মুক্তিযুদ্ধে ইটনা উপজেলা
ইটনা উপজেলা (কিশােরগঞ্জ) হাওর-জনপদ ইটনা একটি রাজনীতি-সচেতন এলাকা। ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন এবং ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রভাব ইটনায় পড়ে। ১৯৬৮ সালে ইটনা থানার কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের উদ্যোগে ইটনা মহেশ চন্দ্র শিক্ষা নিকেতনে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে কিশােরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ আন্দোলনের জন্য এ এলাকার মানুষকে উজ্জীবিত করে। বাঙালিদের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দান, আগরতলা মামলা- (১৯৬৮), উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদি কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সারাদেশের মতাে ইটনার মানুষেরও প্রিয় নেতায় পরিণত হন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু জননেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ইটনায় আসেন। বঙ্গবন্ধু এখান থেকে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা আবদুল হামিদ (বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এবং প্রাদেশিক পরিষদে আব্দুল কাদিরের পক্ষে নৌকা প্রতীকে ভােট দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট দুই প্রার্থী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে বিজয়ী হন।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফা স্থগিত ঘােষণার পরপর বঙ্গবন্ধু সারাদেশে অসহযােগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে ইটনা হাইস্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস বর্জন করে। তারা প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ করতে শুরু করে। কিশােরগঞ্জ কলেজে অধ্যয়নরত ইটনার ছাত্ররা গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। রেডিও তখন সবার নিত্যসঙ্গী। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণ শােনার জন্য ইটনার মানুষ দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন স্থানে সমবেত হয়। কিন্তু সেই ভাষণ সরাসরি বেতারে প্রচারিত না হওয়ায় পরের দিন ভাষণের রেকর্ড বাজিয়ে শােনানাে হয়। ৮ই মার্চ থেকে গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটে ইটনাবাসীর। ২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।
ইটনা উপজেলার মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকেই ছিলেন সে সময়ে কিশােরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র। তাদের বেশিরভাগই থাকতেন শহিদী মসজিদ সংলগ্ন ইসলামিয়া ছাত্রাবাসে। এ ছাত্রাবাস ছিল ইটনার ছাত্রদের একটি মিলনস্থল। এখান থেকে লেখাপড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের ছাত্র রাজনীতির চর্চাও চলত। ২৬শে মার্চ বিদেশী বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়া এবং ঢাকায় নির্বিচার গণহত্যার খবর পায় ইটনাবাসী। ২৭শে মার্চ উত্তাল জনতা লাঠিসোটা নিয়ে ইটনার ধনু নদীর তীরে সমবেত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। এখানে একটি বিক্ষোভ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে আবদুল হামিদ এমএনএ এবং স্থানীয় সকল ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। পরে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা ইটনায় অভিযান শুরু করলে রাজনৈতিক নেতারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মার্চ মাসের শেষের দিকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র-এর সংবাদপাঠক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়-এর কণ্ঠে ইটনাবাসী শুনতে পায় যে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে। এ খবর পেয়ে দেশপ্রেমিক তরুণরা ছােট-ছােট দলে ভাগ হয়ে মেঘালয়ের বিভিন্ন ক্যাম্পে যেতে শুরু করে। আবদুল হামিদ এমএনএ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে বালাট ক্যাম্পে অবস্থান নেয়ায় অনেক তরুণ সেখানে তার সঙ্গে মিলিত হয়। আবদুল হামিদ তাঁদের রিক্রুট করে মেঘালয়ের গহীন অরণ্যে চেরাপুঞ্জিতে অবস্থিত ইকোওয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান। আরেক দল তরুণ মহেশখলা সীমান্ত থেকে তুরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে ইটনা থানা থেকে শতাধিক ছাত্র-তরুণ এ দুই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫ ও ১১ নম্বর সেক্টরে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একদল যুবক হাফলং এবং দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুজিব বাহিনী হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেয়। বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু তরুণ ভারতের তেজপুরে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। এ সমস্ত কেন্দ্রে রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি, স্টেনগান, এলএমজি, রকেট লঙ্গর, হ্যান্ড গ্রেনেড, বিভিন্ন ধরনের মাইন এবং বিস্ফোরকের ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ইটনা, অষ্টগ্রাম ও তাড়াইল থানা নিয়ে গঠিত অঞ্চলে আবদুল হামিদ এমএনএ (বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি) মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান ইটনা থানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। এছাড়া আব্দুল কাদির এমপিএ, ছাত্রনেতা শাহাবউদ্দীন ঠাকুর, গােলাম রাব্বানী বুলবুল, হাবিবুর রহমান ঠাকুর, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন। ইটনা উপজেলার মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকে নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁদের মধ্যে ৫ নম্বর সেক্টরে সিরাজুল ইসলাম প্রথমে সহকারী কমান্ডার ও পরে কোম্পানি কমান্ডার, হাবিবুর রহমান ঠাকুর ও মাে. রওশন আলী রুশাে সেকশন কমান্ডার এবং ইসমাইল হােসেন বেইস কমান্ডার ছিলেন। ১১ নম্বর সেক্টরে কে এম মাহবুবুল আলম কোম্পানি কমান্ডার, মাে. সালাহউদ্দিন আহমেদ সহকারী কোম্পানি কমান্ডার, আব্দুস ছাত্তার ও ইদ্রিছ আলী প্লাটুন কমান্ডার, আল-মামুন ও আব্দুল আহাদ সেকশন কমান্ডার ছিলেন। এ সমস্ত কোম্পানি, প্লাটুন এবং সেকশন এলাকাভিত্তিক ছিল না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে দলগুলাে গঠিত হয়েছিল। ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার ছিলেন।
১৬ই এপ্রিল সিরাজুল ইসলাম নামে গুরুদয়াল কলেজের বিএ শেষবর্ষের এক ছাত্রের উদ্যোগে এলংজুরী ইউনিয়ন সদরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি হানাদার প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভা চলাকালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দুটি জঙ্গি বিমান অত্যন্ত নিচু দিয়ে উড়ে যায়। বিমান দুটি চারিগ্রামের নিরীহ জনগণের ঘরবাড়ির ওপর বেপরােয়া গােলাবর্ষণ করে। এতে একজন নারীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এর কিছুদিন পর হানাদার প্রতিরােধ কমিটির সদস্যবৃন্দ সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাট যায়। তাদের পথ অনুসরণ করে পর্যায়ক্রমে শতাধিক তরুণ ভারতে চলে গেলে এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধ করার ক্ষমতা আর অবশিষ্ট থাকেনি। ফলে কোনাে প্রতিরােধ মােকাবেলা না করেই হানাদার বাহিনী ইটনায় অনুপ্রবেশ করে।
২৬শে আগস্ট ক্যাপ্টেন আনােয়ারের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ইটনায় অনুপ্রবেশ করে। এদিন তাদের আসার কোনাে পূর্বানুমান কারও ছিল না। সাপ্তাহিক হাটবার হওয়ায় আশে-পাশের গ্রামের লােকজন স্বাভাবিকভাবে বাজার-সওদায় ব্যস্ত ছিল। হানাদার বাহিনী ৬-৭টি বড় নৌকায় পশ্চিম দিক থেকে এসে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ইটনার সিমলা থেকে পূর্বগ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিকল্পিতভাবে হিন্দু বাড়িগুলাের ওপর আক্রমণ চালায়। এদিন সিমলা পূর্বগ্রাম গণহত্যায় অর্ধশতাধিক নিরীহ লােক প্রাণ হারায়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কাউকেই তারা রেহাই দেয়নি। ইটনায় অবস্থান গ্রহণ করার পর হানাদার বাহিনী ডাকবাংলাে ও এর পাশের হাসপাতালের কোয়ার্টারগুলােতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ইটনার পূর্বগ্রামে টিএন্ডটি অফিসে আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ইটনার পশ্চিমগ্রামের দাসপাড়ায় এবং ইটনা শহর থেকে ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে ভয়রার বটমূলে দুটি পাহারা চৌকি বসায়। ভয়রা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাকবাহিনী একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা ইটনা হাইস্কুলে রাজাকারপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে।
দেওয়ান আব্দুর রহিমের উদ্যোগে ইটনায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকাররা নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রতিপক্ষের লােকদের হত্যা, নির্যাতন, সম্পদ আত্মসাৎ করা, হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা, হানাদারদের মনােরঞ্জনের জন্য নারীর যােগান দেয়া এবং যে-সকল পরিবার থেকে কোনাে যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের কাছ থেকে রাজাকারদের ভরণপােষণের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা ছিল এদের প্রধান কাজ। স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে দেওয়ান আব্দুর রহিম ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। হাবিবুর রহমান ঠাকুরের নেতৃত্বে ১৫ই নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা ইটনা আক্রমণ করলে প্রধান রাজাকার কমান্ডার আবু তাহের ইউসুফী-সহ সকল রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। সীমাহীন অপকর্ম-অত্যাচারের জন্য আবু তাহের ইউসুফীকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিরােধী অন্যদের মধ্যে আনােয়ার হােসেন খান মিল্কী ওরফে মানিক মিল্কী (রায়টুটী; রায়টুটী ইউনিয়নের কানলা গ্রামের গণহত্যা এবং ইটনার সকল গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত), ইমাম উদ্দিন খান (ইটনা সদর; পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নানা অপকর্মের সহায়তাকারী), খলিলুর রহমান ঠাকুর (শান্তি কমিটির সদস্য), কুদ্ৰত উল্লাহ (ইটনা সদরের চেয়ারম্যান, পাকিস্তানের ঘাের সমর্থক), আব্দুল মজিদ (পশ্চিমগ্রাম, বিডি মেম্বার, শান্তি কমিটির সদস্য), আব্দুল করিম (পশ্চিমগ্রাম, বিডি মেম্বার, শান্তি কমিটির সদস্য), ইসহাক চৌধুরী (বাদলা, বাদলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), মাে. আমির উদ্দিন (জয়সিদ্ধি, জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির সদস্য), মাে. মতিউর রহমান চৌধুরী (আন্দার বড়বাড়ি, মৃগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), উসমান গনি টুকু (চেয়ারম্যান মৃগ ইউনিয়ন), জয়নাল আবেদীন ফুল মিয়া (ইটনা), হােসেন আহমেদ মেনু মিয়া (ছিলনী, বিডি মেম্বার, শান্তি কমিটির সদস্য), প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। দেওয়ান আব্দুর রহিমের প্ররােচনায় উপজেলার কিছু প্রবীণ ব্যক্তি যারা চেয়ারম্যান, মেম্বার, প্রভাবশালী সমাজপতি এবং মুসলিম লীগ সমর্থক ছিল তারা শান্তি কমিটির সদস্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে শান্তি কমিটির কিছু সদস্য মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ এবং কেউ-কেউ জনতার হাতে প্রাণ হারায়। ইটনার রাজাকার কমান্ডার ও শীর্ষস্থানীয় রাজাকার ছিল কুদ্রত আলী (দিঘিরপাড়), মাে. ইদ্রিছ আলী, ইসহাক খান পাঞ্জু, মুসলেহ উদ্দিন, আব্দুল হাই, গােলাপ মিয়া, ইয়াকুব মিল্কী এবং নবী হােসেন। লুটপাটে অংশগ্রহণে নেতৃত্ব দেয় উমর ফারুক, মাে. খালেদ ঠাকুর (বর্তমানে নরওয়ে প্রবাসী) প্রমুখ। ২৬শে আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইটনার উত্তরপশ্চিম প্রান্ত দিয়ে এ উপজেলায় প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসেবে তাদের সঙ্গে ছিল আশরাফ উদ্দিন খান মানিক মিল্কী এবং আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ওরফে কোরবান আলী। এ দুই ব্যক্তির নির্দেশনায় ইটনায় প্রথমদিনেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। ইটনার প্রবেশমুখে তারা একজন নিরীহ জেলেকে হত্যা করে। দাসপাড়ার বিশিষ্ট হােমিও চিকিৎসক ডা. দেবেন্দ্র বর্মণের বাড়িতে দুই বৃদ্ধকে হত্যা করে এবং বাড়িতে আগুন দেয়। এরপর তারা রমেশচন্দ্র রায়ের বাড়িতে হামলা করে। একই বাড়ির ৬ জন-সহ বেশ কয়েকজনকে এখানে বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করে। এটি দাসপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। হত্যার পর তারা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইটনায় পৌঁছার পূর্বের দিন পাকিস্তানি হানাদাররা রাজাকার মানিক মিল্কীর ইন্ধনে কানলা গ্রামে হামলা চালিয়ে একজন মুসলিম ও বেশ কয়েক জন নিরীহ হিন্দু নারী-পুরুষকে হত্যা করে। কানলা গণহত্যার পর ইটনা আসার পথে বাদলা ইউনিয়নের শিমলা গ্রামে নন্দকুমার রায়ের বাড়িতে তারা অগ্নিসংযােগ করে। সেখান থেকে হানাদার বাহিনী পশ্চিমগ্রামের জমিদার নলিনীরঞ্জন সাহার বাড়িতে আক্রমণ করে। নলিনীরঞ্জনকে না পেয়ে হানাদাররা তাঁর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ব্রজেন্দ্র লাল সাহাকে হত্যা করে। এরপর পার্শ্ববর্তী রমেন্দ্র রায়ের বাড়িতে আক্রমণ করে। এখানে বৃদ্ধনারী-শিশু নির্বিশেষে অনেককে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড পশ্চিমগ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিত।
হানাদারদের অন্য একটি দল ইটনা মধ্যগ্রামের বাজার সংলগ্ন মধ্যগ্রাম, ঋষিপাড়া, কুমারপাড়া, কামারপাড়া ইত্যাদি হিন্দু-প্রধান পল্লীতে আক্রমণ চালিয়ে অনেককে ধরে এনে পূর্বপাড়া ওয়ারলেস কেন্দ্রে হত্যা করে। ২৬শে আগস্ট সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ড পূর্বপাড়া ওয়ারলেস কেন্দ্র গণহত্যা নামে পরিচিত। আগস্ট মাসেই তাড়াইল থানা থেকে একদল হানাদার এসে চৌগাংগায় উপেন্দ্র বর্মণ নামক এক ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা ৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। বিরারভিটা গ্রামের দালাল তাহের মৌলানা এবং আব্দুল হেকিমের সহযােগিতায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে ইটনার ক্যাম্প থেকে বাইরের গ্রামগুলােতে হানাদাররা অভিযান শুরু করে। ইটনার পূর্বদিকে মৃগা ইউনিয়নের সিরাজুল হক দালালের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালিয়ে সনাতন ধর্মানুসারী ৮ জন মানুষকে হত্যা করে। রাজিবপুর গণহত্যা নামে পরিচিত এ হত্যাযজ্ঞ হাওড় এলাকায় পাকবাহিনীর নৃশংতার সাক্ষর বহন করছে।
হানাদাররা ইটনার ভৌগােলিক সীমার বাইরে থেকে আসা অনেক মানুষকে ইটনার ভয়রা বধ্যভূমিতে হত্যা করে। দক্ষিণ অঞ্চল থেকে শত্রুতাড়িত হয়ে মেঘালয় প্রদেশে যাওয়ার জন্য শরণার্থীদের নৌকাযােগে ইটনার হাওর অতিক্রম করতে হতাে। ইটনার ভয়রায় ছিল হানাদারদের পাহারা চৌকি। রাত্রিবেলায় তারা সার্চলাইটের মাধ্যমে শরণার্থী নৌকা দেখতে পেলেই স্পিডবােট নিয়ে তাদের ধরে এনে এখানে হত্যা করত।
১লা সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জে. আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী তার সৈন্যদের বিশেষ নির্দেশনা দিতে ইটনা সফর করে। ইটনায় তাকে স্বাগত জানায় রাজাকার দেওয়ান আব্দুর রহিম। ইসমাইল হােসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল নিয়াজীকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা নিয়াজীর খুব কাছাকাছি চলে আসেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশন বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন।
১৫ই নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা ইটনা মুক্ত করার লক্ষ্যে থানায় অবস্থিত রাজাকারদের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ করেন। এর আগেই পাকহানাদার বাহিনী পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝতে পেরে ইটনা ছেড়ে কিশােরগঞ্জে চলে যায়। হাবিবুর রহমান ঠাকুরের নেতৃত্বে দেড়শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা ইটনা থানা আক্রমণ-এ অংশ নেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা শেষরাতে থানার চারদিক ঘিরে ফেলেন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আবু তাহের তার দলবলসহ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সব নিয়ে এখানে ৪০ জন রাজাকার ও পুলিশকে আটক করা হয়। ইটনা হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা থানা প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। ইটনা পূর্বগ্রামে টিএন্ডটি অফিস ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের একটি ক্যাম্প। এটি বন্দিশিবির ছিল। এখানে শুধু মেয়েদের রাখা হতাে। পুরুষদের ধরে এনে সঙ্গে-সঙ্গে হত্যার জন্য বধ্যভূমিতে পাঠিয়ে দিত। এখান থেকে অনেক মেয়েকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানাে হয়। কিশােরগঞ্জ, নিকলী, নান্দাইল প্রভৃতি স্থানে প্রেরিত মেয়েদের আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ইটনা সদরের ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের ভয়রা গ্রামে হাওর অঞ্চলের বৃহত্তম বধ্যভূমি ছিল। এখানে একটি প্রাচীন বটগাছের নিচে বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এ বধ্যভূমির পার্শ্ববর্তী কয়েকটি পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে গণকবর ছিল। স্বাধীনতার পর এখানে হাড়গােরের বিশাল স্থূপ আবিষ্কৃত হয়। বধ্যভূমি ও গণকবরগুলাে এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত হয়নি। বটগাছটি এখনও ৭১-এর ভয়াল দিনগুলাের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসর রাজাকারদের ইটনায় রেখে কিশােরগঞ্জ চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা তখন সীমান্ত থেকে হাওরাঞ্চলে আসতে শুরু করেন। হাওরাঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একের পর এক থানা মুক্ত করতে শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনের সঙ্গে-সঙ্গে কার্যত রাজাকার বাহিনী তাদের নিজনিজ ক্যাম্পে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৫ই নভেম্বর হাবিবুর রহমান ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ইটনা থানার পতন ঘটে।
ইটনায় ২ জন শহীদ মুক্তিযােদ্ধার নাম জানা যায়। তারা হলেন- সিরাজুল ইসলাম, বীর বিক্রম- (পিতা মুণ্ডুল হােসেন, ছিলনী)। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের টেকেরঘাট সাবসেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা-সিলেট স্থল ও নৌ-যােগাযােগ ব্যবস্থা অচল করতে বেশকিছু সফল অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ৮ই আগস্ট সুনামগঞ্জ জেলার নদীবন্দর সাচনা-জামালগঞ্জে ২৭ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। অপরজন শেখ ওমর ফারুক (পিতা শেখ আব্দুর রহমান, ইটনা; ইপিআর সদস্য)।
ইটনা পশ্চিমগ্রাম থেকে পূর্বগ্রাম পর্যন্ত ইটনা মহেশ চন্দ্র মডেল শিক্ষা নিকেতনের পাশের খালের ওপর শহীদ সিরাজুল ইসলাম, বীর বিক্রম-এর নামে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৭৫.৭৭ মিটার। ২০০৯ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর সেতুটি উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও বীর মুক্তিযােদ্ধা এডভােকেট আবদুল হামিদ (বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রপতি)। শহীদ সিরাজের নিজ গ্রাম ছিলনীর তরুণরা তাঁর নামে একটি স্মৃতি সংসদ গঠন করেছে। ইটনা সদরে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কলেজের একমাত্র ছাত্রাবাসটি এ এলাকার বীর মুক্তিযােদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। [মাে. রওশন আলী রুশাে]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড