You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে উজিরপুর উপজেলা (বরিশাল) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে উজিরপুর উপজেলা

উজিরপুর উপজেলা (বরিশাল) বরিশাল জেলা সদর থেকে ২০ কিমি উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। লাল শাপলার বিল হিসেবে খ্যাত উজিরপুর উপজেলা মূলত একটি বিলাঞ্চল। সমস্ত উপজেলার মধ্যে খাল-বিল ও নদী-নালা জালের মতাে ছড়িয়ে আছে। এ উপজেলা ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। উপজেলার উত্তরে গৌরনদী, পূর্বে বাবুগঞ্জ, দক্ষিণে বানারীপাড়া ও ঝালকাঠী সদর এবং পশ্চিমে নাজিরপুর ও কোটালীপাড়া উপজেলা অবস্থিত। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে অন্যান্য স্থানের মতাে উজিরপুরেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের লীগ-এর সভাপতি আবদুল জব্বার মাস্টার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই নৌকায় দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় সফর করেছেন। তিনি নির্বাচনের প্রাক্কালে গ্রামের হাটে-বাজারে সভা-সমাবেশ করে পাকিস্তানিদের শাসন-শােষণ তুলে ধরে স্বাধীনতার কথা বলতেন। নির্বাচনের পর উজিরপুরের ধামুরা বাজারে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় সভা হতাে। এসব সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন বলে প্রচার করা হতাে। স্বাধীনতার কথা বলে আওয়ামী লীগের পক্ষে মানুষদের উদ্দীপ্ত করা হতাে। ৯ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের বাড়ি এ উপজেলায় হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে জোরালাে অবস্থান নেয়। উপজেলার বরাকোঠায় সাব-সেক্টর কমান্ডার শাজাহান ওমর, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৬ই অক্টোবর পর্যন্ত সাব-সেক্টর কমান্ডের অফিস ছিল। তাছাড়া উপজেলার অধিকাংশ স্থান জঙ্গল ও জলমগ্ন থাকায় গেরিলা যুদ্ধের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর উজিরপুর উপজেলায় এডভােকেট খায়রুল আনাম, হরনাথ বাইন এমপিএ, উপন্দ্রেনাথ বল্লভ, আব্দুর জব্বার মাস্টার, আবদুস সামাদ হাওলাদার (ডহরপাড়া), আবু তালেব, আবদুস সাত্তার, মহব্বত আলী সিকদার (বড়াকোঠা), মজিবর মাস্টার, আবদুর হালিম আকন, সৈয়দ আবদুল হাই, শহিদুল ইসলাম, আ ন ম আবদুল হাকিম প্রমুখের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এসময় চাখার ফজলুল হক কলেজের ভিপি হাবিবুর রহমান খান (পিতা মাহতাব আলী খান, নারায়ণপুর)-এর নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উল্লেখযােগ্য সদস্যরা হলেন- সৈয়দ সামসুল হক, আবদুল মান্নান সরদার, মােশাররফ হােসেন (জি এস চাখার ফজলুল হক কলেজ, কাচাবালিয়া), আবদুস সাত্তার (সাবেক ভিপি, চাখার ফজলুল হক কলেজ) প্রমুখ। চাখার ফজলুল হক কলেজের শিক্ষক প্রফেসর সৈয়দ আমিনুল ইসলাম জাকির ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর উজিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সিপাহি আবদুস ছত্তার, সিপাহি খন্দকার আবুল হােসেন, আনসার সদস্য মােবারক মাস্টার (কাবাডি টিমের বিখ্যাত খেলােয়ার), হেমায়েত বাহিনীর একজন সদস্য প্রমুখের নেতৃত্বে ধামুরা স্কুল মাঠে স্থানীয় ছাত্রযুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। এখানে লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়াও ক্রলিং, রােলিং এবং হাঁটু গেড়ে কীভাবে ফায়ারিং করতে হয়, তা শেখানাে হয়। আনসার বাহিনীর কতিপয় সদস্য এ প্রশিক্ষণে সহযােগিতা করেন। উজিরপুর ডব্লিউ বি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন মাঠে আলী হােসেন ফকির মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে নারায়ণপুর হাইস্কুল মাঠে পুলিশ সদস্য আবদুস সামাদ এবং মােশাররফ হােসেন ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে মঠবাড়িয়ার সৈয়দ সামসুল হক এমপিএ বরিশাল সচিবালয় থেকে অস্ত্র সহায়তা দেন। এ ক্যাম্পে তিন সহােদর হাবিবুর রহমান খান, হারুন-অর-রশীদ খান ও আবদুল লতিফ খানসহ কাজী মতিউর রহমান, সৈয়দ সামসুল হক, আবদুস ছাত্তার, আবদুল মান্নান সরদার, মােশাররফ হােসেন প্রমুখ। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মে মাস পর্যন্ত এখানে প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে হাবিব বাহিনী গঠিত হয়। গুঠিয়া, নারায়ণপুর ও চাখার এলাকায় আইন-শৃংখলা রক্ষা এবং উজিরপুরসহ আশপাশের এলাকার অনেকগুলাে যুদ্ধে হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযােদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। গুঠিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বামনায় একজন সেনাসদস্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মেজর এম এ জলিল এখানের প্রশিক্ষণে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তী সময়ে উপজেলার অনেক মুক্তিযােদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইলেকট্রিকাল মেকানিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের আবদুল ওয়াদুদ সরদার ২৭শে মার্চ অন্যান্য বাঙালি সেনাসদস্যের মতাে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বেইজ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমরের নেতৃত্বে আবদুল ওয়াদুদ সরদার, হাবিবুর রহমান খান, আব্দুল হক আলম শরীফ, নুরু কমান্ডার, আবদুল হাকিম বাহারামসহ ৬২ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি গ্রুপ নিয়ে ৭ই সেপ্টেম্বর উপজেলার বড়াকোঠার দরগাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করে ১৬ই অক্টোবর পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ ক্যাম্পের প্রধান হিসেবে ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ এবং অপারেশন পরিচালনা করেন। ১৬ই অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে পিছু হটে তাঁরা বিন্নায় চলে যান। ৫ই ডিসেম্বর উজিরপুর হানাদরমুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত এ বাহিনী সক্রিয় ছিল। এ বাহিনীর সদস্য ছিল ৩১৬ জন। বামরাইলের কাজীরায় আবদুল ওয়াদুদ সরদারের নেতৃতে ৪০-৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেন।
উজিরপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ, হরনাথ বাইন এমপিএ, আবদুল জব্বার মাস্টার, হারুন-অর-রশীদ মিয়া (ধামুরা), আবদুর রহমান খন্দকার, কেরামত আলী (বাটাজোড়), সুলতান হােসেন শরীফ, কমরেড শহীদুল ইসলাম শহীদ, কমরেড কালীরঞ্জন শীল ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে এঁরা জনমত গঠন এবং এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। হারুন-অর-রশীদ মিয়ার সঙ্গে আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ-র নিবিড় সম্পর্ক থাকায় তিনি সভা-সমাবেশে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরতেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সেনাসদস্য আবদুল আউয়াল হাওলাদার (মােরাকাঠী), হাবিবুর রহমান খান (নারায়ণপুর) এবং শেষদিকে আবদুল ওয়াদুদ সরদার (বেইজ কমান্ডার) উপজেলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া উপজেলার বিভিন্ন যুদ্ধ এবং অপারেশনে আ ন ম আব্দুল হাকিম (ধামুরা), নুরু কমান্ডার (বাবুগঞ্জ), রতন শরীফ (বাবুগঞ্জ), বেনী লাল দাশগুপ্ত (বানারীপাড়া) ভূমিকা রাখেন।
জুন মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিপাহি আব্দুল আউয়াল হাওলাদারের নেতৃত্বে মােরাকাঠীতে ২৪ জন সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে একটি স্থানীয় বাহিনী গড়ে ওঠে। গুঠিয়া, নারায়ণপুর ও চাখার এলাকায় হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে হাবিব বাহিনী এবং আব্দুল জব্বার মাস্টার (খাটিয়ালপাড়া)-এর নেতৃত্বে একটি স্থানীয় বাহিনী গড়ে ওঠে।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে বরিশাল থেকে স্থলপথে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন প্রতিরােধে কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা মাধবপাশা এবং গুঠিয়া ঘাটের ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেন। মুক্তিযােদ্ধা আবদুল আউয়াল, আ ন ম আবদুল হাকিম, রতন শরীফ, নুরু কমান্ডার, বেনীলাল দাশগুপ্তসহ মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল ও স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করে আসছিল। ৭ই সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, আবদুল ওয়াদুদ সরদার, মহিউদ্দিন মানিক, বীর প্রতীক-সহ মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বহর ৪টি নৌকা নিয়ে বড়াকোঠার দরগাবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন।
২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল শহর দখল করার সময় শিকারপুর ফেরিঘাটে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় এবং খাদ্যগুদামে ক্যাম্প স্থাপন করে। মে মাসের প্রথমদিকে হানাদার বাহিনী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বরিশাল ও গৌরনদী ক্যাম্প থেকে গানবােট ও লঞ্চ নিয়ে অপারেশন চালিয়ে অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ ও গণহত্যা শুরু করে। মে মাসের শেষদিকে তারা উজিরপুর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
যােগাযােগের সুবিধার্থে তারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক সুরক্ষার জন্য শিকারপুর এবং দোয়ারিকা ফেরিঘাট ও বামরাইল বাজারে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। এছাড়া জয়শ্রী ব্রিজের কাছে বাংকার স্থাপন করে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও রাজাকার অবস্থান করত।
পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশের পর সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়ার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। নূরু নাইয়া ছিল উপজেলায় শান্তি কমিটির প্রধান এবং শিকারপুরের গফুর মিয়া ছিল রাজাকার কমান্ডার। গফুর মিয়ার নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র রাজাকার ছিল, যারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভিন্ন এলাকায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। এলাকায় সে ছিল মূর্তিমান আতংক। সাতলা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল আক্কেল আলী বালী (পিতা কাহিল উদ্দিন বালী, সাতলা), সেক্রেটারি আবদুল মজিদ আজাদ (পিতা এলাহী বক্স, সাতলা)। এ ইউনিয়নের রাজাকার সদস্য হলাে- লতিফ খলিফা, মাজেদ খলিফা, আবদুল হালিম হাওলাদার, আবদুল হক হাওলাদার, আবদুল মজিদ মাস্টার, লতিফ বালী, রমজান বিশ্বাস, আফসার হাওলাদার প্রমুখ।
বড়াকোঠার সুলতান হােসেন ছিল সশস্ত্র রাজাকার। তার নেতৃত্বে হানাদার বাহিনী ধামুরা বাজারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে এবং গণহত্যা চালায়। তাছাড়া রশিদ জোমাদ্দার, খাদেম মিলিটারী, দুই সহােদর মাওলানা আবদুল জলিল ও শাহ আলম, আবদুস সামাদ গােমস্তা, তুজম্বর, আক্কাস, আবদুল জব্বার, সুলতান, হাকিম সরদার, মজিদ মিয়া, বনী তালুকদার, বেলাত আলী বিশ্বাস, হালিম মৌলভী, সাদেমন হাওলাদার, কেরামত, হেমায়েত উদ্দিন প্রমুখ ছিল কুখ্যাত রাজাকার। কুখ্যাত রাজাকার খাদেম মিলিটারী মাহিলারা এলাকার ১৭ জন সাধারণ মানুষকে মাহিলারা ব্রিজের ওপর নিয়ে হত্যা করে। এছাড়াও সে পাকবাহিনীর বাটাজোর মরার ভিটা গণহত্যায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মে মাস থেকে উজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গানবােট এবং লঞ্চে এসে ঘরবাড়ি, জনপদ ও বাজার আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা উজিরপুর বাজার, ধামুরা বাজার, গুঠিয়া বাজার, হারতা বন্দর, বড়াকোঠা দরগাবাড়ির আশেপাশের গ্রাম, ডহরপাড়া ও নারায়ণপুরে অগ্নিসংযােগ করে এবং গণহত্যা চালায়। তারা চাঙ্গুরিয়া গ্রামের ফকির বাড়ি, বেপারী বাড়ি, দফাদার বাড়ি, কারিগর বাড়ি, তেরড্রোন গ্রামের হাওলাদার বাড়ি, দফাদার বাড়ি, শােলক ভট্টাচার্য বাড়ি, পশ্চিম সাতলার অধিকারী বাড়ি, হালদার বাড়ি, বাড়ৈ বাড়ি, উত্তর সাতলার হরনাথ বাইন এমপিএ-র বাড়ি, হস্তিশুণ্ড গ্রামের গণেশ ডাক্তারের বাড়ি, কর্মকার বাড়ি, কাংশী গ্রামের সরদার বাড়ি, বেপারী বাড়ি ও হাওলাদার বাড়ি, বড়াকোঠার চন্দ্রকান্ত হালদারের বাড়ি, খাটিয়ালপাড়া গ্রামের বালা বাড়ি ও হাওলাদার বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে এবং গণহত্যা চালায়। তাদের দেয়া অগ্নিকাণ্ডে ধামুরা বাজারের প্রায় চার শতাধিক দোকান এবং পাশ্ববর্তী গ্রামের অধিকাংশ ঘর পুড়ে যায়। ১৭ই অক্টোবর বড়াকোঠা ইউনিয়নে আক্রমণ করতে যাবার পথে তারা কাংশী গ্রাম আক্রমণ করে। এ-সময় কাংশী গ্রামের আবদুল মজিদ (৫৪) (পিতা জেন্নাত আলী), আবদুল জব্বার বেপারী (৪০) (পিতা নাসির বেপারী), চান্দু হাওলাদার (১৮) (পিতা ওয়াজেদ কনস্টবেল) তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে উজিরপুর উপজেলায় অনেকগুলাে গণহত্যা সংঘটিত করে। সেগুলাের মধ্যে ধামুরা বাজার গণহত্যা, গুঠিয়া গণহত্যা, ডহরপাড়া গণহত্যা, চাঙ্গুরিয়া গণহত্যা, তেরড্রোন গণহত্যা, পূর্ব নারায়ণপুর গণহত্যা, পশ্চিম নারায়ণপুর গণহত্যা, শােলক ভট্টাচার্য বাড়ি গণহত্যা, পশ্চিম সাতলা গণহত্যা, উত্তর সাতলা গণহত্যা, হারতা বাজার গণহত্যা, হস্তিশুণ্ড গণহত্যা, বড়াকোঠা দরগাবাড়ি গণহত্যা, চন্দ্রকান্ত হালদারের বাড়ি গণহত্যা, খাটিয়ালপাড়া গণহত্যা উল্লেখযােগ্য। উজিরপুর সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি উত্তর-পশ্চিম দিকে ঐতিহ্যবাহী ধামুরা বাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৮ই মে ভােররাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় আক্রমণ করে এবং গণহত্যা চালায়। এসময় তারা ধামুরা বাজারের অধিকাংশ দোকানে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে। এ গণহত্যায় বাজারে ঘুমন্ত শতাধিক মানুষ শহীদ হন। তাদের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় জানা গেছে।
গুঠিয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান রয়েছে এ সংবাদের ভিত্তিতে ১৭ই মে বরিশাল থেকে একদল পাকিস্তানি সৈন্য গানবােটে করে উপজেলার গুঠিয়া বাজারের পাশে ডাইমুল্লা মসজিদের সামনে নিত্যানন্দী পাড়ায় গণহত্যা চালায়। ফরাজী বাড়ির হাসেম মাঝি, মন্নান মাঝির বাড়ির ৮ জন এবং আবদুস সত্তার হাওলাদার (বড় মিয়া) বাড়ির কয়েকজনসহ অর্ধশতাধিক মানুষ এ গণহত্যার শিকার হন। এ গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে ১৯ জনের পরিচয় জানা গেছে। সন্ধ্যা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন গুঠিয়া ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ডহরপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী ১৭ই মে তাদের দোসরদের সহায়তায় নৃশংস গণহত্যা চালায়। ঘটনার দিন শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল বরিশাল থেকে গানবােটে গুঠিয়া বাজারে এসে ডহরপাড়া গ্রাম আক্রমণ করে বাড়িঘরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ এবং গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় ১৩ জন মানুষ শহীদ হন।
১৭ই মে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় গুঠিয়া ইউনিয়নের চাঙ্গুরিয়া গ্রামে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত করে। ঘটনার দিন হানাদার বাহিনীর একটি দল গানবােটে গুঠিয়া এসে রাজাকারদের দেখানাে পথে চাঙ্গুরিয়া গ্রামে প্রবেশ করে ফকির বাড়ি, বেপারী বাড়ি, দফাদার বাড়ি ও কারিগর বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে এবং গণহত্যা চালায়। প্রাণভয়ে পলায়নরত গ্রামের ৫ জন মানুষ গণহত্যার শিকার হন।
বরিশাল সদর থেকে ২২ কিমি দূরে সন্ধ্যা নদীর তীরে তেরড্রোন গ্রামে ১৭ই মে পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল থেকে গানবােটে গুঠিয়া বাজারে এসে পায়ে হেঁটে তেরড্রোন গ্রামে প্রবেশ করে হাওলাদার বাড়ি ও দফাদার বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। তারা হাওলাদার বাড়ির উঠানে কর্মরত দুই ভাই আবদুস সােবাহান এবং আবদুল কাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। আতঙ্কে গ্রামের লােকজন পালানাের চেষ্টা করলে হানাদাররা পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। তেরড্রোন গ্রাম গণহত্যায় ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
পাকিস্তানি বাহিনী ১৭ই মে গুঠিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম পূর্ব নারায়ণপুরে গণহত্যা সংঘটিত করে। তারা গানবােটে গুঠিয়া এসে পায়ে হেটে সকাল ১১টায় পূর্ব নারায়ণপুরে প্রবেশ করে গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় অর্ধ শতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন, যার মধ্যে ১৩ জনের পরিচয় জানা যায়।
সন্ধ্যা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন পশ্চিম নারায়ণপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৭ই মে গণহত্যা চালায়। তারা গুঠিয়া বাজার হয়ে পশ্চিম নারায়ণপুরে প্রবেশ করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। সিকদার বাড়ির একই পরিবারের দুই সহােদরসহ ১০ জন এ গণহত্যার শিকার হন।
উপজেলা সদর থেকে ৫ কি মি উত্তরে শােলক গ্রামের ভট্টাচার্য বাড়িতে ১৬ই জুন দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় ৭ জন মানুষ শহীদ হন। শহীদদের লাশগুলাে দিঘিরপাড়ে সমাহিত করা হয়।
উজিরপুর উপজেলার ৩৫ কিমি পশ্চিমে সীমান্ত এলাকায় কচা নদীর তীরের সাতলা গ্রামে ১৬ই জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাতলা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি আক্কেল আলী বালী, সেক্রেটারি আবদুল মজিদ আজাদ, রাজাকার সদস্য লতিফ খলিফা, মাজেদ খলিফা, আবদুল হালিম হাওলাদার, আবদুল হক হাওলাদার, আবদুল মজিদ মাস্টার প্রমুখের সহযােগিতায় গণহত্যা সংঘটিত করে। এ গণহত্যায় ৯ জন মানুষ শহীদ হন। তাদের গণকবরে সমাহিত করা হয়।
উপজেলা সদর থেকে ৩৫ কিমি পশ্চিমে সীমান্ত এলাকা উত্তর সাতলায় হরনাথ বাইন এমপিএ-র বাড়ি এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৬ই জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার লতিফ বালী, রমজান বিশ্বাস, আফসার হাওলাদার প্রমুখের সহায়তায় গণহত্যা সংঘটিত করে। তারা এ-সময় হরনাথ বাইন এমপিএ-র বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে এবং সুনীল ওঝার স্ত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এ গণহত্যায় ৬ জন মানুষ শহীদ হন।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে সন্ধ্যা নদীর তীরে হারতা ইউনিয়ন অবস্থিত। হারতা বাজারে স্থানীয় রাজাকার হালিম মৌলভী, সাদেমন হাওলাদার, কেরামত, হেমায়েত উদ্দিন প্রমুখের আমন্ত্রণে পাকিস্তানি বাহিনী ৫ই সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় গণহত্যা সংঘটিত করে। এ গণহত্যায় ১৫ জন মানুষ শহীদ হন। তাদের মধ্যে ৯ জনের পরিচয় জানা গেছে।
উজিরপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি উত্তরে হস্তিশুণ্ড গ্রামে ২৭শে জুলাই শিকারপুর ক্যাম্পের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকার কমান্ডার গফুর মৃধার সহযােগিতায় গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে। গণেশ ডাক্তারের বাড়ি এবং কর্মকার বাড়ির কয়েকজনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রােগীরা গণহত্যার শিকার হন। এ গণহত্যায় ৬ জন এলাকাবাসী শহীদ হন।
উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিমি পশ্চিমে ৯ম সেক্টরের সাবসেক্টর হেডকোয়ার্টার্স বড়াকোঠা ইউনিয়নের দরগাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৭ই অক্টোবর নৃশংস গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় শতাধিক এলকাবাসী শহীদ হন, যার মধ্যে ৫২ জনের পরিচয় জানা গেছে।
১৭ই অক্টোবর রবিবার বড়াকোঠা ইউনিয়নে মুক্তিযােদ্ধা মিলন কেন্দ্র থেকে উত্তর দিকে চন্দ্রকান্ত হালদারের বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকাররা গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়। এ গণহত্যায় ৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
১৭ই অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনী বড়াকোঠা গ্রাম আক্রমণের পর স্থানীয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী দুপুর ২টায় খাটিয়ালপাড়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে। এ গণহত্যায় গৌরনদীর দুজন ধর্মযাজকসহ মােট ৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
উজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ২০ কিমি দূরে রাজাপুর গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ৪ জন মামলায় হাজিরা দিতে বরিশাল যান। প্রতিপক্ষের ইন্ধনে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল শহরে তাদের হত্যা করে। তারা হলেন- সােনাতন হাজরা, দুই সহােদর সুরেশ ও পরেশ (পিতা সন্তোশ) এবং নবকুমার বৈরাগী (পিতা লাকুব বৈরাগী)। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন তাদের লাশ পাওয়া গেলে ৩ জনকে সদর রােডের খ্রিস্টান করবস্থানে সমাহিত করা হয়।
পাকবাহিনীর উজিরপুর থানা ক্যাম্প ছিল সবচেয়ে বড় নির্যাতনকেন্দ্র। তাছাড়া শিকারপুর এবং দোয়ারিকা ফেরিঘাট সংলগ্ন ক্যাম্প, বামরাইল বাজার ক্যাম্পও ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। এসব ক্যাম্পে তারা নিরপরাধ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করত।
উজিরপুর উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পসমূহ ছিল তাদের বধ্যভূমি। গুঠিয়া গণহত্যায় শহীদ ৭ জনের একটি গণকবর গুঠিয়ায়, খাটিয়ালপাড়া গণহত্যায় শহীদ ৩ জনের গণকবর জগবন্ধুর বাড়ির পেছনে (বর্তমান মালিক শাহজাহান হাওলাদার), বড়াকোঠা গণহত্যায় শহীদ কয়েকজনের গণকবর আমড়াবাড়ির পুকুরপাড়ে, পশ্চিম সাতলা গণহত্যায় শহীদদের গণকবর হালদার বাড়ির পুকুরপাড়ে রয়েছে।
উজিরপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকগুলাে অপারেশন, যুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়। সেগুলাের মধ্যে শিকারপুর ও দোয়ারিকা ফেরিঘাট অপারেশন, বামরাইল যুদ্ধ, জয়শ্রী যুদ্ধ ও উজিরপুর থানা যুদ্ধউল্লেখযােগ্য। সন্ধ্যা নদীর শিকারপুর ফেরিঘাট ও সুগন্ধা নদীর দোয়ারিকা ফেরিঘাট দক্ষিণ অঞ্চলের যােগাযােগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফেরিঘাটে নদীর দুই পাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে রাজাকার, পুলিশ ও পাকিস্তানি সৈন্যরা সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত। মুক্তিযােদ্ধারা যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমান্ডার আবদুল ওয়াদুদ সরদারের নেতৃত্বে নুরু কমান্ডার, রতন শরীফ, আ ন ম আবদুল হাকিমসহ ২০-২৫ জন সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা ২৭শে জুলাই রাতের অন্ধকারে প্রথম সুগন্ধা নদীতীরের দোয়ারিকা ফেরিঘাট সংলগ্ন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাহারারত ১৮ জন পুলিশ ও রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। পরে গুলি করে ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে দোয়ারিকা ফেরি ছিদ্র করে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এরপর তারা শিকারপুর ফেরিঘাট আক্রমণ করেন এবং গুলি করে ফেরি ডুবিয়ে দেন।
১৮ই নভেম্বর জয়শ্রী বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। জয়শ্রী বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে আ ন ম আবদুল হাকিম, মােশারেফ হােসেন খন্দকার, হােসেন আলী ফকির, আবদুল আউয়াল, সাজাহান জমাদ্দার, সেকান্দার, সৈয়দ আবদুল মালেক, তৈয়ব আলীসহ শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা জয়শ্রী বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ করেন। হানাদার বাহিনী পাল্টা গােলা বর্ষণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মান্নান ও কদম আলী হাওলাদার শহীদ হন।
বামরাইল হাইস্কুলের দক্ষিণ পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী, পুলিশ ও রাজাকাররা সতর্ক প্রহরায় থাকত। কমান্ডার আবদুল ওয়াদুদ সরদারের নেতৃত্বে নুরু কমান্ডার, রত্তন আলী শরীফ, আ ন ম আবদুল হাকিমসহ শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা ১০ই নভেম্বর এ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। ১০ই নভেম্বর থেকে ১২ই নভেম্বর পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি চলে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং ২০ জন পুলিশ ও রাজাকার ধরা পড়ে। এ-সময় বেশকিছু অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
উজিরপুর থানা ক্যাম্পে ভারী অস্ত্র ও গােলা-বারুদ মজুদ করে শতাধিক পাকসেনা, পুলিশ ও রাজাকার সশস্ত্র অবস্থায় থাকত। ২রা ডিসেম্বর কমান্ডার আবদুল ওয়াদুদ, আ ন ম আবদুল হাকিম, নুরু কমান্ডারসহ মুক্তিযােদ্ধারা থানা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে ৩ দিন ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। মুক্তিযােদ্ধারা এসময় থানায় পানি সরবরাহের জন্য একটি টিউবওয়েল অকেজো করে দেন এবং ফাইবাে ব্রোরিং দিয়ে ফায়ার করলে থানা ভবনের একাংশ ধ্বংস হয়। ৫ই ডিসেম্বর আতংকিত ৫৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য, ৩৫ জন পুলিশ ও রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকৃত পাকসেনাদের জনগণকে দেখানাের জন্য বিভিন্ন স্থানে লঞ্চে ঘুরিয়ে বরিশাল মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে সােপর্দ করা হয়। উপজেলার মুক্তিযােদ্ধা সিপাহি মজিবুর রহমান, আলতাফ হােসেন প্রমুখ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৫ই ডিসেম্বর উজিরপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- শহীদ সিপাহি মজিবুর রহমান, বীর বিক্রম (পিতা সিরাজ উদ্দিন হাওলাদার কমলাপুর, দাসেরহাট), শহীদ আলতাফ হােসেন, বীর বিক্রম (পিতা আলহাজ্জ আব্দুস সােবহান মােল্লা, ভবানীপুর), হাবিবুর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা আবুল কাশেম হাওলাদার, গাববাড়ি) ও রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা আবদুর রহমান খান, কাংশী, ধামুরা)। উজিরপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- সিপাহি মজিবুর রহমান, বীর বিক্রম (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চান্দুরা যুদ্ধে। শহীদ), আলতাফ হােসেন, বীর বিক্রম (বাবুগঞ্জ থানা যুদ্ধে শহীদ), কাজী মােজাম্মেল হক (পিতা কাজী আব্দুল মজিদ, চাংগুরিয়া, গুঠিয়া), মােজাম্মেল হক (পিতা খবির উদ্দিন সরদার, কাংশী, ধামুরা), কদম আলী হাওলাদার (পিতা মাখন উদ্দিন হাওলাদার, কাজিরা, হস্তিশুণ্ড), মতিউর রহমান মােল্লা (পিতা মৌলভী আব্দুল আজিজ মােল্লা, বৈরকাঠী, ডহরপাড়া), আবদুর রাজ্জাক (পিতা আবদুল ওয়াজেদ সরদার, আটপাড়া), খন্দকার নুরুল হক ওরফে মাকসুদ মিঞা (পিতা খন্দকার খবির উদ্দিন, মশাং), আব্দুস ছামাদ হাওলাদার (পিতা আলহাজ্ব আবুল কাসেম হাওলাদার, ডহরপাড়া), আবদু রশিদ সরদার (পিতা আছমত আলী সরদার, পূর্ব মুণ্ডপাশা, শিকারপুর), মােস্তফা তালুকদার (পিতা আমজেদ আলী, হস্তিশুণ্ড), সিপাহি কাজী মােজাম্মেল হক (পিতা আবদুল মতিন, হালিপাড়া, মুন্সিগঞ্জ), ল্যান্স নায়েক আব্দুল জব্বার শরিফ (মফেজউদ্দিন, পূর্ব ধামসর), সিপাহি আশরাফ আলী (পিতা শাদাত আলী মিয়া, দোহারপাড়), সিপাহি মাে. হানিফ সরদার (পিতা আবদুল গনি সরদার, উত্তর শােলক), মােবারক বেপারী (পিতা আবদুল জব্বার, ধামুরা), আবদুল লতিফ হাওলাদার (পিতা সমশের আলী হাওলাদার, গুঠিয়া) ও মাে. আবদুল করিম (পিতা এলেম উদ্দিন)।
উজিরপুর উপজেলায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের প্রতিকৃতি ও শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের নামাংকিত ফলক, শিকারপুরে মেজর এম এ জলিল সেতু ও সেতুর পাশে মেজর এম এ জলিলের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স বড়াকোঠা প্রাইমারি স্কুলে মুক্তিযােদ্ধাদের মিলনকেন্দ্র গড়ে তােলা হয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড