বীর বিক্রম এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান
এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম (১৯৪২১৯৮১) বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং ১ নম্বর সেক্টরে প্রথমে শ্রীনগর ও পরে মনুঘাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক। তিনি ১৯৪২ সালে কিশােরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার গনেরগাও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা সাইদুর রহমান এবং মাতার নাম রেহান আরা খাতুন। তাঁর পিতা পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। মাহফুজুর রহমান কিশােরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মােহন কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ বছরই তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যােগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এবােটাবাদের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৬৮ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। তারপর তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পােস্টিং পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মাহফুজুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট পদে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, একাত্তরের মার্চ মাসে এ রেজিমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়ান সেনাবানিবাসে বদলির আদেশ পেয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে হালিশহরে অবস্থান করছিল। রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম। লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান ছাড়াও এ ইউনিটের অন্যান্য বাঙালি অফিসার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, বীর বিক্রম, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন সাদেক হােসেন, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম) প্রমুখ। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রভাব এসে পড়ে চট্টগ্রামে। লেফটেন্যান্ট মাহফুজরসহ এ রেজিমেন্টের সকল বাঙালি সদস্য ২৫শে মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করেন। মাহফুজুর বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধযুদ্ধ করেন। এর মধ্যে ৩০-৩১ মার্চ তারিখে সংঘটিত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নিকটবর্তী কৃষি ভবন আক্রমণ ও ২৭শে এপ্রিল সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার মহালছড়ি যুদ্ধ উল্লেখযােগ্য। উভয় অপারেশনেই লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের প্রতিহত করেন। এ-যুদ্ধে কৃষি ভবনে অবস্থানরত পাকিস্তানি কমান্ডাে প্লাটুনের ৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা এ-যুদ্ধে রাইফেল, হালকা মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার, পিস্তলসহ বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করেন। উল্লেখ্য, এ প্রতিরােধযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হননি।
প্রতিরােধযুদ্ধ শেষে লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হবার পর ফিরে আসেন। তারপর সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১নং সেক্টরে প্রথমে শ্রীনগর এবং পরবর্তীতে মনুঘাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি পাকিস্তানি শত্রুসেনাদে বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দেন। ২৭শে জুলাই তাঁর নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা হেঁয়াকোতে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। হেঁয়াকো দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং এটি ছিল পাকসেনাদের সহযােগী মিজো অধুষ্যিত। পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে, তাদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ হতে পারে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এছাড়াও মুক্তিযােদ্ধাদের ছােড়া মর্টার শেলের আঘাতে তাদের বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্য এবং মিজোরা মুক্তিযােদ্ধাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। লেফটেন্যান্ট মাহফুজুরের সাহসিকতা, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিমত্তার ফলে মুক্তিযােদ্ধারা চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যান। কোন প্রকার ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই তাঁরা। নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে সক্ষম হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মাহফুজুর রহমান তার কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৭ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় মাহফুজুর রহমান ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এডজুট্যান্ট, যশাের ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-১ এবং রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কথিত অভিযােগের ভিত্তিতে ৪ঠা জুন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহফুজুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৭ই জুন তাকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৪ঠ জুলাই তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসনমূলক এক বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২৩শে সেপ্টেম্বর এ বীর মুক্তিযােদ্ধার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম আনােয়ারা মাহফুজ। এ দম্পতির ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [সাজাহান মিয়া]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, দশম খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সেক্টর-১, ২০০৬
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড