You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর উত্তম এ কে খন্দকার - সংগ্রামের নোটবুক

বীর উত্তম এ কে খন্দকার

এ কে খন্দকার, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৩০) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তাঁর পূর্ণ নাম আব্দুল করিম খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হয়। তিনি ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকালে তাঁর র্যাংক ছিল গ্রুপ ক্যাপ্টেন।
এ কে খন্দকার পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার পুরান ভারেঙ্গা গ্রামের অধিবাসী। তার পিতার নাম খন্দকার আব্দুল লতিফ এবং মাতার নাম আরেফা খাতুন। পিতার কর্মস্থল রংপুরে ১৯৩০ সালের ১লা জানুয়ারি তাঁর জন্ম। পিতার চাকরির সুবাদে তাঁকে বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী ও মালদহে পড়াশােনা করতে হয়। নওগাঁ মিউনিসিপ্যাল স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। এরপর ১৯৪৭ সালে মালদহ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট)-এ ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাতে যােগ দেন এবং ১৯৫২ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন।
১৯৫১ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত বিমান বাহিনীর বিভিন্ন পদমর্যাদায় তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে কাটে। ১৯৬৯ সালের ৪ঠা মার্চ তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঢাকা ঘাঁটিতে উইং কমান্ডার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর ফলে আইয়ুব খানের পতন, নতুন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতায় আরােহণ, ৭০এর প্রথম সাধারণ নির্বাচন, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে তার ভােটদান, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়, পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নতুন করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ, ১৯৭১ সালের ২রা-২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন-এর ডাক, তার ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতির সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা, ২২শে মার্চ অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকদের ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘােষণা ইত্যাদি ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। এসব দেখে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কাছে অত্যাসন্ন মনে হয় এবং সে-জন্য তিনি মনে-মনে প্রস্তুতিও নেন।
২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে ইয়াহিয়ার সেনারা সশস্ত্র আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়লে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। ২৮শে মার্চ এ কে খন্দকার ২ সপ্তাহের জন্য ছুটির আবেদন করেন এবং তা মঞ্জুর হয়।
ইত্যবসরে অত্যন্ত গােপনে তিনি বিমান বাহিনীর বাঙালি কয়েকজন পদস্থ অফিসারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান সম্বন্ধে আলাপআলােচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। মার্চ মাসের শেষে একবার এবং এপ্রিল মাসের মধ্যভাগে আর একবার নিষ্ফল চেষ্টা শেষে তৃতীয় বারের সফল চেষ্টায় ১৫ই মে তিনি নিজ পরিবার ও বিমান বাহিনীর কয়েকজন বাঙালি অফিসারসহ ভারতের আগরতলা রাজ্যে পৌছাতে সক্ষম হন। সেখান থেকে বিশেষ বিমানে ১৬ই মে তিনি কলকাতা গিয়ে পৌঁছান। পরের দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে।
এ কে খন্দকার ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ বাঙালি অফিসার। তাই ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ, সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের নানা কৌশল সম্বন্ধে আলােচনায় বাংলাদেশ সরকার-এর পক্ষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার পর থেকে তিনি কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে কর্নেল ওসমানীর সদর দপ্তরে নিয়মিত বসতেন। জুনের প্রথম দিকে তিনি মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। মুক্তিযােদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং, যুদ্ধের জন্য দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ, বিভিন্ন সেক্টর গঠন, শত্রর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা, নৌ-কমান্ডাে ও বিমানবাহিনী গঠন, এক কথায়, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বাংলাদেশ সরকার ও প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই উদ্যোগ ও দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সিলেটের নিকটবর্তী ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে ২ মাস প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের দেয়া ৩টি বেসামরিক বিমান ও কয়েকজন বাঙালি বৈমানিক নিয়ে ২৮শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। বাঙালি বৈমানিকগণ হলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন, বৈমানিক ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দীন আহমেদ এবং বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন কাজী আবদুস সাত্তার। ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বৈমানিকগণ শত্রুর বিরুদ্ধে বেশ কিছু সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে যােগ দেন। তিনি এয়ার ভাইস-মার্শাল পদ পর্যন্ত উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা-উত্তর এ কে খন্দকারকে সরকার ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। ২০১১ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। জেনারেল এরশাদ এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০০৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠিত হলে তিনি তার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। [হারুন-অর-রশিদ]।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড