ঈশ্বরদী উপজেলা
ঈশ্বরদী উপজেলা (পাবনা) বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচি ঘােষণার পরপরই ঈশ্বরদী থানা জুড়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। ছয়দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের হুমকি দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ আরাে কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে। এ মামলার খরচ যােগানাের জন্য তখন ঈশ্বরদী স্টেশন ও প্রতিটি ট্রেনে গণ চাঁদা তােলা এবং মামলার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানাে হয়। এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু (স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ নেতা), হারুন-অররশিদ সহ ছাত্রনেতৃবৃন্দ। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ সকল অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ঘটে। আইয়ুবের পতনের পর নতুন সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সারদেশে নতুন করে সামরিক শাসন জারি করেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে কমপক্ষে দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং এর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ঔদাসীন্য পূর্ব বাংলার মানুষকে আরাে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া থানা নিয়ে গঠিত পাবনা-১১ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এডভােকেট আমিন উদ্দিন বিপুল ভােটে বিজয়ী হন।
আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় আতিঙ্কত হয়ে পড়ে শাসক গােষ্ঠী। তারা জনগণের রায় বানচাল করে ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে প্রণীত হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞের মহা পরিকল্পনা। এদিকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। ইয়াহিয়া খান ৬ই মার্চের এক ঘােষণায় ২৫শে মার্চ নতুন করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। উদ্দেশ্য কালক্ষেপণ ও পূর্ব বাংলায় হত্যাযজ্ঞ শুরুর পরিকল্পনা গ্রহণ। ১৫ই মার্চ সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার প্রহসন শুরু করেন। অন্যদিকে গােপনে ক্যান্টনমেন্টে চলে গণহত্যার প্রস্তুতি। ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন, আর এদিনই মাঝরাতে পাকবাহিনী শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। এ রাতেই বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঈশ্বরদী শহর ও পাকশীতে দুটি সংগ্রাম কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের সূচনা হয়। ঈশ্বরদী স্টেশন রােডের রহমান বুক হাউজ নামে একটি বইএর দোকানের ওপর তলায় সমমনা সকল দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ইসাহাক আলীকে আহ্বায়ক করে অর্ধশতাধিক সদস্যের সমন্বয়ে ঈশ্বরদী সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা হলেন- ফকির মাে. নুরুল ইসলাম, তােজাম আলী মিয়া, আব্দুল আজিজ, মাহবুব আহমেদ খান, ডা. আব্দুর রশিদ, মােশারফ হােসেন চৌধুরী, আমজাদ হােসেন মন্ডল, নায়েব আলী বিশ্বাস, মাহমুদুর রহমান, আব্দুল হালিম চৌধুরী, কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল, মজিবর রহমান (ভবঘুরে), হাবিবুর রহমান (চাষীভাই), আকমল হােসেন, লুৎফর রহমান, আব্দুস ছাত্তার, রবিউল আলম মাস্টার, শামসুদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম মন্টু প্রমুখ। পাকশী জনপদ ছিল সে-সময় রাজনৈতিক সচেতনতার দিক দিয়ে অনেকটা এগিয়ে। সেকারণে পাকশীতেও একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাকশী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন- ডা. আব্দুর রশিদ, আব্দুল আজিজ, চাঁদ আলী মন্ডল, ইসমাইল হােসেন, আব্দুল গফুর, রেজাউল আলম, তােফাজ্জল হােসেন, আকমল হােসেন, শামসুর রহমান শরীফ ডিলু (বর্তমান ভূমিমন্ত্রী) এবং ইউসুফ আলী চেয়ারম্যান (মুসলিম লীগ-এর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তিনি প্রস্তুতি পর্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রাখেন)।
সংগ্রাম কমিটির মূল লক্ষ্য ছিল আসন্ন মুক্তি সংগ্রামের জন্য স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে একটি স্বশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলা, স্বশস্ত্র বাহিনীর রসদ সরবরাহ করা, ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সংগ্রামরত মানুষের মনােবল অটুট রাখা, স্থানীয়ভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং রাস্তায়-রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা। প্রতিরােধ যুদ্ধের খবরাখবর ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যােগাযােগ এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঈশ্বরদী সংগ্রাম কমিটির অধীনে তিনটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয় – প্রথমে সাঁড়া মাড়ােয়াড়ি হাইস্কুল এবং পরবর্তীকালে ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন, আব্দুল মজিদের সিগারেট কোম্পানির স্টেশন রােডস্থ অফিস ও দুলি বাবুর ডাল মিলের গদি ঘরে। কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন হারুন-অর-রশিদ (স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে পাবনা জেলা গােয়েন্দা বিভাগ প্রধান) ও জহুরুল ইসলাম টিপু।
১০ই মার্চ বিকেলে হঠাৎ রেডিওতে শােনা যায়, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঈশ্বরদী থেকে বলছি …। দেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা আজ জেগে উঠেছে। মহান নেতা বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছেন; এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এরপরই বেজে ওঠে কারার ঐ লৌহ কপাট…।’ ঘােষণাটি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও পাঠ করা হয়। এভাবেই শুরু হয় ঈশ্বরদী বেতার কেন্দ্রের প্রথম প্রােগ্রাম। এ বেতার যন্ত্রটি নিপুণভাবে তৈরি ও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন তরুণ বেতারযন্ত্র প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ও তার সহযােগী আব্দুর রাজ্জাক গ্যাদোন। প্রায় দশ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে সম্প্রচারের ক্ষমতা ছিল এ যন্ত্রটির। যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে ঈশ্বরদীর পশ্চিমটেংরিতে গ্যাদোনের বাড়িতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ঈশ্বরদীর রাজনৈতিক অঙ্গনে মূলত চারটি ধারা লক্ষ করা যায়- আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ধারা; ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন ধারা; ন্যাপ (ভাসানী), নকশালপন্থী (পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ধারা এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ ধারা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন মহিউদ্দীন আহমেদ, ফকির নুরুল ইসলাম, শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, মাহবুব আহমদ খান, ইসমাইল হােসেন, ডাক্তার আব্দুর রশিদ প্রমুখ। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব আলী বিশ্বাস, আজমল হক, নুরুজ্জামান বিশ্বাস, সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ, কাজি সদরুল হক প্রমুখ। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন জসিম উদ্দীন মন্ডল, আব্দুল হালিম চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান, রেজাউল আলম মিন্টু, রবিউল আলম মাস্টার, ওহিদুল হক, লুৎফর রহমান, জয়েন উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুজ্জামান সেলিম, কামাল আহমেদ, শামিম আহমেদ, হাসিম সরওয়ার প্রমুখ। ন্যাপ (ভাসানী) ও নকশালপন্থী (পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি)-র নেতৃত্বে ছিলেন আলাউদ্দিন আহমেদ, আবুল কাসেম বিশ্বাস, মােশারফ হােসেন, আহাদ আলী, বারী সরদার প্রমুখ। শেষের এ ধারাটি প্রস্তুতিপর্বের প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নিলেও পরবর্তীকালে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে অবস্থাপন্ন কৃষক ও উঠতি ব্যবসায়ীদের হত্যা করতে শুরু করে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে। এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল মুসলিম লীগ সমর্থক ও অবাঙালিদের একটি বড় অংশ। তারা সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
ঈশ্বরদীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় দুবার ১৭ই মার্চ ও ২৩শে মার্চ। ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে ১৭ই মার্চ সকাল দশটায় এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তােজাম আলী মিয়া। এ সভা থেকে ছাত্রনেতা চুন্ন রেলওয়ে বুকিং অফিসের ছাদে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৩শে মার্চ ঈশ্বরদী বাসস্ট্যান্ডে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন। থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নায়েব আলী বিশ্বাস ও জহুরুল আলম। একই দিন পাকশীতে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নায়েব আলী বিশ্বাস পতাকা উত্তোলন করেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত জয়বাংলা বাহিনীর সদস্যরা কুচকাওয়াজ করে পতাকাকে অভিবাদন জানায়। এ-সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আব্দুর রব নিজের ডবল ব্যারেল বন্দুক এনে তােপধ্বনি করেন।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিক্রিয়া হয় সমগ্র বাংলাদেশে। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধের সেই সংগ্রামে ঈশ্বরদীর জনগণও পিছিয়ে থাকেনি। তারা রাস্তায়-রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানের চাঁদতারাখচিত পতাকা নামিয়ে তার পরিবর্তে তােলা হয় লালবৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। ঈশ্বরদীর জনগণ সেদিন যার কাছে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে শুরু করে যুদ্ধের মহড়া।
ঈশ্বরদী সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সশস্ত্র ট্রেনিং ক্যাম্প খােলার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এসময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মাইকে প্রচার করা হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন সকল আগ্নেয়াস্ত্র ছাত্র ও যুব কর্মীদের দিয়ে দেয়ার জন্য। মতিয়ার রহমান কচি, আমিনুর রহমান দাদু, আজমল হক বিশ্বাস, গােলাম মােস্তফা বাচ্চু প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতা খ্রিস্টান মিশনারি থেকে সংগ্রহ করা জিপে চড়ে বাড়ি-বাড়ি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। অপরপক্ষে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা রেলওয়ে পে-অফিস থেকে ১০টি রাইফেল সংগ্রহ করেন। এরপর শুরু হয় সশস্ত্র ট্রেনিং। প্রথমে সুগার কেইন রিসার্স ইনস্টিটিউটের পুরনাে খামার বাড়ির চত্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগীকারী মেজর নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে গেরিলা ইউনিটের ট্রেনিং শুরু হয়। সপ্তাহ খানেক চলার পর ক্যাম্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু করেন প্রথমে পশ্চিম টেংরি দিশারি সংঘে এবং পরে পশ্চিম টেংরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে প্রশিক্ষণ দিতেন নবাব আলী ও ব্যাংকের গার্ড নরুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে পাকশী বেশ এগিয়ে ছিল। এটি একটি ইউনিয়ন এবং প্রধানত রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার্স কেন্দ্রিক শহর হলেও এখানকার মানুষ রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন ছিল। মার্চের অসহযােগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এখানকার সংগ্রাম পরিষদ প্রথম থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল যে, জাতির সামনে কঠিন দিন ঘনিয়ে আসছে। তাই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই যুবকদের সংগঠিত করে একটি প্রতিরােধ বাহিনী গঠন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ-সময় পাকশীতে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন দুটি পৃথক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শরীর চর্চা প্রশিক্ষণ শুরু করে। ছাত্রলীগ নেতা কাজি সদরুল হক সুধা, সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু প্রমুখের নেতৃত্বে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। এদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ােগ করা হয় আব্দুল বারী সরদারকে। প্রশিক্ষণ দেয়া হয় পাকশী রেলওয়ে ফুটবল মাঠে। পাকশীর বামপন্থী নেতা রেজাউল আলম মিন্টুর নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তাদের প্রশিক্ষণ দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক জয়েন উদ্দীন আহমেদ ও স্কাউট লিডার ওহিদুল ইসলাম। চন্দ্র প্রভা বিদ্যাপীঠ হাইস্কুল মাঠে এ প্রশিক্ষণ হতাে। সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর প্রশিক্ষণ তৎপরতা আরাে বৃদ্ধি পায়। পাকশী ফেরিঘাট ও রেল লাইনে ব্যারিকেড দেয়া হয় এবং রেল কলােনি জুড়ে অসংখ্য পরিখা খনন করা হয়। নেতৃবৃন্দ পাকশীর বিভিন্ন বাসা থেকে কিছু বন্দুক ও টু-টু বাের রাইফেল সংগ্রহ করেন। প্রশিক্ষিত যুবকরা বিভিন্ন রাস্তার মােড়ে পালাক্রমে পাহার দেয়া শুরু করে। এ-সময় ওহিদুল হক নামে পাকশী কাগজ কলের একজন মেকানিক কিছু পাইপগান ও ডিনামাইট তৈরি করে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের হাতে তুলে দেন। ডিনামাইটের বারুদ সংগ্রহ করা হয় ডিসি স্টোরে সংরক্ষিত ফগ সিগনাল থেকে। ছাত্রলীগের এক সাহসী কর্মী মাহবুব বােমা তৈরি করতে গিয়ে আহত হন। বােমা বিস্ফোরণে তার দুটি হাতই কজি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ-সময় বেনজির আহমেদ নামে কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতা (পরবর্তীতে একতা ও ভােরের কাগজ-এর সম্পাদক) রানার নামে একটি পত্রিকায় ককটেল তৈরির ফরমুলা ছাপেন। পাকশীর ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা এ পদ্ধতিতে অসংখ্য ককটেল তৈরি করে। ১লা মার্চ ঈশ্বরদী নতুন হাট নামক স্থানের এটোমিক এনার্জি কলােনির মধ্যে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন ছাত্রলীগের মজিবর রহমান বাচ্চু। আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম হােসেন, আতিয়ার রহমান, আব্দুল আজিজ প্রমুখের পৃষ্ঠপােষকতায় এ ক্যাম্প পরিচালিত হতাে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য মােজাহার আলীর স’ মিলের ম্যানেজার জাবেদ আলী কাঠ কারখানার পলান মিস্ত্রিকে দিয়ে ২৫টি ডামি রাইফেল বানিয়ে দিয়েছিলেন। এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতেন ওহিদ, নায়েব, রাজ্জাক, নবাবসহ আরাে অনেক যুবক।
ঈশ্বরদী থানার প্রায় সাড়ে ৭শ তরুণ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে একমাত্র রূপপুর গ্রাম থেকেই ছিল প্রায় ২শ জন। এ থানার ৩৩ জন মুক্তিযােদ্ধার প্রথম দলটি ২৯শে জুন নদীপথে সাঁড়াঘাট হয়ে কামালপুর গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রহিম টিনু, গােলাম রব্বানী ও ফজলুল হক বুদু। মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনের খবর পেয়ে স্থানীয় জনগণের মনে আশার সঞ্চার হয়। জুলাই মাসে পুরাে এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা ঈশ্বরদী থানার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেন। এ কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন কাজি সদরুল হক সুধা। উপজেলার কমান্ডাররা হলেন: ১ম কোম্পানি- কাজি সদরুল হক সুধা (কোম্পানি কমান্ডার), খায়রুজ্জামান বাবু (ডেপুটি কোম্পানি কমান্ডার), মতিয়ার রহমান কচি (প্লাটুন কমান্ডার), ফজলুল হক বুদু (প্লাটুন কমান্ডার), আনােয়ার হােসেন জন (প্লাটুন কমান্ডার); ২নং কোম্পানি- সিরাজুল ইসলাম মন্টু (কোম্পানি কমান্ডার), আব্দুস সামাদ সরদার (ডেপুটি কোম্পানি কমান্ডার), ওহিদুজ্জামান বিশ্বাস (প্লাটুন কমান্ডার), আব্দুর রাজ্জাক (প্লাটুন কমান্ডার), মহিউল ইসলাম মন্টু (প্লাটুন কমান্ডার), হাশিম সরােয়ার (প্লাটুন কমান্ডার); ৩নং কোম্পানি- আব্দুর রহিম মালিথা (কোম্পানি কমান্ডার), মােহম্মদ আলী রানা (ডেপুটি কোম্পানি কমান্ডার), মহিউদ্দিন আহমেদ (প্লাটুন কমান্ডার), আব্দুল মান্নান (প্লাটুন কমান্ডার); মুজিব বাহিনীনুরুজ্জামান বিশ্বাস (আঞ্চলিক প্রধান), আনিসুর রহমান (সহ-আঞ্চলিক প্রধান) এবং ঈশ্বরদী থানা কমান্ডার হারুনঅর-রশিদ (প্রধান গােয়েন্দা বিভাগ, পাবনা জেলা)। এছাড়া ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্লাটুন কাজি সদরুল হকের কোম্পানিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ প্লাটুনের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মােক্তার হােসেন ভান্টু।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালাে রাতে ঢাকার মতাে পাবনার জনগণও পাকসেনাদের পাশবিকতার শিকার হয়েছিল। সে রাতে মুক্তিকামী বাঙালিকে দমন করার জন্য পাবনা শহরেও রাতের অন্ধকারে প্রায় দেড় শত পাকসেনার একটি দল প্রবেশ করে এবং তঙ্কালীন ইপসিক শিল্প নগরীতে ঘাঁটি স্থাপন করে। ঘাঁটি স্থাপনের পরপরই তারা পাবনা পুলিশ লাইন দখল এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পণ করানাের চেষ্টা করে। ২৮শে মার্চ রােববার এ উদ্দেশ্যে তারা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। এ নিয়ে পুলিশ লাইনে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। প্রতিরােধ বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটে তাড়াশ বিল্ডিংএর পেছনে অবস্থিত টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থান নেয়। কিন্তু প্রতিরােধ বাহিনী দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে সেখানকার অধিকাংশ পাকসেনা নিহত হয়। পাবনার সশস্ত্র গণপ্রতিরােধ এবং পাকবাহিনীর চরম বিপর্যয়ের এ খবর রাজশাহীতে অবস্থানরত ২৫ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফকাত এবং ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার মেজর আসলামের কাছে অয়ারলেসের মাধ্যমে পৌঁছে যায়। খবর পেয়ে রাজশাহী থেকে মেজর আসলামকে পাঠানাে হয় পাবনার ইপসিকে অবশিষ্ট পাকসনাদের উদ্ধারের জন্য। তার জিপ গাড়িতে একটি রিকয়েললেস রাইফেল, একটি মেশিন গান ও ১৮ জন সশস্ত্র সৈন্য ছিল। রিকয়েললেস রাইফেলের অনবরত গুলিতে ইপসিক ঘিরে রাখা জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে মেজর আসলামের নেতৃত্বে ইপসিকে অবশিষ্ট সৈন্যরা রাজশাহীর দিকে যাত্রা শুরু করে। জনতার প্রতিরােধের ভয়ে তারা প্রধান সড়ক দিয়ে না গিয়ে গ্রামের দুর্গম কাঁচা রাস্তা ব্যবহার করে। অল্পক্ষণের মধ্যেই খবর পৌছে যায় পাকশীর সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের কাছে। ২৯শে মার্চ সকাল ৯টার দিকে তারা সমাবেশ ডাকেন পাকশী রেলওয়ে ফুটবল মাঠে। জনতা যার কাছে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে হাজির হয়। সমাবেশে সিদ্ধান্ত হয় চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী ও শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর নেতৃত্বে সাহসী যুবকদের একটি শক্তিশালী প্রতিরােধ বাহিনী পথিমধ্যে মাধপুর নামক স্থানে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধ করবে। সকাল ১০টার দিকে সবাই রওনা হয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধকারীরা পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করে। প্রথমেই প্রতিরােধ করে মাধপুরে, যা মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এখানে ১৭ জন প্রতিরােধযােদ্ধা শহীদ ও ৩ জন গুরুতর আহত হন। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
মাধপুর থেকে পাকসেনারা দাশুড়িয়ায় পৌছালে সেখানেও প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য সিরাজুল ইসলাম মন্টু ও ঈশ্বরদী সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নেতৃত্বে প্রতিরােধ বাহিনীর সদস্যরা সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। তারা নব উদ্যমে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের তীব্রতায় টিকতে না পেরে দুটি অত্যাধুনিক আয়ারলেস সেট ফেলে অবিরাম গুলি চালাতে-চালাতে পাকবাহিনী মুলাডুলির দিকে অগ্রসর হয়। এখানে হানাদারদের বেশ কয়েকজন নিহত হয়।
পাকবাহিনী মুলাডুলিতে পৌছলে জনতার প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়, যা “মুলাডুলি প্রতিরােধ যুদ্ধ” নামে অভিহিত। এ-সময় একটি ফাইটার প্লেন পাকসেনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তা থেকে অবিরাম মেশিন গানের গুলি বর্ষণ করা হলে জনতা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এখানে বিমান থেকে বর্ষিত শেলের আঘাতে রূপপুর গ্রামের মহিউদ্দীন তাঁর দুটি পা হারান। এছাড়াও পাকসেনাসহ প্রতিরােধযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষজনের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়।
পাকবাহিনী এরপর গােপালপুরের দিকে অগ্রসর হলে জনতা পেছন-পেছন ধাওয়া করে সেখানে গিয়ে পৌছায়। পাকসেনারা সেখানে একটি বাড়ির ৬ জন সদস্যকেই নির্মমভাবে হত্যা করে সে বাড়িতে শেল্টার নেয়। এ-সময় দলছুট একজন পাকসেনাকে রেললাইনের একটি সাঁকোর নিচ থেকে বন্দি করে মুলাডুলি বাজারে এনে বট গাছের ডালে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাকবাহিনীর এ দলটির প্রধান মেজর আসলামসহ ৭ জন পাকসেনা ক্রুদ্ধ প্রতিরােধযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। এটি ময়না গ্রাম প্রতিরােধ যুদ্ধ নামে খ্যাত। প্রতিরােধকারীদের ওপর পাকিস্তানি বিমান থেকে এয়াররেইড করে ৪০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়।
২৯শে মার্চ রাতে ঈশ্বরদীর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কামাল আহমেদ ও শামসুজ্জামান সেলিম খবর পান যে, ঢাকার উদ্দেশে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরদী বিমান বন্দরে ১৩ জনের একটি সেনা ইউনিট অবস্থান করছে। পরদিন কামাল এবং সেলিম অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে রওনা হন তাদের সঙ্গে কথা বলতে। এ ইউনিটে কয়েকজন বাঙালি সৈন্য ছিলেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা যায় যে, তাদের পাঠানাে হয়েছিল অসহযােগ আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাহারা দেয়ার জন্য। অবস্থা অশান্ত হওয়ায় সেখান থেকে সরে এসে তারা বিমান বন্দরে আশ্রয় নিয়েছে। সদর দপ্তরের সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন তাদের কাছে একটি মাত্র এসএমজি ও কয়েকটি চাইনিজ রাইফেল আছে। তারা জানায় যে, তাদের প্রাণ রক্ষার নিশ্চয়তা দিলে তারা পাল্টা কোনাে ব্যবস্থা নেবে না। খবরটি যথাসময়ে থানা সংগ্রাম পরিষদের কাছে পৌছলে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ১লা এপ্রিল তাদের আত্মসমর্পণের দিন ধার্য করেন। মাইকযােগে তারিখটি জনসাধারণকে জানিয়ে দেয়া হয়। নির্ধারিত দিন দুপুর থেকে প্রায় ৮-১০ হাজার লােক বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিমান বন্দর ঘেরাও করে। বিকেল ৪টার দিকে সেনা সদস্যরা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও মাথায় সাদা টুপি পরে আত্মসমর্পণ করে। এ ইউনিটের একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন ও তিনজন বাঙালি সেনাকে প্রথমে থানা হাজতে রাখা হয়। কিন্তু শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে অবাঙালি বন্দিদের কোথায় রাখা হবে সে ব্যাপারে সংগ্রাম পরিষদ সদস্যদের মধ্যে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে গভীর রাতে তাদের পাকশী ফেরিঘাটে এনে হত্যা করা হয়।
পাকশী কাগজ কলের মেকানিক ওহিদুল হক যে ডিনামাইটগুলাে তৈরি করেছিলেন, সেগুলাে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের হাতে তুলে দেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঈশ্বরদী বিমান বন্দরের রানওয়ে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করলে ওহিদুলের নেতৃত্বে আজিজুর রহমান টুকু, রবিউল, জিয়াউল আহসান টুকু, নজরুল ইসলাম প্রমুখের একটি গ্রুপ পাকশী কাগজ কল থেকে একটি ট্রাক নিয়ে ডিনামাইটসহ ঈশ্বরদী যাত্রা করে। ড্রিল মেশিন দিয়ে রানওয়েতে গর্ত করে সেখানে ডিনামাইট স্থাপন করে চার্জ করা হয়। কিন্তু তাতে কংক্রিটের তৈরি অত্যন্ত মজবুত রানওয়ের কোনাে ক্ষতিই হলাে না, বিশাল একটি গর্তের সৃষ্টি হলাে মাত্র। আবার ডিনামাইট স্থাপনের চেষ্টা চলে। ঠিক এ-সময় একটি টহল ফাইটার প্লেন উড়ে আসে। রানওয়ের ওপর লােকজন দেখতে পেয়ে প্লেনটি থেকে মেশিন গানের গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তখন প্রতিরােধ বাহিনীর সদস্যরা বিমান বন্দরের একটি ঘরে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং পরে পাকশীতে ফিরে যায়।
১১ই এপ্রিল বিকেল বেলা পাকসেনারা দুপাশের গ্রাম জ্বালাতে-জ্বালাতে আই কে রােড ধরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছাকাছি পৌছলে সেখানে অবস্থানরত ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। প্রচণ্ড আক্রমণ ও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় তারা পিছু হটে। ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পূর্ব প্রান্তের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পশ্চিম প্রান্তে শক্ত অবস্থান তৈরি করে। তাদের সুদৃঢ় প্রতিরােধের মুখে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত পাকসেনারা নদী পার হতে পারেনি। এ-সময় আশপাশের গ্রামের মানুষ প্রতিরােধ বাহিনীর খাদ্যের যােগান দিয়েছিল।
১০ই এপ্রিল নগরবাড়ি ফেরি ঘাটের দখল নেয়ার পর ঢাকা থেকে ভারি অস্ত্র ও কামানসহ প্রচুর পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে জমায়েত হয়। পরদিন সকালেই তারা পাবনা শহর আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর জ্বালাতে-জ্বালাতে বিকেল ৪ টার দিকে পাবনা শহরের দখল নেয়। ঈশ্বরদী থানা পাবনা সদরের নিকটবর্তী হওয়ায় ঐদিনই খবর আসে যে, পাকসেনারা ঈশ্বরদীর নিকটবর্তী দাশুড়িয়ায় এসে গেছে। পাকশী থেকে কয়েক মাইল পূর্বে দাশুড়িয়া ও আলহাজ্ব মােড়ে তখন আগুন জ্বলছিল। এলএমজি ও মর্টারের গােলাগুলির অবিরাম শব্দ ভেসে আসছিল। পাকসেনারা আলহাজ্ব টেক্সটাইল মােড় থেকে আই কে রােড ধরে পাকশীর দিকে অগ্রসর হয়। এসময় তারা আই কে রােডের দুপাশের গ্রামগুলাের বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ করতে-করতে পাকশীর দিকে এগিয়ে যায়। এদিনই ট্রাকে করে মুসলিম হাইস্কুলে নিহত অবাঙালিদের লাশ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের তলায় নদীতে ফেলা হচ্ছিল। প্রায় দুই ট্রাক লাশ ফেলার পরই পাকসেনাদের মর্টার থেকে নিক্ষিপ্ত একটি শেল হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পশ্চিম পাশের বৈদ্যুতিক টাওয়ারে এসে আঘাত হানে। ততক্ষণে পাকবাহিনী পাকশী থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে নতুন হাটে এসে গেছে। নতুন হাট ও দিয়াড় বাঘইলেও তখন আগুন জ্বলছিল। ভীত-সন্ত্রস্ত জনতা দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে। অনেকেই নদী পেরিয়ে কুষ্টিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলােতে আশ্রয় নেয়। এ-সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে অবস্থানরত ইপিআর ও পুলিশের দলটি পাকসেনাদের গােলাগুলির পাল্টা জবাব দিতে থাকে। সন্ধ্যে পর্যন্ত প্রচণ্ড গােলাগুলি চলে। পুলিশ ও ইপিআর-এর লােকজন ব্রিজের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেন। পাকসেনারা সেদিন পাকশী পর্যন্ত এসেই থেমে যায়। পরদিন ১১ই এপ্রিল সকাল দশটার মধ্যে অবাঙালিদের সহায়তায় তারা ঈশ্বরদী শহরের দখল নেয়। পাকবাহিনীর আগমনে ঈশ্বরদী লােকোসেড এলাকায় অবস্থানরত প্রায় পনেরাে হাজার অবাঙালি উল্লসিত হয়ে ওঠে এবং ঈশ্বরদী শহরের আনাচে-কানাচে পাকসেনাদের নিয়ে শহরের দখল পাকাপােক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এরপর পাকসেনারা ঈশ্বরদী ডাকবাংলাে ও পাকশী পেপার মিলের অফিসার্স মেসে দুটি ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীকালে সুগার কেইন রিসার্স ইনস্টিটিউট, এয়ার পাের্ট ও এগ্রিকালচার ফার্মেও ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও জয়নগর ওয়াপদা অফিসেও পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। এপ্রিল মাসের শেষদিকে ঈশ্বরদীতে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হলে ঈশ্বরদী ও দাশুড়িয়ায় দুটি রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈশ্বরদীর রাজাকার ক্যাম্পটি ছিল স্টেশন রােডের জামে মসজিদের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর অফিসে এবং দাশুড়িয়ার ক্যাম্প ছিল শঙ্কর সাহা নামে একজন ব্যবসায়ীর আড়ত ঘরে। এ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল আটঘরিয়ার ক্বারি ইউনুছ।
দেশের অন্যান্য জেলার মতাে পাবনা জেলায়ও শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের তৎপরতাই ছিল বেশি। এখানকার ব্যাপক সংখ্যক অবাঙালিরা শান্তি কমিটি, বিশেষ করে রাজাকার বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঈশ্বরদী থানা সদরে রাজাকারদের অধিকাংশ ছিল অবাঙালি। তবে পাকশীতে হানাদাররা কোনাে শান্তি কমিটি করতে পারেনি। এ ইউনিয়নে হাতেগােনা কয়েকজন রাজাকারের নাম পাওয়া যায়। মুলাডুলি ও দাশুড়িয়া ইউনিয়নের জামায়াত ও মুসলিম লীগ সদস্যরা শান্তি কমিটি গঠনে ভূমিকা পালন করে। দাশুড়িয়া ইউনিয়নের জামায়াত নেতা ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মওলানা আতাউর রহমানের প্রভাবে এখানে জামায়াতের তৎপরতা ছিল বেশি।
ঈশ্বরদী থানায় শান্তি কমিটি গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে জামায়াত নেতা মওলানা খােদা বক্স খাঁ ওরফে খুদু খাঁ। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী ঈশ্বরদীতে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়ার পরই তার সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে। এরপর খােদা বক্স খাঁকে চেয়ারম্যান করে সাহাপুর ইউনিয়নের জামায়াত নেতা নাসির মওলানা ও ইসমাইল মওলানা, মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতা নেসার আহমেদ খান, ঈশ্বরদী জিন্না কলেজের অবাঙালি প্রভাষক নাসিম খান, দাশুড়িয়া জামায়াত নেতা শাহজাহান ভেন্ডার, মানিকনগরের জামায়াত নেতা আব্দুস সামাদ মহলদার, সাহাপুরের আব্দুল হামিদ ওরফে হারেজ উদ্দিন – এদের সমন্বয়ে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ-সময় থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনে মুসলিম লীগ নেতা আবুল মনসুর খান, আব্দুল্লা আল মামুন খান, মুলাডুলির জামায়াত নেতা মওলানা আব্দুল ওহাব, ইসাহাক চেয়ারম্যান, আমিনুল হক খান, মশুরিয়া পাড়ার মওলানা কসিম উদ্দীন প্রমুখ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শান্তি কমিটি গঠনের পর রাজাকার বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মওলানা আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত দাশুড়িয়া শান্তি কমিটির উদ্যোগে শঙ্কর শাহার আড়ত ঘরে রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল রাজাকার ময়েজ উদ্দীন, শাহজাহান ভেন্ডার প্রমুখ। এ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল আটঘরিয়ার ক্বারি ইউনুছ।
মুলাডুলি ইউনিয়নেও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর কমান্ডার ছিল মওলানা আব্দুল হাই (এরশাদ আমলে পাকশী কাগজকল হাইস্কুলের ধর্ম শিক্ষক)। মুলাডুলি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল জামায়াতের ইসাহাক আলী খান। এখানে রাজাকার সদস্য ছিল ইউসুফ আলী, ইউনুছ আলী প্রমুখ। সাহাপুর ও সলিমপুর ইউনিয়নে শান্তি কমিটির সদস্য ছিল মওলানা নাসির উদ্দীন, মওলানা ইসমাইল (মুক্তিযুদ্ধকালে লুটপাট ও গণহত্যার অভিযােগে মুক্তিযােদ্ধারা তার কান কেটে দিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পরে জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর সময় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের শিক্ষক হয়) প্রমুখ। সাহাপুর গ্রামের মাে. হাসেম আলী রাজাকার সদস্য ছিল। তার সহায়তায় ২৮শে জুলাই মুক্তিযােদ্ধাদের অন্যতম আশ্রয়দাতা মােজাম্মেল হকের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদাররা। রূপপুর গ্রামের রাজাকার সদস্য ছিল আবুল হাসেম ও হায়দার আলী হায়দার পরে অস্ত্রশস্ত্রসহ পালিয়ে এসে মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। ঈশ্বরদী থানার অধিকাংশ রাজাকার ছিল অবাঙালি এবং মুসলিম লীগের অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা সদর থানা ও ঈশ্বরদী থানার সাহাপুর গ্রাম ছিল নকশালপন্থীদের শক্তিশালী ঘাঁটি। নকশাল নেতা আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে সাহাপুর, তিলকপুর, লক্ষীকুন্ডা, সলিমপুর প্রভৃতি গ্রামে এবং টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে পাবনা সদর থানার বেশ কিছু অঞ্চলে এ-সময় নকশালপন্থীদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এই দুই বিশিষ্ট নেতা পরিচালিত দলের আদর্শে উদ্বুব্ধ নকশালরা মুক্তিযুদ্ধকে আগাগােড়াই সমর্থন করেনি। এছাড়া এলাকার শক্তিশালী সংগঠন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তাদের রাজনৈতিক বিরােধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে তারা তৎপর হয়ে ওঠে সুযােগের সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে। যদিও তারা সরাসরি পাকহানাদারদের দোসর হিসেবে মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়নি, তবু তাদের জোতদার খতমের নামে নির্বিবাদে মানুষ হত্যা, ঘরে-ঘরে লুটপাট চালানাের অপতৎপরতা পরােক্ষভাবে পাকসেনাদের সহায়তা করেছিল। একেতাে পাক হানাদার ও অবাঙালিদের অত্যাচার, তার ওপর নকশালীদের অত্যাচার গােদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতাে দেখা দিয়েছিল। ৯ই মে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও সংগ্রাম পরিষদের অন্যমত নেতা আব্দুল আজিজ এদের হাতে প্রাণ হারান। আবার শ্রেণিশত্রু খতমের নামে তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক রফিককে হত্যা করে। নকশালরা যে নিছক জোতদার খতমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এসব হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালিয়েছিল তা নয়, এর মূলে ব্যক্তিগত বিদ্বেষও ছিল। দেশের এই অরাজক মুহূর্তে প্রশাসন যখন প্রায় বিকল, তখন নকশালরা তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে এসব লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। নকশালপন্থীদের এজাতীয় হীন কর্মকাণ্ড সমবেতভাবে প্রতিহত করার ক্ষমতা তখন জনসাধারণের ছিল না। কারণ নকশালদের হাতে সে-সময় প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র এবং যথেষ্ট সংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের অন্যান্য স্থানে প্রধানত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােকেরা গণহত্যার টার্গেট হয়। কিন্তু ঈশ্বরদীতে ছিল এর ব্যতিক্রম ঘটনা। এখানে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লােকেরা গণহত্যার শিকার হয়েছে। ১২ই এপ্রিল পাকবাহিনী ঈশ্বরদী ও পাকশীতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও পাশবিক অত্যাচার চালায়। এদিন ঈশ্বরদী থানা শহর সকাল দশটার মধ্যেই পুরােপুরি শত্রু কবলিত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর আগমনে ঈশ্বরদী শহরে অবস্থানরত অবাঙালিরা দলে-দলে মিছিল সহকারে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ও বাজারে ব্যাপক লুটপাট চালায়। জামায়াতে ইসলামীর নেতা খােদা বক্স খান (বাঙালি) ও মুসলিম লীগের নেতা ও ঈশ্বরদী কলেজের অধ্যাপক নাসিম খান (বিহারি) লুটপাটের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রধান জনপদগুলাের ওপর দখল পাকাপােক্ত করার পর হানাদাররা আশপাশের গ্রামগুলােতেও হামলা চালাতে শুরু করে। একাজে তাদের সহায়তা দেয় অবাঙালিরা। ১২ই এপ্রিল তারা পাকশী রেল কলােনিতে প্রবেশ করে বহু অবাঙালির লাশ দেখতে পায়। এতে তাদের বর্বরতা চরমে পৌঁছে। তারা সামনে যাদেরই পেয়েছে। তাদেরই নৃশংসভাবে হত্যা করে। এভাবেই রেল কর্মচারী ইয়াকুবকে বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী তিনদিন ধরে রান্নাঘরে লুকিয়ে থেকে স্বামীর লাশ আগলে ছিলেন। রেল কর্মচারী লতিফ ও তার দুই ভাইকে একসঙ্গে গুলি করা হয়। ১৩ই এপ্রিল পাকশী হাসপাতালের আর এস রফিক আহমেদের বাসায় ঢুকে পাকিস্তানি দস্যুরা একে-একে তাঁর তিন পুত্র জিয়াউদ্দীন, সাইফুদ্দিন, রইচউদ্দীন ও রেল কর্মচারী মমিনুল হককে হত্যা করে। গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল যুক্তিতলার ব্যবসায়ী জয়েন উদ্দিনসহ বেশ কিছু লােককে। তাদের লাশ দাফন করার মতাে লােকও সেদিন পাকশী কলােনিতে ছিল না। পাকশী সুইপার কলােনির সুইপাররা লাশগুলাে পুঁতে ফেলে।
ঈশ্বরদী উপজেলায় চারটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। সেগুলাে হলাে- বাঘইল পশ্চিমপাড়া গণহত্যা, নুরমহল্লা কর্মকারপাড়া গণহত্যা, ছয়গ্রাম গণহত্যা এবং ঈশ্বরদী কয়লা ডিপাে গণহত্যা। বাঘইল পশ্চিমপাড়া গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৩শে এপ্রিল। এতে পঞ্চাশ জন নরনারী শহীদ হন। নুরমহল্লা কর্মকারপাড়া গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৩ই এপ্রিল। এতে দুশতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। ছয়গ্রাম গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৫শে এপ্রিল। এদিন সাহাপুর, রূপপুর প্রভৃতি ছয়টি গ্রামের বহু নিরীহ মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়। ঈশ্বরদী কয়লাডিপাে গণহত্যা সংঘটিত হয় ১২-১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত। এতে ১৯ জন সাধারণ লােক শহীদ হন।
ঈশ্বরদীতে প্রথমাবস্থায় নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির গড়ে উঠেছিল ঈশ্বরদী ডাকবাংলাে, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পেছনে জামায়াত অফিস, আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস, পাকশীর কাগজ কল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাদদেশের সেনা ক্যাম্পে। ঈশ্বরদী ও পাকশীর সেনা ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছিল দাশুড়িয়ার ইউসুফ মালিথা ওরফে ঘন্টু মালিথাকে। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় জামায়াত প্রার্থী খােদা বক্স খাঁর মাইক কেড়ে নেয়া। পাকসেনারা ঈশ্বরদী থানার দখল নিলে খােদা বক্স খানের নির্দেশে তাঁকে দাশুড়িয়ার রাজাকার ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। দাশুড়িয়া রাজাকার ক্যাম্পের ময়েজ রাজাকারের নেতৃত্বে হাত পা বেঁধে পেটাতে-পেটাতে একটি স্কুটারে তুলে তাকে জামায়াত অফিসের বন্দিশিবিরে আনা হয়। সেখানে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখে অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয়।
এরপর তাকে পাকশী কাগজ কলের বন্দিখানায় নিয়ে এসে দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। তার সঙ্গের অধিকাংশ বন্দিকে এক-এক করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাদদেশে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হচ্ছে এটি বুঝতে পেরে ঘন্টু মালিথা এক সন্ধ্যায় বন্দিশালার দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পাশবিক নির্যাতন ও অকথ্য যন্ত্রণা সহ্য করার পর যে সন্ধ্যায় ঘন্টু মালিথা পালিয়ে আসে তার আগের দিন সকাল বেলা সে তার সঙ্গের দুজন বন্দিকে অভিনব কায়দায় হত্যা করতে দেখে। ঐদিন দুজন পাঞ্জাবি সেনা ঘরে ঢুকে টেনে-হিচড়ে দুজন বন্দিকে বাইরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের পশ্চাৎদেশে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যেতে বলে। বন্দি দুজন জীবন ফিরে পাবার আশ্বাসে প্রাণপণে দৌড় দিলে পেছন থেকে ব্রাশ ফায়ার করা হয় এবং তারা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। এ দৃশ্য দেখার পরই ঘন্টু মালিথা পালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ঐ বন্দিশিবিরে সে স্কুল ছাত্রদেরও মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করতে দেখেছে।
পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ক্যাম্পের পাকহানাদারদের নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল পৃথক ধরনের। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থানের কোনাে উপায় ছিল না। তাই সকাল বেলা উঠে কাজের আশায় দিনমজুররা পাকশী ফেরিঘাটে উপস্থিত হতাে। সেখান থেকে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়লে আর রেহাই ছিল না। এই ঘাতকরা নিরীহ মানুষগুলােকে ধরে এনে তাদের ক্যাম্পের আশপাশ, পদ্মাতীরের গাইড ব্যাংক ও রেল লাইনের ধারে ট্রেন্স খোড়ার কাজে লাগাত। কাজে গাফিলতি দেখলে অভুক্ত মানুষগুলােকে বেদম পেটাত। পেটাতে-পেটাতে আধমরা হয়ে গেলে গুলি করে নদীতে ফেলে দিত। তবুও ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে ক্ষুধার তাড়নায় দিনমজুররা ঘাটে উপস্থিত হতাে। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে জুলাইর প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিনের মতাে কয়েকজন দিনমজুর কাজের সন্ধানে ফেরিঘাটে ঘুরছিল। এমন সময়। হানাদারদের তিনটি টহল স্পিড বােট ঘাটে আসে। ডাঙ্গা থেকে বেশ খানিকটা দরে বােটগুলাে থামল। এমন অবস্থায় তারা কীভাবে নামবে। তারা মজুরদের ডাকল। তারপর এক-এক করে মজুরদের কাঁধে চড়ে ডাঙ্গায় উঠে এল।
দিনমজুররা ভেবেছিল হয়তাে কিছু মজুরি মিলবে, কিন্তু পরিবর্তে মিলল চড় ও থাপ্পড়। ব্রিজ ক্যাম্পের পাকসেনারা ছিল নৃশংস ও বর্বর। প্রত্যক্ষদর্শী মজুরদের কাছ থেকে জানা যায় যে, প্রায়ই পদ্মার পানিতে তারা যুবতী মেয়েদের লাশ ভাসতে দেখত। তাদের সারা শরীরে ছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের নির্যাতনের চিহ্ন।
পাকসেনারা পাকশীতে স্থায়ীভাবে অবস্থানের পর পাকশী বাজারের পেছনে বেলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি নির্যাতন সেল স্থাপন করে। এখানে পাকশী রেলওয়ে অফিসে চাকরিতে যােগদান করতে আসা কর্মচারীদের ধরে আনা হতাে এবং স্থানীয় অবাঙালিদের পরামর্শমতাে বিভিন্ন প্রশ্ন করে কারা-কারা পাকশীর অবাঙালি হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের নাম জানতে চাওয়া হতাে। কখনাে-কখনাে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন করা হতাে। উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে এসব হতভাগ্য রেল কর্মচারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানাে হতাে। এমনি অত্যাচারের শিকার রেল কর্মচারী মহিউদ্দিন শিকদার, রেলওয়ে সহকারী ট্রাফিক কর্মকর্তা (এটিও) খাদেম এবং কর্মচারী হেলাল উদ্দিনের আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে জানা যায়, রেল অফিস থেকে ধরে এনে এই তিন কর্মচারীর ওপর সারাদিন অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয়। এদের মধ্যে মহিউদ্দিন শিকদার ছিলেন গ্যাসট্রিক আলসারের রােগী। ক্ষুধার তাড়নায় খাবার চাইলে তাকে দেয়া হয় দুখানা শুকনাে রুটি, আর খাওয়ার পর পানি চাইলে বলা হয় প্রস্রাব করে তা পান করতে। খাদেম ও হেলাল উদ্দিনকে রাইফেলের বাঁটের আঘাতে-আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। সারাদিন অত্যাচারের পর সন্ধ্যায় তাদের হত্যার পরিকল্পনা করা হলে খবর পেয়ে পাকশীর বিভাগীয় অফিসের প্রধান কর্মকর্তা (ডিএস) শফি আহমেদ তৎকালীন ঈশ্বরদী থানার দায়িত্বে থাকা বেলুচি মেজরকে অনুরােধ করে তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকসেনারা শফি আহমেদকে হত্যা করে।
আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস ও সুগার কেইন রিসার্স ইন্সটিটিউটের পাকসেনাদের ক্যাম্পেও আশপাশ থেকে মানুষজনদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে পরে হত্যা করা হতাে। তাদের লাশগুলাে ফেলা হতাে আলহাজ্ব টেক্সটাইলের পেছন দিকে নির্জন কাশবনে। তৎকালীন জয়নগর ইপি ওয়াপদা অফিসে স্থাপিত পাকসেনা ক্যাম্পেও বহু লােককে ধরে এনে বন্দি করে রেখে নির্যাতন চালানাে হতাে।
যুদ্ধের ন’মাসে পাকহানাদাররা তাদের দোসর অবাঙালি, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহায়তায় দিনের পর দিন গণহত্যা, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট চালায়। বিশেষ করে ঈশ্বরদী লােকোসেডে অবস্থানরত অবাঙালিরা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসে হানাদারদের প্ররােচিত করে ঈশ্বরদী, পাকশী, দাশুড়িয়া ও আশপাশের অঞ্চল থেকে বহু নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করত। এসব লাশের সৎকার করারও লােকজন ছিল না। আত্মীয়-স্বজনরাও মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। চরম অবহেলায় সুইপার ও ধাঙড়দের সাহায্যে লাশগুলাে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়। অনেক সময় নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরের আশপাশের কোনাে স্থানে লাশগুলাে পুঁতে রাখা হয়েছে। ঈশ্বরদী থানার বেশ কিছু স্থানে এ ধরনের গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। অনেক গণকবর এখনাে শনাক্ত করার অপেক্ষায়। যে-কটি সনাক্ত করা গেছে, সেগুলাে হলাে- হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবর, ঈশ্বরদী কয়লা ডিপাে বধ্যভূমি ও গণকবর, বাঘইল পশ্চিমপাড়া গণকবর, নূরমহল্লা গণকবর, আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর এবং মাঝদিয়া মাদ্রাসা বধ্যভূমি ও গণকবর যাদের হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাদদেশে হত্যা করা হতাে, তাদের ঐ ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবরে কবর দেয়া হতাে। অনেকের লাশ অবশ্য নদীতে ভাসিয়েও দেয়া হতাে। যাদের বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে ঈশ্বরদী কয়লা ডিপােতে হত্যা করা হতাে, তাদের কয়লা ডিপাে বধ্যভূমি ও গণকবরে কবর দেয়া হতাে। বাঘইল গণহত্যায় শহীদদের বাঘইল পশ্চিমপাড়া গণকবরে কবর দেয়া হয়। নুরমহল্লা গণকবরে কবর দেয়া হয় নূরমহল্লা গণহত্যায় শহীদদের। আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবরে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে প্রায় ২০০ মানুষকে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। মাঝদিয়া মাদ্রাসার পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে তাদের লাশগুলাে ঐ মাদ্রাসা বধ্যভূমি ও গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। ১২ই এপ্রিল অবাঙালিদের সহায়তায় লতিফ, আঁতু ও নানু নামে তিন সহােদরকে পাকশী রেল কলােনির ভেতরে হত্যা করা হয়। কয়েকদিন পরে সুইপাররা লাশতিনটি কলােনির মধ্যে গর্ত করে মাটিচাপা দেয়। ১৩ই এপ্রিল পাকসেনা ও অবাঙালিরা পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের আর এস রফিক ও তার পরিবারবর্গকে হত্যা করে ফেলে রাখে। পরে সুইপাররা লাশগুলাে বাসার সামনে ড্রেনের পার্শ্বে গর্ত করে মাটিচাপা দেয়। এছাড়া শৈলপাড়া মাদ্রাসার আশপাশে এবং ঈশ্বরদী গার্লস স্কুলের পেছনে পানির পাম্পের আশেপাশেও বধ্যভূমি ছিল বলে জানা যায়। জুন মাসের শেষদিকে ভারতে গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করেন। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তাঁরা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাবনা রণাঙ্গনকে ৭ নং সেক্টরের ৪ নং সাব-সেক্টরের অধীনে রাখা হয়। প্রথমাবস্থায় এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর গিয়াস। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন রশিদ এ দায়িত্ব পালন করেন।
৩৩ জন মুক্তিযােদ্ধার প্রথম দলটি ২৯শে জুন নদীপথে সাড়াঘাট হয়ে কামালপুর গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রহিম টিনু, গােলাম রব্বানী ও ফজলুল হক বুদু। ৮ই জুলাই দলটি বাঘইল এলাকায় ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের একটি টাওয়ারে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিলে উত্তর-দক্ষিণ গ্রিডে বিদ্যুৎ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অপারেশনের পর মুক্তিযােদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে আরাে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন।
নভেম্বর মাসে মুক্তিযােদ্ধা মতিয়ার ও তাঁর সহযােদ্ধারা ঈশ্বরদী থানার নগরবাড়ি-খুলনা মহাসড়কের কাছে মিকামারি গ্রামে ক্যাম্প করেন। গ্রামের কিছুটা দূরেই মহাসড়কের পাশে ওয়াপদার আঞ্চলিক অফিস। সেখানে পাকসেনাদের ক্যাম্প। সকাল বেলা হঠাৎ কয়েকজন রাজাকারকে গ্রামের মধ্যে তাঁরা ঘুরতে দেখেন। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন এবং কোনােরকম পরিকল্পনা ছাড়াই চারপাশ থেকে রাজাকারদের তারা ঘিরে ফেলেন। শুরু হয় তুমুল গােলাগুলি। এক পর্যায়ে মতিয়ারের স্টেনগানের গুলি ফুরিয়ে যায়। ওদিকে তখন ভীষণ যুদ্ধ চলছিল। মতিয়ার দৌড়ে গিয়ে গ্রামের ভেতরের ক্যাম্প থেকে গুলি ও গ্রেনেড নিয়ে আসেন। কিন্তু আসার পথে ওয়াপদা ক্যাম্পের পাকসেনারা তাঁকে দেখে ফেলে এবং গুলি শুরু হয়। গােলাগুলির শব্দ পেয়ে পাকসেনারা রাজাকারদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং মতিয়ার কোনােক্রমে ক্রলিং করে একটি ঝােপের ভেতর পুরােনে কবরের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। সেখান থেকে পাকসেনাদের দেখা যাচ্ছিল। তারা মতিয়ারকে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল। তিনি পাকসেনাদের লক্ষ করে গুলি চালান। এতে তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। ইতােমধ্যে পাকসেনারা তাঁর অবস্থান অনুমান করতে পেরে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করতেই তিনি তাদের লক্ষ করে গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে দেখেন গ্রেনেডের ডিজচার্জ আনা হয়নি। ততক্ষণে সহযােদ্ধারা আক্রমণ তীব্র করায় পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে পাকসেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। নিহত তিনজন পাকসেনাকে বক্তারপুর গ্রামে নিয়ে পুঁতে ফেলা হয়।
নভেম্বর মাসেই কোম্পানি কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টুর অধীনস্থ মুক্তিযােদ্ধারা ঈশ্বরদী থানার ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ক্যাম্প করেন। হঠাৎ একদিন বিকেলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ক্যাম্পের পাকসেনাদের একজন বাঙালি বাবুর্চি পালিয়ে এসে খবর দেয় যে, ব্রিজ ক্যাম্প থেকে এক ট্রাক পাকসেনা মহাসড়ক ধরে ঈশ্বরদী যাবে। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা টু-আই-সি সামাদের নেতৃত্বে জয়নগর ওয়াপদা গেটের পাশে এম্বুশ রচনা করেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে পাকসেনাদের ট্রাক এসে পৌঁছলে মুক্তিযােদ্ধারা ট্রাক লক্ষ করে গুলি চালান। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। তবে তাঁদের প্রথম আক্রমণে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। বাকিরা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়।
১১ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর হাতে যশাের ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটলে দলে-দলে পাকসেনারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে অগ্রসর হয়। এসময় জয়নগর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পের গােপন বার্তা সংগ্রাহকরা খবর নিয়ে আসে যে, নয়জন পাকসেনা পায়ে হেঁটে বাঘইল গ্রামের ভেতর দিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খবর পাওয়ার পর প্রায় দেড়শত মুক্তিযােদ্ধার একটি দল সাকরিগাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া মহাসড়কের একটি কালভার্টের নিচে এম্বুশ করেন। দূরে পাকসেনাদের দেখা যাচ্ছিল। তারা মার্চ করে এগিয়ে আসছে। মুক্তিযােদ্ধারা ক্রলিং করে এগিয়ে যান। দলের অগ্রভাগে যারা ছিলেন, তাঁদের হাতে এলএমজি। পাকসেনারা মুখােমুখি হতেই সামনে থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। পাকসেনারাও সামনের একটি নিচু খাদে ঝাপিয়ে পড়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী পাল্টা জবাব দিতে-দিতে চারদিক থেকে পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে। এ-সময় পাকসেনারা অয়ারলেসের মাধ্যমে সাহায্যের জন্য নিকটবর্তী ঘাটির উদ্দেশে আবেদন জানায়। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা তাতে অস্বীকৃত জানায়। ইতােমধ্যে আটকে পড়া পাকসেনাদের উদ্ধারকারী বাহিনী এসে পৌছে। তারা মুক্তিযােদ্ধারে লক্ষ্য করে মেশিনগান ও মর্টারের গােলাবর্ষণ করতে থাকে। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে এযুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।
১২ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সাজোয়া বহর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হয়ে বাঘইলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া হেরিংবােম রাস্তা ধরে ঈশ্বরদীর দিকে যাচ্ছিল। ভারতীয় বিমান আক্রমণের ভয়ে তারা খুলনা-ঢাকা মহাসড়ক ধরে না গিয়ে গাছপালা ঘেরা বাঘইল গ্রামের এই রাস্তা ব্যবহার করছিল। অধিকাংশ জিপ-ট্রাক বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ডালপালা দিয়ে ঢাকা ছিল। পাকিস্তানি স্থল সেনারাও পাকশী-ঈশ্বরদী রেল লাইন ধরে ঈশ্বরদীর দিকে মার্চ করে যাচ্ছিল। সকাল ১০টার দিকে কয়েকটি ভারতীয় জঙ্গী বিমান সগর্জনে ছুটে এসে রেল লাইন বরাবর এক নাগাড়ে মেশিন গানের গুলিবর্ষণ করে। পাকসেনারা একবার লাইনের পার্শ্বস্থ ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিচ্ছিল, আবার মুহূর্তে উঠে দৌড়ে সামনে এগুচ্ছিল। ভারতীয় বিমান চক্রাকারে ঘুরেঘুরে তখনাে গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছিল। এভাবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিমান আক্রমণ চলে। এদিকে রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলােতে মুক্তিবাহিনী এম্বুশ করে আছে। রেল লাইন লক্ষ করে তারা অবিরাম গুলি চালাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে পাকসেনারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা মুক্তিবাহিনীর গুলি ও বিমান হামলা এড়িয়ে ঈশ্বরদী অভিমুখে ছুটতে থাকে। ভারতীয় বিমান এরপর পাকশী পেপার মিলসে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। মিলের ব্যাগাস ইয়ার্ডে তারা শেলিং করলে নিমেষে সমস্ত ইয়ার্ড দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। পেপার মিলসের মেইন বিল্ডিংএ তারা শেলিং করেছিল। এই বিমান হামলা ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে সেদিন প্রচুর পাকসেনা হতাহত হয়েছিল। অপরপক্ষে মুক্তিবাহিনীর শেলী মােস্তফা, আব্দুর রহিম ও আফিল উদ্দিন শহীদ হন।
১৪ই ডিসেম্বর ঈশ্বরদী থানার কোম্পানি কমান্ডার কাজী সদরুল হক সুধা যশাের থেকে পালিয়ে আসা পাকসেনাদের মােকাবেলা করার উদ্দেশ্যে এক প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে চর সাহাপুরের জনৈক গফুরের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। এসময় তার কাছে খবর আসে যে, পাকশী রেল টানেল ও বাঘইল রেল টানেলের মাঝামাঝি স্থানে জন ত্রিশেক পাকসেনা জড়াে হয়েছে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে যান এবং ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়কের কাছাকাছি পজিশন নিয়ে পাকসেনাদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। পাকসেনারা আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাদা ফ্লাগ দেখালেও পরক্ষণেই মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি চালায়। একটা গুলি কমান্ডার সুধার হাতে থাকা স্টেনগানে এসে লাগে। অল্পের জন্যে তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং তাঁর এলএমজি বাহক জীবনকে গুলি চালানাের নির্দেশ দেন। উভয় পক্ষে ব্যাপক গােলাগুলি শুরু হয়। পাকসেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। এসময় মুক্তিযােদ্ধারা ঘুরে গিয়ে পাক হানাদারদের ঘিরে ফেলেন। ঘেরাওয়ের ফাঁক দিয়ে হানাদারদের কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভারতীয় বিমান আক্রমণে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বিধ্বস্ত হলে সেই শব্দে হতভম্ব মুক্তিযােদ্ধাদের কর্ডন ভেঙ্গে গেলে কয়েকটি লাশ ফেলে রেখে বাকি পাকহানাদাররা পালিয়ে যায়।
৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। নদীর ওপারে কুষ্টিয়ার দিক থেকে মুহুর্মুহু কামানের গর্জন ভেসে আসতে থাকে। এর মধ্যেই পতন ঘটে যশাের সেনানিবাসের। বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতাে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পাকসেনারা তাদের অস্ত্র ও রসদসহ পালিয়ে এসে পাবনা শহরে আশ্রয় নেয়। ১৪ই ডিসেম্বর গগনবিদারী শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ-সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটি উড়িয়ে দেয়া হয়। ভারতীয় বাহিনীর বােমাবর্ষণের সময় ব্রিজের ওপর দিয়ে পাকবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাংক বহর পার হচ্ছিল। স্প্যান ভেঙ্গে পড়ার পরও একটি ট্যাংক ব্রিজের ওপর পড়েছিল। এ-সময় কয়েকজন পাকসেনার লাশ ব্রিজের ভাঙ্গা স্প্যানে ঝুলতে দেখা যায়। ১৬ই ডিসেম্বর সারারাত চতুর্দিক প্রকম্পিত করে কেবল গুলির শব্দ হচ্ছিল। ভাের হতেই গ্রাম-গ্রামান্তরে আশ্রিত মানুষ দলে-দলে ছুটে যায় ঈশ্বরদী, পাকশী প্রভৃতি ফেলে আসা জনপদে। ঈশ্বরদীতে প্রায় ৫ হাজার পাকসৈন্য বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়ে। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেকশন একে-একে ঈশ্বরদী ও পাকশীতে ঢুকে ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯শে ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী পাকসেনাদের বন্দি করে ঢাকায় নিয়ে যায়।
ঈশ্বরদী উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- হাবিবুর রহমান রাজু (পিতা আব্দুর রহিম সরদার, নতুন রূপপুর; ২৯শে মার্চ মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), নবাব আলী (পিতা আব্দুল গফুর মন্ডল, দিয়াড় বাঘইল; ২৯শে মার্চ মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), ওহিদুর রহমান (পিতা দিনাজ উদ্দীন, সাহাপুর; ২৯শে মার্চ মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল গফুর (পিতা খােরশেদ আলী, পাকশী; ২৯শে মার্চ মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আজের আলী বিশ্বাস, নতুন রূপপুর; ২৯শে মার্চ মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), নুরুল ইসলাম (পিতা আব্দুস সােবহান, রূপপুর; ২৯শে মার্চ মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মান্নান (পিতা আব্দুস ছাত্তার মন্ডল, দিয়াড় বাঘইল; ১৪ই জুন মুলাডুলি যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মালেক (পিতা মফিজ উদ্দিন খান, রূপপুর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাঁদো যুদ্ধে শহীদ), আব্দুস ছাত্তার (পিতা আব্দুর রহমান বিশ্বাস, নতুন রূপপুর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাদো যুদ্ধে শহীদ), নায়েব আলী (পিতা জাকের প্রমাণিক, দাদাপুর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাঁদো যুদ্ধে শহীদ), আব্দুর রশিদ (পিতা রহমত আলী প্রামাণিক, বিলকেদার; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাঁদো যুদ্ধে শহীদ), শহিদুজ্জামান (পিতা তৈয়ব আলী, দাদাপুর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাঁদো যুদ্ধে শহীদ), শেলী মােস্তফা (পিতা ডা. আব্দুর রহমান, মানিকনগর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকঁদো যুদ্ধে শহীদ), মনসুর আলী (পিতা ইসাহাক আলী, তিলকপুর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাঁদো যুদ্ধে শহীদ), নুর মােহম্মদ (পিতা মােহম্মদ আলী, পূর্বটেংরি; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকাঁদো যুদ্ধে শহীদ), মহসিন আলী (পিতা হারান আলী, চর রূপপুর; ১৪ই সেপ্টেম্বর সােনাকঁদো যুদ্ধে শহীদ) এবং ইসরাইল (পিতা মােজাহার আলী, দরিনারিচা; ১৪ই ডিসেম্বর জয়নগর যুদ্ধে শহীদ)।
ঈশ্বরদী উপজেলায় প্রশাসনিক, সর্বজনীন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদদের নামে বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং রাস্তাঘাট ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধা ও গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে পাবনা-ঈশ্বরদী সড়কের আলহাজ্ব মােড় সড়ক-দ্বীপের ওপর সরকারি অর্থানুকূল্যে বিশাল আকারের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজাকার ও আলবদরদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য একটি ঘৃণাস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ডিজাইন করেছেন ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিল্পী নিজাম উদ্দীন। মাধপুর প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে ঘটনাস্থলে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বাঘইল পশ্চিমপাড়া গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে এবং পাড়াটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদপাড়া। সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা মাহবুব আহমেদ খান স্মরণে ঈশ্বরদী রেল স্টেশন সংলগ্ন পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত একটি মুক্তমঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে মাহবুব আহমেদ খান মুক্তমঞ্চ। এছাড়া তাঁর নামে ঈশ্বরদীতে একটি সংগীত বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঈশ্বরদী কয়লাডিপােতে শহীদদের স্মরণে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অর্থায়নে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধা নবাব আলী স্মরণে তাঁর জন্মস্থান দিয়াড় বাঘইলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান শহীদ নবাব স্মৃতি সংঘ। কোম্পানি কমান্ডার খায়রুজ্জামান বাবুর স্মরণে ঈশ্বরদীর নব নির্মিত বাসস্ট্যান্ডের নাম রাখা হয়েছে বীর মুক্তিযােদ্ধা খায়রুজ্জামান বাবু বাসস্ট্যান্ড। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাে. আব্দুর রব এমপিএ (বগামিয়া)-র স্মরণে পাবনা কোর্টভবন থেকে রূপপুর গ্রাম পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মাে, আব্দুর রব বগামিয়া সড়ক। মুক্তিযােদ্ধা সিরাজুল ইসলাম মন্টুর স্মরণে রূপপুর মােড় থেকে পাকুড়িয়া পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সিরাজুল ইসলাম মন্টু সড়ক।
মুক্তিযােদ্ধা হাবিবুর রহমান রাজুর স্মরণে বগামিয়া সড়ক থেকে দক্ষিণ দিকগামী একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ হাবিবুর রহমান রাজু সড়ক। মুক্তিযােদ্ধা মতিউর রহমান স্মরণে উমিরপুর থেকে পূর্বদিকগামী সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযােদ্ধা মতিউর রহমান সড়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় রূপপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া প্রধান সড়কের পাশে কাসেম মােল্লা নামে এক ব্যক্তির চায়ের দোকানে বিবিসি-র সংবাদ শােনার জন্য লােকজন জড়াে হতাে। পরবর্তীকালে ঐ দোকানের আশপাশে আরাে দোকানপাট গড়ে ওঠায় এটি একটি বাজারে পরিণত হয় এবং বাজারটির নামকরণ করা হয় বিবিসি বাজার। ১৯৯১ সালে বিবিসি বেতারের প্রতিনিধি সিরাজুর রহমান, দীপঙ্কর ঘােষ ও ব্যারি ল্যাংরিজ এসেছিলেন এ বাজার পরিদর্শনে। মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদদের স্মরণে স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিদের উদ্যোগে ঈশ্বরদী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার। পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের আর এস রফিক ও তার তিন পুত্র এবং একজন কর্মচারীকে যে গণকবরে সমাহিত করা হয়, সেটি পাকশী কলােনির পানির ট্যাংকের সন্নিকটস্থ চার রাস্তার মােড়ে অবস্থিত। এলাকার কয়েকজন উদ্যোগী যুবক এ মােড়ের নাম রেখেছেন পাঁচ শহীদের মােড়। শহীদ আমিন উদ্দীনের নামে ঈশ্বরদী শহরের একটি মহল্লার নামকরণ করা হয়েছে। আমিনপাড়া। [আবুল কালাম আজাদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড