মুক্তিযুদ্ধে ইন্দুরকানী উপজেলা
ইন্দুরকানী উপজেলা (পিরােজপুর) ১৯৭১ সালে পিরােজপুর সদর উপজেলার অন্তর্গত ছিল। ২০০২ সালের ২৯শে এপ্রিল ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে ইন্দুরকানি নামে নতুন উপজেলা গঠিত হয়। নদী ও খাল-বিল পরিবেষ্টিত ইন্দুরকানি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছিল পুরােপুরি যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করলে ইন্দুরকানির মানুষ খুবই বিক্ষুব্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সমগ্র পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী মানুষ যখন যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ইন্দুরকানী উপজেলার মুক্তিকামী জনগণ বিশেষ করে ছাত্রসমাজও মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে তারা তাতে যােগ দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পর ইন্দুরকানীর নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন- আলী আহম্মদ, মজিদ কাজী, দেলােয়ার হােসেন, ইউসুফ, অমল ডাক্তার, ফরিদ খান, হােসেন মিয়া, জয়নাল গাজী, মাস্টার শহিদুল আলম গণি, বেলায়েত হােসেন, মনােরঞ্জন ভক্ত, আবদুল লতিফ হাওলাদার, মােতালেব হাওলাদার, শফিকুল প্রমুখ। ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তাঁরা পিরােজপুর সদরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এডভােকেট এনায়েত হােসেন খান এমএনএ, ডা. আব্দুল হাই এমপিএ, এডভােকেট আলী হায়দার খান (ন্যাপ-মােজাফফর), ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডলসহ অন্যান্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনিদের্শনামূলক পরামর্শ গ্রহণ করেন। উপজেলার বেলায়েত হােসেন, মাে. সামসুর রহমান খান, আ. লতিফ হাওলাদার প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। অন্যান্যরা স্ব-উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নেন এবং অনেক মুক্তিযােদ্ধা ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার (সুন্দরবন অঞ্চল) মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন-এর কাছে, পিরােজপুর সরকারি বিদ্যালয়ের মাঠে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পিরােজপুরের মুক্তিযুদ্ধে রইজউদ্দিন পশারী (পিতা হাজী মেছের চাঁদ পশারী)-র অসামান্য ভূমিকা ছিল। তাঁর বাড়ি ইন্দুরকানী উপজেলার পাড়েরহাটের বাদুরা গ্রামে। তিনি সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের খালবিল ও নদীনালা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এ পথেই তার ব্যবসায়িক নৌকা চলাচল করত। সুন্দরবন অঞ্চলে তাঁর ১৯টি নৌকা ছিল। প্রতি নৌকায় চার-পাঁচজন করে মাঝি থাকত। আর এ কাজে নিয়ােজিত ছিল বিশাল এক বাহিনী। নৌকার মাঝিদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল ইন্দুরকানী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। রইজউদ্দিনের এক স্ত্রী ভারতের চব্বিশ পরগণার হাসনাবাদে এবং অপর দুই স্ত্রী পাড়েরহাটে থাকতেন। ফলে তিনি ভারতের চব্বিশ পরগণা জেলার হাসনাবাদ ও পিরােজপুরের পাড়েরহাট বন্দরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। রইজউদ্দিনের সংঘবদ্ধ একটি দল থাকার সুবাদে স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি রইজউদ্দিন কোম্পানি নামে পরিচিত ছিলেন।
রইজউদ্দিন মুক্তিযােদ্ধা ও দেশত্যাগী মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযােদ্ধা এবং শরণার্থীদের সুন্দরবনের গহীন অরণ্য দিয়ে ভারতে পৌছে দেয়াই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি ও তার লােকজন ভারত থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র নিয়ে আসতেন। নবম সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার (সুন্দরবন অঞ্চল) মেজর জিয়াউদ্দিনকে নৌপথে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া-আসার কাজটি প্রায়ই রইজউদ্দিন পশারী করতেন।
ইন্দুরকানীতে পাকবাহিনী কোনাে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি। পিরােজপুর সদর থেকে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করত। পাড়েরহাট বন্দরে রাজাকার ক্যাম্প এবং পাড়েরহাটের উমেদপুরে শান্তি কমিটির অফিস ছিল। পাড়েরহাট বন্দর ব্যবহার করে পাকবাহিনী পিরােজপুরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করত।
মাওলানা দেলােয়ার হােসাইন সাঈদী (পিতা মাওলানা ইউসুফ আলী সিকদার, বালিয়াপাড়া; কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে আমৃত্যু কারাদণ্ড সাজাপ্রাপ্ত)-র নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরােধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামী ইসলামীর সদস্যদের সমম্বয়ে ইন্দুরকানী উপজেলায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। তারা হানাদার বাহিনীর সহযােগী হিসেবে কাজ করে এবং বাঙালিদের ওপর গণহত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠনে অংশ নেয়। উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযােগী ব্যক্তিবর্গ হলাে- পাড়েরহাট ইউনিয়নের আব্দুর রাজ্জাক, মাওলানা মােসলেম গাজী, মাওলানা ইউসুফ, ইসহাক হাওলাদার, গনি মুনশি, সেকেন্দার সিকদার, হাবিবুর রহমান, মনসুর বেপারী, নুরুল হক হাওলাদার, দেলােয়ার হােসেন হাওলাদার, হাজী মােখলেস উদ্দিন হাওলাদার, আজাহার আলী হাওলাদার, মমিন উদ্দিন ফরাজী, দানেশ আলী মােল্লা, হাচেন আলী হাওলাদার, আব্দুস সালাম, নবাব আলী সিকদার, মােতাহার আলী আকন, ফরমান আলী হাওলাদার, মােবারক আলী ফকির, তােজাম্মেল আলী হাওলাদার, আহম্মদ আলী খান, আতাহার আলী হাওলাদার, আব্দুস সত্তার তালুকদার, হাজী আচমত আলী হাওলাদার, মৌলভী খলিলুর রহমান, হারুন-অর-রশিদ, মােস্তাফিজুর রহমান, মশিউর রহমান, মাে. সােলায়মান, আব্দুর রশিদ, সুলতান আহমেদ, বজলুর রহমান, কৃারী আব্দুর রশিদ, মীর দেলােয়ার হােসেন, আব্দুল জলিল, নূরুল ইসলাম হাওলাদার প্রমুখ। পত্তাশী ইউনিয়নে পাকবাহিনীর সহযােগীদের মধ্যে ছিল- ফজলুল হক, আফসার উদ্দিন হাওলাদার, জয়নুদ্দিন মাতুব্বর, মাে. ইউনুছ আলী হাওলাদার, জহির উদ্দিন খা, ইসমাইল চৌকিদার, ফজলুল হক, মান্নান খাঁ, জয়নাল ফকির, হারুন-অর-রশিদ, মােতালেব, মাওলানা আবু বকর, শামসুল হক, তােফেল উদ্দিন, আফসার মৃধা, মােবারেক উদ্দিন সিকদার প্রমুখ। বালিপাড়া ইউনিয়নে পাকবাহিনীর সহযােগীদের মধ্যে আব্দুর রহমান, হাবিবুর রহমান মেম্বার, আব্দুর রহিম, সােহরাব আলী সিকদার, আব্দুর মালেক হাওলাদার, আবদুল মজিদ শেখ, ফজলুল হক, মাওলানা জয়নাল আবেদীন, এম এ মজিদ, সাহেব উদ্দিন, আব্দুল লতিফ হাওলাদার, আব্দুর রহিম সিকদার প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। হানাদার বাহিনীর সহযােগী রাজাকাররা পাড়েরহাটসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযােগ করে। তারা উপজেলার সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আটক করে হত্যার উদ্দেশ্যে পিরােজপুর সেনা ক্যাম্পে পাঠাত।
পাকহানাদার বাহিনী পিরােজপুর জেলা শহরে প্রথমে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন থানা ও বন্দরে হামলা, অগ্নিসংযােগ, হত্যা ও লুটপাট চালায়। দেলােয়ার হােসেন সাঈদী ১৯৭১ সালে ‘পাঁচ তহবিল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তােলে। সাঈদীসহ ৫ রাজাকার মিলে এ সংগঠন গড়ে তােলার জন্য এর নাম হয় পাঁচ তহবিল। এ সংগঠনের অন্য চারজন হলাে- দানেশ মােল্লা, সেকেন্দার সিকদার, মাওলানা মােসলেম উদ্দিন ও হাবিবুর রহমান মুন্সি। এর উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযােদ্ধা এবং মুক্তিকামী বাঙালিদের নিপীড়ন, হিন্দুদের বাড়িঘর লুণ্ঠন এবং তাদের সম্পত্তি দখল করা। আরবি ও উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারায় সাঈদীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘনিষ্ঠতা হয়। তারা উপজেলার পাড়েরহাট বন্দর আক্রমণ করে। তাদের অত্যাচারে উমেদপুরের নারায়ণ, তিমু সাহা, বেনীমাধব সাহা সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইন্দুরকানীর নাপিত বাড়ি তারা লুণ্ঠন করে। এসময় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ তাদের হাতে আহত হয়। তারা ৪ঠা জুন বিনা বালীকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে হত্যা করে। তারা ইন্দুরকানী, পত্তাশী, কালাইয়া, রামচন্দ্রপুর, হােগলাবুনিয়া, বেতবুনিয়া ও উমেদপুরে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চালায় ও বাড়িঘর লুণ্ঠন করে। তারা পত্তাশী তালুকদার বাড়ি, মণ্ডল বাড়ি, মাঝি বাড়ি ও ডাকুয়া বাড়িতে লুটপাট চালায়। এসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেককে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। রাজাকার কমান্ডার মাওলানা মােসলেম গাজী পাড়েরহাট বন্দরের বিপদ সাহার কন্যা ভানু সাহা নামে এক যুবতীকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে ৩ মাস বন্দি করে রাখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা মেয়েটিকে উদ্ধার করে। ভবানীপুরের মইনুদ্দিন চৌকিদার মুক্তিযুদ্ধকালে একটি হিন্দু মেয়েকে দীর্ঘদিন আটক রেখে পরে জোর করে বিয়ে করে। ১৬ই ডিসেম্বরের পর মুক্তিযােদ্ধারা মইনুদ্দিন চৌকিদারকে আটক করে থানায় সােপর্দ করেন।
দেলােয়ার হােসেন সাঈদী ও তার বাহিনী পাড়েরহাট বন্দর ও ইন্দুরকানীর বিভিন্ন স্থান থেকে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকসহ ১১ জনকে আটক করে হত্যার উদ্দেশ্যে পিরােজপুর পাকসেনা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। পরে তাদের বলেশ্বর নদীর পাড়ে পুরাতন খেয়াঘাটে হত্যা করা হয়, যা বলেশ্বর খেয়াঘাট গণহত্যা নামে পরিচিত। ইন্দুরকানী এবং পাড়েরহাটে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল দেলােয়ার হােসেন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আমৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করে।
ইন্দুরকানী উপজেলায় মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সরাসরি কোনাে যুদ্ধ হয়নি। এ অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধারা মেজর জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চল এবং বাগেরহাটের রায়েন্দাসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। নভেম্বর মাসে পার্শ্ববর্তী ভান্ডারিয়া উপজেলার মুক্তিযােদ্ধা আজিজ সিকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাড়েরহাটের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররা পালিয়ে গেলে তাদের রেখে যাওয়া অস্ত্র, গেলাবারুদ ও ক্যাম্পে সংরক্ষিত মালামাল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। ৮ই ডিসেম্বর ইন্দুরকানী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ইন্দুরকানী বাজার সংলগ্ন বলেশ্বর নদীর খেয়াঘাটে মুক্তিযােদ্ধা হুমায়ুন কবিরের নামে একটি তােরণ আছে। ইন্দুরকানী সংলগ্ন বলেশ্বর নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের নামকরণ স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান শেখ ফজলুল হক মনির নামে করা হয়েছে। [মাে. আহম্মদ জাকারিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড