এ এইচ এম কামারুজ্জামান
এ এইচ এম কামারুজ্জামান (১৯২৩-১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, আওয়ামী লীগ- হাইকমান্ডের সদস্য, জাতীয় চার নেতার অন্যতম, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, স্বাধীনতাপরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সভাপতি, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় খুনিচক্র কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত। অন্যতম জাতীয় নেতা ও মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার মন্ত্রী। ১৯২৩ সালের ২৬শে জুন রাজশাহী জেলার নাটোরের বাগাতিপাড়া থানার নূরপুর গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। তাঁর পূর্ণ নাম আবুল হাসনাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামান। ডাক নাম হেনা। হেনা নামেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পিতার নাম আবদুল হামিদ মিয়া এবং মাতার নাম জেবুন নেসা। তাঁর পৈতৃক নিবাস রাজশাহীর কাদিরগঞ্জে। তাঁর পিতা এবং পিতামহ ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অতএব রাজনৈতিক পরিবারেই এ এইচ এম কামার জ্জামানের জন্ম। এ পরিবার ছিল অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আদর্শের অনুসারী। তাঁর পিতামহ লাল মােহাম্মদ সরদার ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী। পিতা-মাতার ১২ সন্তানের মধ্যে কামারুজ্জামান ছিলেন সবার বড়। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ফুফার তত্ত্বাবধানে তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু। ফুফা আবদুল হামিদ ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। ফুফার চাকরির বদলিজনিত কারণে তাঁকে তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রাম চলে যেতে হয়। সেখানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯৪২ সালে তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেন। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে তিনি এ কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঐ বছরই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর তিনি রাজশাহীতে ফিরে ১৯৫৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে প্রথম বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি রাজশাহী জজ কোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে তিনি বগুড়ার দুপচাচিয়া থানার চামরুল গ্রামের তালুকদার পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রীর নাম জাহানারা জামান। এ দম্পতির দুই পুত্র ও চার কন্যা রয়েছে।
১৯৪২ সালে রাজশাহী কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় কামারুজ্জামানের সক্রিয় রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে। বিভাগপূর্ব কালে তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হন এবং রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ-এ যােগদান করেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটির ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় তিনি দুবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে এনডিএফ (ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট) থেকে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জোরালাে অবস্থান নেন। ১৯৬৭ সালে পিডিএম (পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট)-এর ৮-দফা বনাম বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দিলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের পদ থেকে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান (পশ্চিম পাকিস্তান)-কে বহিষ্কার করে তদৃস্থলে যে কমিটি গঠন করা হয়, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ছিলেন তার আহ্বায়ক। ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালে পুনর্বার তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যে ১০ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠন করা হয়, এ এইচ এম কামারুজ্জামান তার অন্যতম সদস্য হিসেবে তাতে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালের আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে কামারুজ্জামান দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। এজন্য সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁকে মন্ত্রিত্বের পদ ছেড়ে দিতে হয় (তখন তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন)।
এ এইচ এম কামারুজ্জামান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে গড়ে ওঠা ‘আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড’-এর তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানে ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট যে সরকার গঠিত হয়, তিনি তাতে অন্তর্ভুক্ত হন। ঐ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে তিনি গুরু দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনে তিনি সর্বদা ত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দেন। কঠিন প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি ছিলেন খুবই ধীর-স্থির।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠিত হয়, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ঐ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত সরকারে তিনি একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে নিয়ােজিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশী-বিদেশী চক্রের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সংঘটিত নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য নিহত হবার পর ২২শে আগস্ট ক্ষমতা দখলকারী মােশতাক সরকার বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর ও তাঁর প্রতি আমৃত্যু বিশ্বস্ত অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে এ এইচ এম কামারুজ্জামানকেও গ্রেপ্তার করে। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় একই বছর ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে তাঁদের সকলকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। পরিবারের সদস্যদের কর্তৃক তাঁকে রাজশাহী পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের বিরুদ্ধে। বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় চার নেতার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সফল নেতৃত্বদান বাঙালির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমী ২০১২; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ২০১৮ (৪র্থ মুদ্রণ); জাতীয় চার নেতা স্মারকগ্রন্থ, চাতীয় চার নেতা পরিষদ ১৯৯৯; সালিম সাবরিন, এএইচএম কামারুজ্জামান, ঢাকা, উৎস প্রকাশন ২০১৭
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড