদর্শন করে। আগস্ট মাসে ইয়াহিয়া গােপন প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করলে প্রধানমন্ত্রী হিথ এর বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চ্যানেলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যাতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারে সেজন্য হিথ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগের আহ্বান জানান। অক্টোবর মাসে ইন্দিরা গান্ধী- যুক্তরাজ্য সফরে গেলে প্রধানমন্ত্রী হিথ তাঁকে আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং দুই নেতার মধ্যে চেকার্স-এ দীর্ঘ একান্ত বৈঠক হয়। ইন্দিরা গান্ধীকে এভাবে গ্রহণ করার মধ্যেও বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিথের ইতিবাচক মনােভাব প্রকাশ পায়। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাজ্য ৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিন্নতর অবস্থান গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও প্রথানমন্ত্রী হিথের নেতৃত্বে ব্রিটেন কার্যত ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। জাতিসংঘে ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতপাকিস্তান যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে। যুক্তরাজ্য মার্কিন এ প্রস্তাবে সমর্থন না দিয়ে ভােটদানে বিরত থাকে। কেবল বিরতই থাকেনি, ফ্রান্সকেও ভােটদানে বিরত থাকতে সম্মত করে। যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের এ অবস্থানকে চরম ‘অবন্ধুত্বসুলভ’ বলে চিহ্নিত করে। যুক্তরাজ্যের এরূপ বিরত থাকাটা ছিল প্রধানমন্ত্রী হিথের সরকারের বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। যুক্তরাজ্যের এ অবস্থান জাতিসংঘে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।
পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমে লন্ডন এলে প্রধানমন্ত্রী হিথ তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর একান্ত বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিথকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের ব্যাপারে সহযােগিতার অনুরােধ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে সাড়া দিয়ে যুক্তরাজ্য ১৯৭২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ইউরােপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েলথের স্বীকৃতি লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে এডওয়ার্থ হিথ ও তাঁর সরকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথকে Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করে। বাংলাদেশের বহির্দেশীয় বন্ধু চিরকুমার এডওয়ার্ড হিথ ৮৯ বছর বয়সে ২০০৫ সালের ১৭ই জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। [জালাল আহমেদ]
তথ্যসূত্র: Harun-or-Rashid, ‘British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971′, Contemporary South Asia, 1995, Oxford 4(2); হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়ােদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা ২০১০; মাসুদা ভাট্টি, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ : ব্রিটিশ দলিলপত্র, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ঢাকা ২০১০
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড