বীর প্রতীক আহমেদ হােসেন
আহমেদ হােসেন, বীর প্রতীক (১৯২৬-২০০৯) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯২৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার কুসুমপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আসাদ আলী এবং মাতার নাম জামিলা খাতুন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি এবং পঞ্চগড়ের বিষ্ণুপ্ৰসাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
আহমেদ হােসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ যােগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে তিনি সিপাহি হিসেবে ইপিআর-এর চট্টগ্রাম সেক্টরে যােগ দেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণে তাঁর ব্যাচের ১৫০০ জন সদস্যের মধ্যে তিনি সেরা হন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানেও প্রশিক্ষণ নেন। একজন সাহসী ও দক্ষ সৈনিক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। আহমেদ হােসেন ৬টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের ওপর অবাঙালিদের শাসন, শােষণ ও বৈষম্য আহমেদ হােসেনকে বিক্ষুব্ধ করে। দেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণের উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলন তাকে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আহমেদ হােসেন ইপিআর-এর ঠাকুরগাঁও উইং-এ নায়েব সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তখন তিনি অন্য বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিয়ে ঠাকুরগাঁও এলাকায় বিভিন্ন প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নেন। প্রতিরােধ যুদ্ধের এক পর্যায়ে ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সের অবাঙালি নায়েক সুবেদার সুলতান মােহাম্মদ পালানাের সময় আহমেদ হােসেনের দলের দ্বারা ঘেরাও হয়। নিজের স্টেনগান দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে উদ্যত হলে আহমদ হােসেনের পাল্টা গুলিতে সে নিহত হয়। সৈয়দপুরে আহমেদ হােসেনের দল পাকবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁরা প্রতি-আক্রমণ করে তাদের পরাস্ত করেন। এখানে কয়েকজন পাকসেনা ও অবাঙালি ইপিআর সদস্য নিহত হয়।
এ প্রতিরােধ যুদ্ধের পর আহমেদ হােসেন সহযােদ্ধাদের নিয়ে ভারতে যান। সেখানে তারা ৬ নম্বর সেক্টরে যােগ দেন। উইং কমান্ডার এম কে বাশারের নেতৃত্বাধীন এ সেক্টরের পাটগ্রাম সাব-সেক্টরের বিভিন্ন যুদ্ধে আহমেদ হােসেন লড়াই করেন। তিনি এ সাব-সেক্টরের ৯ডি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। তাঁর দল নিয়ে প্রায়ই তিনি দেশের অভ্যন্তরে এসে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ওপর হামলা চালাতেন। জুন মাসে তার নেতৃত্বে পরিচালিত মীরগড় পাক ঘাঁটিতে এক আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। পঞ্চগড়ের নুনিয়াপাড়ায় তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। এ-যুদ্ধে তিনি বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। যুদ্ধের সময় কয়েকবার তিনি মৃত্যুর মুখােমুখি হন। তিনি একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার আহমেদ হােসেনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নম্বর ৪২৫, খেতাবের সনদ নম্বর ১৭৫)।
স্বাধীনতার পর আহমেদ হােসেন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)-এ যােগদান করেন। তিনি বিডিআর-এর বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত থাকার পর ১৯৭৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গা থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া সংবর্ধনায় তিনি অংশ নেন। অবসর জীবনে তিনি তাঁর যুদ্ধজীবনের স্মৃতিকথা নিয়ে কাজ করেন। তাঁর ডায়েরি ও স্মৃতিকথা নিয়ে ২০০৫ সালে সুবেদার আহমদ হােসেন বীর প্রতীকের জবানিতে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ শিরােনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি ২০০৯ সালের ১১ই নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ঠাকুরগাঁও ওয়াপদা কলােনি মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
আহমেদ হােসেন ২ কন্যা ও ৬ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম মতিয়া খানম। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঠাকুরগাঁওয়ের নিশ্চিন্তপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড