You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী - সংগ্রামের নোটবুক

ইন্দিরা গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪) নেহেরু-কন্যা, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ধাত্রীর ভূমিকা পালনকারী এবং বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু। তিনি ১৯১৭ সালের ১৯শে নভেম্বর ভারতের এলাহাবাদে বিখ্যাত নেহেরু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরাে নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। তাঁর পিতা স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৪৭-১৯৬৪) পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং মাতা কমলা নেহেরু। নেহেরু পরিবারের আদি নিবাস কাশ্মীরে। এটি ভারতের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার। স্বাধীন ভারতের ৭১ বছরের মধ্যে এককভাবে এ পরিবারের ৩ সদস্য (জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজিব গান্ধী) মােট ৩৭ বছর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পিতামহ মতিলাল নেহেরু (১৮৬১-১৯৩১) ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত আইনজীবী ও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা। তিনি দুবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী (শান্তি নিকেতন) ও ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪২ সালে তিনি ফিরােজ গান্ধীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এ দম্পতি রাজিব গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী নামে দুই পুত্র সন্তানের জনক-জননী।
একটি পারিবারিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইন্দিরা গান্ধী বেড়ে ওঠেন। ১৯৩৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যােগ দেন। তখন থেকে তিনি পিতা জওহরলাল নেহেরুর রাজনৈতিক সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’-এ যােগ দিয়ে তিনি কারাবরণ করেন। ভারত স্বাধীনের পর ১৯৫৫ সালে তিনি কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তাঁকে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার সদস্য করা হয়। একই বছর পিতার মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে তিনি এলাহাবাদ নির্বাচনী এলাকা থেকে লােকসভা (নিম্নকক্ষ)-য় নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন। ১৯৭২ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি ভারতে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন, যা ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাঁর দল পরাজয় বরণ করে। ১৯৭৭-৭৮ সময়ে তাঁকে কয়েক মাসের জন্য কারাবরণ করতে হয়। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীনে কংগ্রেস (আই) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনরায় সরকারে প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৮২ সালে একদল উগ্রপন্থী শিখদের হাত থেকে অমৃতসরে শিখ সম্প্রদায়ের পবিত্র স্বর্ণমন্দির পুনরুদ্ধারে সেনা অপারেশন পরিচালনা করায় তিনি তাদের একাংশের কোপানলে পড়েন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে তাঁর সরকারি বাস ভবনের লনে শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনাবসান ঘটে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের সে-সময়কার বহির্দেশীয় বন্ধুদের মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিল অদ্বিতীয়। কোনাে জাতিজনগােষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধ বহির্দেশীয় কার্যকর সাহায্য-সহযােগিতা ও সমর্থন ছাড়া সফল হতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাফল্যের ক্ষেত্রে এ কথা অধিকতর প্রযােজ্য। ভারত শুধু বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, বাংলাদেশের তিনদিক ভারতের ভূখণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্থলপথে ১২০০ মাইল ভারতের ভূখণ্ড শেষে বাংলাদেশের অবস্থান। অতএব ভৌগােলিক দিক থেকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সমর্থন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৭১-এর ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ ও নির্বিচার হত্যা এবং ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। তখন ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে ভারত সরকার, সংসদের বিরােধী দল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এক কথায়, সমগ্র ভারতবাসী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। বিশ্বের অন্য সব রাষ্ট্র যখন বেশকিছু সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছিল, সেখানে শুরুতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও নির্বিচার হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকার ও ভারতীয় জনগণের নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেন। এ মর্মে ২৭শে মার্চ ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বা রাজ্যসভায় আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ৩১শে মার্চ তিনি বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনাক্রমে ভারতের লােকসভায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। ঐ প্রস্তাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে গণতান্ত্রিক, ন্যায়সঙ্গত ও বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা’ বন্ধের আহ্বান জানানাে হয়। একই প্রস্তাবে বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণের সর্বপ্রকার সমর্থন ও সহানুভূতিসহ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সাফল্য সম্পর্কে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার জীবন ভয়ে ভীত বাঙালি শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয়দানে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল গঠিত বাংলাদেশ সরকার (যা মুজিবনগর সরকার নামে সুপরিচিত)-কে ভারতে অবস্থানের সুযােগ করে দেয়। লক্ষলক্ষ শরণার্থীর সেদেশে সাময়িক থাকা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র যােগান দেয়। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে এক কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী একদিকে যেমন ছিল মানবিক সমস্যা, অপরদিকে তা ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। বন্যা-বৃষ্টি আর মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাবে শত-শত নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মৃত্যুতে শরণার্থী শিবিরগুলােতে এক বিপর্যয়কর অবস্থা নেমে আসে। ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রচার মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে স্থান পায়। ১৫ই জুন ভারতের রাজ্যসভায় ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী বিষয়ে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দেন, যাতে তিনি একে শুধু ভারতের নয়, ‘বিশ্বমানবতার এক মহাসংকট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শরণার্থীরা যাতে নির্ভয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সেজন্য সংকটের দ্রুত ও গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধান’এর ওপর বিবৃতিতে গুরুত্বারােপ করা হয়। এর পূর্বে এপ্রিল, মে ও জুনের প্রথম সপ্তাহে তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় একাধিক শরণার্থী শিবির সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। প্রধানত ভারতে এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর উপস্থিতি এবং সেদেশের সমাজ-অর্থনীতিতে তা মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলার পর বাংলাদেশ সংকট অন্তত ভারতের কাছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ আর ছিল না। অতএব ইন্দিরা সরকার বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে শরণার্থীদের মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থার পাশাপাশি এ বিষয়টিও তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশ প্রশ্নে শীর্ষ পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতা চালানাের উদ্দেশ্যে ২৪শে অক্টোবর প্রায় ৩ সপ্তাহের জন্য শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিদেশ সফরে যান এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়ে ভারতের অবস্থানসহ সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি পাকিস্তানে বন্দি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বাংলাদেশ সংকট যখন চলছিল, তখন বিশ্বরাজনীতি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিভক্তি বিদ্যমান। এর ভেতর পাকিস্তানের সহযােগিতায় চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সৃষ্টির সূচনা নতুন উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থে ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের পূর্ব থেকেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা বিচেনায় রেখে ৯ই আগস্ট ইন্দিরা গান্ধীর সরকার অধুনা বিলুপ্ত সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের পারস্পরিক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিমান বাহিনী পশ্চিম অঞ্চলে ভারতের ভূখণ্ডে একাধিক বিমানঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালালে ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালায়। একই দিন ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর তিন দিনের মধ্যে ৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় লােকসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক বিবৃতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ভারতের স্বীকৃতিদানের ঘােষণা দেন। তিনি এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, সময়ের ব্যবধানে আরাে অনেক রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করবে এবং শীঘ্রই বাংলাদেশ বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে নবীন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
এভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা ১৩ দিন অব্যাহত ছিল। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদারদের দখল থেকে বাংলাদেশের একের পর এক শহর মুক্ত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ পাকিস্তানের ইস্টার্ন উইং-এর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের যৌথবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। এ বিজয় অর্জনে ভারতের কয়েক হাজার সৈন্যকে প্রাণ দিতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মহানায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে লন্ডন-দিলি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর অনুরােধে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৩ মাসের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের মাটি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে নজির সৃষ্টি করেন। ১৯৭২ সালের ১৭-১৯শে মার্চ ৩ দিনের জন্য তিনি বাংলাদেশে সরকারি সফরে আসেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে লাখাে জনতার নাগরিক সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে উভয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা বেশ কিছু ছিটমহল আদান-প্রদানসহ সীমান্ত চিহ্নিতকরণের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও প্রতীক্ষা শেষে ২০১৫ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে ঐ চুক্তি কার্যকর হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সর্বোচ্চ নিদর্শনস্বরূপ ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা (মরণােত্তর)’ প্রদান করা হয়। সম্মাননাপত্রে যা বলা হয় –
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর এবং ভারতীয় জনগণের অতুলনীয় অবদানের কথা বাংলাদেশের মানুষ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সূচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক কোনাে কোনাে মহলের বাধা ও হুমকির মুখেও অসীম সাহসের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামরত জনগণের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের জনসাধারণের স্বাধীনতার স্পৃহা ও অধিকার দমন করতে পাকিস্তান সামরিক জান্তা সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে এবং যখন সংকটাপন্ন হয় এদেশের মানুষের অস্তিত্ব, তখন ভারত আশ্রয় দেয় এদেশের অন্ন এক কোটি শরণার্থীকে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে দেয় কাজ করার অবাধ সুযােগ, মুক্তিযােদ্ধাদের দেয় সর্বপ্রকার সহায়তা, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির লক্ষ্যে নেয় সর্ববিধ প্রয়াস, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের জন্য নেয় ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং সর্বশেষে, যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে ত্বরান্বিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যক্ষ সাহায্যসহযােগিতা, তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অনন্য অবদানের উল্লেখ ব্যতীত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পন্ন হয় না। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি দৃঢ় ও সাহসী অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। এর ফলেই অতি দ্রুত বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার-এর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সর্বোচ্চ নিদর্শনস্বরূপ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী’কে, ১০ই শ্রাবণ ১৪১৮ বঙ্গাব্দ /২৫শে জুলাই ২০১১ খ্রিস্টাব্দ, ঢাকায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ২৫শে জুলাই ২০১১; আশফাক হােসেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধী, ঢাকা, সুবর্ণ ২০১৭

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড